তাফসির ও হাদিস প্রসঙ্গ

 
ছবিঃ প্রতীকী


ধর্ম আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করে?

ছোটবেলা থেকেই শিশুদের জুজুর ভয় দেখানো হয়। অমূলক কিছু বিষয়কে আল্লাহর ভয় দেখিয়ে বলা হয়, ‘এটা করো না- আল্লাহ গোনাহ দেবে, ওটা করো না- আল্লাহ গোনাহ দেবে। শিশুরা দোজখের আগুনের ভয়ে এসব ভুলভাল কথা মগজে ধারণ করে নেয়। ছোটবেলায় পিঁপড়ে সহ এক বাটি পান্তাভাত দিয়ে বলা হতো, ‘পিঁপড়ে খেলে সাঁতার শেখে’! তদ্রুপ ধর্ম নিয়েও শিশুদের সাথে অমন কিছু কথা সমাজে প্রচলিত আছে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল চর্চায় একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

 

আমাদের গার্মেন্টস রিলেটেড বেশিরভাগ আইটেমের ব্যবসা চীনের সাথে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়তই চীনে যাতায়াত করেন। আমিও এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে চীনের বেশ কয়েকটি প্রদেশ সফর করেছি। আবার আমার পরিচালনাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন চীনা প্রতিনিধি পালাক্রমে কাজ করেছে। চীনে ওদের সাথে যেখানেই খেতে বসতাম, বলতো হালাল ফুড। কারণ তারা জানে মুসলিমরা তাদের জন্য যেটা হালাল সেটা ছাড়া অন্যকিছু খায় না।

 

তো চীনের এক ব্যবসায়ী একবার বলেছিলেন, মুসলিম ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশে এসে নকল পন্য তৈরির অর্ডার দিয়ে বলে, বিখ্যাত কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে দিতে। কিন্তু আমাদের সাথে খাবার খেতে বলা হলে হালাল খাবার খোঁজে। আমরা কিছু খেতে বললে বলে, এ খাবার আমাদের জন্য হালাল নয়। তাহলে নকল জিনিস বিক্রি করা কি হালাল?

 

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হুসেন আশকারির গবেষণায় এ বছরের ফলাফলে দেখা গেছে, ইসলামি রীতি মেনে চলা দেশের তালিকার শীর্ষে ইসলামি কোনো দেশের নামই নেই। বরং তালিকার  ৩৩ তম অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া। কুয়েত রয়েছে ৪৮ তম অবস্থানে। অবাক করা বিষয় হলো, তালিকায় সৌদি আরব রয়েছে ১৩১ তম অবস্থানে এবং বাংলাদেশের অবস্থান সৌদি আরবেরও নিচে।

 

গবেষক হুসেইন আসকারি বলেন, মুসলিম দেশগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইসলামি আইন ব্যবহার করে। অনেক দেশ আছে; যেগুলো ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। তবে সেখানকার সমাজে ইসলামি আইন মেনে চলা হয় না। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, এমনকি ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড চলে সেখানে।

 

গবেষণার ফলাফলে দেখানো হয়েছে, সমাজে ইসলামি বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও বেলজিয়াম তালিকার শীর্ষে রয়েছে। অথচ মুসলিম রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন তালিকায় ৬৪ তম এবং সৌদি আরব রয়েছে ১৩১ তম অবস্থানে। বাংলাদেশের অবস্থান সৌদি আরবেরও নিচে।

 

অন্যদিকে তথাকথিত ইসলামি দেশগুলোতে মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন, রোজা রাখেন, কোরআন-হাদিস পড়েন, নারীরা পর্দা করে, পুরুষদের মধ্যে দাড়ি রাখার সংখ্যা বেশি, তথাকথিত ইসলামি পোষাক নিয়ে সচেতন; তবে সমাজে দুর্নীতি আর পেশাগত জীবনে অসদুপায় অবলম্বনের নজির চতুর্দিকে। সমাজের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মুসলমানরা প্রায় সবাই কোরআনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ধর্ম চর্চা করে।

 

কোরানের তাফসির, হাদিস এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ সম্পর্কেঃ

কোরআনই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র ধর্মগ্রন্থ। কোরআনের একটি আয়াত দূরের কথা, একটি শব্দ নিয়েও মুসলমানদের মধ্যে কোনো দ্বিমত বা সংশয় নেই। এর কারণ, কোরানের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া। প্রতিটি আয়াত নাজিল হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীরা তা মুখস্থ করে ফেলতেন। পাহাড়ের গায়ে, পাথরের উপর লিখে রাখতেন, নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। এছাড়া পেশাদার ওহি লেখক ছিলেন,- যারা ওহি নাজিলের সাথে সাথে তা লিখে ফেলতেন। সাহাবীদের মধ্যে কয়েক হাজার হাফেজ ছিলেন। প্রায় সব সাহাবীরই অধিকাংশ কোরআন মুখস্থ ছিলো। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় তা নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়।

 

তাফসির মুলতঃ কোরআনের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ। যুগে যুগে অনেক প্রখ্যাত ইসলামী পন্ডিত, ধর্মতত্ববিদ বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমানাদি বা ইসলামের মৌলিক চর্চার উপর ভিত্তি করে কোরআনের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা মানুষকে কোরআনের উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সহায়ক। কোরআন কাব্যিক ছন্দ এবং সাহিত্যিক রূপকতায় নাজিল হওয়ায় অনেক আয়াতের শাব্দিক অর্থ এর মর্মার্থ থেকে ভিন্ন। যেমন সুরা ফীল-এ আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপে আবরাহার সৈন্যদের নিহত হওয়ার যে বর্ণনা তা রূপক। বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘তাফসিরে কাশশাফ’ এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আবরাহার সৈন্যরা মক্কা থেকে ফিরে যাওয়ার সময় গুটি বসন্তে মারা গেছে বলে উল্লেখ আছে।

কিন্তু এসব তাফসির উচ্চতর একাডেমিক গবেষণা বা ধর্মতত্ববিদদের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞদের মতামত হিসাবে এসব ব্যাখ্যা বিবেচনার যোগ্য হতে পারে, কিন্তু চুড়ান্ত কিছু নয়। 

 

সকল তাফসীর সমানভাবে গ্রহণযোগ্যও নয়। এটি মন্তব্যকারীর প্রোফাইলের উপর নির্ভর করে। অনেকেই তাদের নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোআানের তাফসিরকে কোরআনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়। যেমন; জামায়াতে ইসলামীর লোকদের কাছে মাওলানা মওদুদীর তাফসির চিরন্তন। এর কারণ, ওই তাফসির তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি। আর বিভিন্নস্থানে সামিয়ানা টানিয়ে আপামর জনসাধারণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে তাফসির মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তাতে কোরআনের তাফসির বা কোরআন থেকে আলোচনার কথা বললেও মূলতঃ সেখানে আলোচকদের মনগড়া বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীই বেশি প্রাধাণ্য পায়।

 

হাদিস সম্পর্কেঃ

হাদীস হলো নবীজি(সাঃ)’র কথা, কাজ এবং মৌন সম্মতি। কোরআনে নবীজীর জীবন ও কর্ম অনুসরণের নির্দেশনা দেয়া আছে। তো নবীজীর জীবন ও কর্মের বর্ণনা কোরআনেই আছে। এর বাইরে হাদিস বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো ছিয়ায়েছিত্তার ৬টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ, যা হাদিস সংগ্রহকারী বা সংকলকের নাম অনুযায়ী বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, আবু দাউদ, নাসাঈ এবং ইবনে মাযাহ। গ্রন্থগুলোয় প্রায় লক্ষাধিক হাদিস আছে। তবে একই হাদিস বহুবার এসেছে। তাই বিষয়বস্তুর স্বতন্ত্রতা বিবেচনায় নিলে এই সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। তবে এই হাদিসগুলোর কোনো উল্লেখ কোরআনে নেই বা থাকার সুযোগ নেই। কারণ প্রথম হাদিস গ্রন্থটি যিনি লিখেছেন সেই ইমাম বুখারির জন্মই হয়েছিলো নবীজীর ইন্তেকালের ১৭৮ বছর পর, উজবেকিস্তানে। এবং তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘বুখারী শরীফ’ প্রকাশিত হয় তারও ৩৯ বছর পর।

 

মাদ্রাসার সিলেবাসে কোরআনের চেয়ে হাদিস, তাফসির, ফতোয়া ইত্যাদিই প্রাধাণ্য পায়। অবাক করা বিষয় হলো, দিল্লীর বাদশা আওরঙ্গজেব মোহাম্মদ আলমগীরের আমলে তার সম্রাজ্য পরিচালনার জন্য প্রণীত আইন ‘ফতোয়া এ আলমগীরি’ এখনো মাদ্রাসার সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত!

 

হাদীসের একাডেমিক পরিভাষাগুলোর একটি হলো খবর। খবর মানে আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে যা পড়ি বা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে যা জানতে পারি। খবর একটি এলোমেলো অনির্ভরযোগ্য তথ্য। এটা সত্য হতে পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে। এটা ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। তাই খবর একটি সাধারণ তথ্য, কোনো প্রমাণক নয়। বিশ্বের কোনো আদালতে পত্রিকা বা টিভি সংবাদ এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

 

হাদিস বিশেষজ্ঞরা হাদিসের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন; সহিহ হাদিস, জাল হাদিস, দুর্বল হাদিস বা বানোয়াট হাদিস – এসব মূলতঃ হাদিসের উৎসের ওপর ভিত্তি করে করা। যেমন; যদি কোনো খবরের উৎস হয়ঃ ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা’ বা ‘আবুল কাসিম নাম্মী জনৈক পথচারী’ - তাহলে বুঝে নিতে হবে, কোনো কারণে ওই প্রতিবেদকের মন-মেজাজ খারাপ ছিলো। তিনি বাসায় বসেই সেই রিপোর্ট তৈরি করেছেন।

 

হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই করা একটি অসীম পথ। কেউ বুখারী ও মুসলিম শরীফকে বিশুদ্ধ বলে মনে করেন এবং মুত্তাফাকুন আলাইহি বা (রাওয়াফুস) শায়খায়ন ট্যাগ দিয়ে এই হাদীসগুলোকে আলাদা করেছেন। কেউ কেউ ছিয়ায়েছিত্তার বাইরে বায়হাকি শরীফ সহ অন্যান্য আরো অনেক হাদীসকে সঠিক বলে বিবেচনা করেন। ঐতিহাসিক দলিল বা একাডেমিক গবেষণার জন্য হাদিস ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু হাদিস চর্চা বা পালনের বাধ্যবাধকতা কতোটুকু?

 

বর্তমান তথ্য যোগাযোগ বিপ্লবের যুগে ইউটিউব খুললেই বেশ কিছু মুহাদ্দিসের বক্তব্য পাওয়া যায়। তাদের মতেঃ ‘যেহেতু পবিত্র কুরআনে হাদীসের কোনো সুনির্দিষ্ট বর্ণনা নেই, সেহেতু এই সকল হাদীস পালনের বাধ্যবাধকতাও নেই। কারণ আমরা নিশ্চিতভাবে অবগত নই যে, এগুলো নবীজীর বক্তব্য’। অনেকেই বলে থাকেন, নবীজী বিদায় হজ্জের ভাষাণে হাদীসের কথা বলেছেন। বিদায় হজের ভাষণও তো একটা খবর। আর সেখানে নবীজী তার সুন্নাহ অনুসরণের যে কথা বলেছেন তা কুরআনের বাইরের কিছু তো হতে পারে না। কেননা তখন তো এ সকল হাদীস গ্রন্থ সংকলিতই হয়নি।

 

কেউ আবার এও বলে থাকেন যে, ‘নবীজীর একটি দায়িত্ব ছিলো মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া’। তো নবীজী তো কুরআনের মাধ্যমেই সেই শিক্ষা দিয়েছেন। এর বাইরে কোনো নির্দেশনা আবশ্যক হলে নবীজী নিজেই সেসব লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতেন বা করতে নির্দেশনা দিতেন। নবীজীর পর হাদিস সংকলনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল ব্যক্তি ছিলেন চার খলিফাঃ হযরত আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী(রা), যারা ইসলামের বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এই চার সম্মানিত ব্যক্তি ইসলামের প্রথম দিকেই ইসলাম কবুল করেছেন। নবীজীর ইন্তেকালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা চারজনই ছায়ার মতো সব সময় পাশে থেকেছেন।

 

হযরত আবুবকর(রাঃ) ও ওমর(রাঃ) ছিলেন নবীজীর শ্বশুর। হযরত ওসমান(রাঃ) ও আলী(রাঃ) ছিলেন নবীজীর জামাতা। নবীজীর ইন্তেকালের পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই চারজনই সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। হযরত ওসমানের শাসনামলে মুসলিম বিশ্বের কোষাগার ছিলো অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। কিন্তু ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’-এর যুগ হিসেবে পরিচিত এই সময়কালে তাঁরা হাদিস সংগ্রহ বা সংকলনের কোনো উদ্যোগই নেননি। ২০০-২১৭ বছর পর ইমাম বুখারী ও অন্যান্যরা হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলো, নবীজী ও তাঁর প্রধান সাহাবীরা তা কেনো বুঝতে পারেননি? তার উপরে আবার অনেক হাদিসের বর্ণনা নবীজীর জন্য মর্যাদাহানীকর, আপত্তিকর ও অশালীন! ধর্ম বিদ্বেষিরা এ সকল হাদীসের ভিত্তিতেই নবীজীকে সমালোচনা করে। কটাক্ষ, কটুক্তি বা বিদ্রুপ করে।

 

হাদিস বিষয়ে এসব কথা উঠলে সবার প্রায় একই ধরণের প্রশ্ন – ‘হাদিস ছাড়া আপনি নামাজ পড়বেন কিভাবে? রোজা রাখবেন কিভাবে? এসবের জন্য তো কোরআনে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই’। ভালোকথা, তাহলে ইমাম বুখারীর আগে মুসলিমরা কিভাবে নামাজ পড়তো? আর কোরআনে নির্দিষ্টভাবে না দেয়া মানে আমরা এখন যেভাবে নামাজ পড়ছি ঠিক সেভাবে বলা নেই। এর মানে হলো যে আমাদের এটিকে এভাবে পড়তে হবে এমনটা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে বলেননি। আর আমরা নামাজ নিয়ে যতো বিতর্ক করি, আল্লাহর আদেশ নিষেধের তোয়াক্কাই করি না, যা না মানলে আমাদের নামাজ কবুলই হবে না(সুরা বাকারা, আয়াত ১৭৭)। নামাজ শব্দটি এসেছে ফার্সি থেকে, যা কোরআনে আছে সালাত হিসেবে। কিন্তু এই সালাতের অর্থ ব্যাপক। কোরআনের আদেশ-নিষেধ সঠিকভাবে মেনে চলাই সালাত। তবে নবীজীর আমল থেকে আমরা যেভাবে দেখে আসছি, মক্কা মদীনায় যেভাবে এখনো দেখছি, নামাজ আমরা সেভাবেই পড়ি। এরমধ্যেও আবার নাভির নিচে না উপরে হাত হবে তা নিয়ে চলে ঝগড়া।

 

আর কুরআন সব প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে হাদিস কি তা পারছে? না। সেক্ষেত্রে তৃতীয় পন্থা- কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে কিয়াস বা অনুমান করতে হবে। কিন্তু একেকজন আলেমের অনুমান একেক রকম। সুতরাং, চতুর্থ সমাধান হলো ইজমা-এ-উম্মা বা উম্মতের ঐক্যমত। কিন্তু এটা বাস্তবে হয়নি। কেউ ইমাম আবু হানিফার অনুসারী, কেউ ইমাম শাফেঈর অনুসারী। কেউ আল্লামা শফীর সাথে ঐক্যবদ্ধ, কেউ ওসামা বিন লাদেনের সাথে ঐক্যবদ্ধ। এভাবে মুসলমানরা দলে দলে বিভক্ত।

 

এখানেই শেষ নয়। হাদিসের বাইরেও আছে ফাজায়েলে তাবলীগ, ফাজায়েলে যিকির, ফাজায়েলে জিহাদ। বেহেশতী জেওর, নিয়ামুল কুরআন, মাকসুদুল মুমিনীন সহ হাজার হাজার কিতাব। আর এই সব বইয়ে মনগড়া আমল, দোয়া-তাবিজ, নানান কিচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর। এগুলো আমাদের দেশে কুরআনের চেয়েও জনপ্রিয়। কারণ আমরা অলৌকিক কল্পকাহিনী শুনতে পছন্দ করি। আর আমাদের প্রতিটি প্রশ্নের একটা উত্তর লাগবে এবং সেই উত্তর থেকে আমাদের আরও তিনটি প্রশ্ন বানাতে হবেঃ

-হুজুর, গুরুর লেজ খাওয়া কি জায়েজ? জায়েজ হলে সুন্নত না মাকরূহ? যদি মাকরূহ হয় তাহলে মাকরুহ তাহরীমী না হাকিকী? এইভাবেই আমরা সহজ-সরল পথকে কঠিন করে তুলছি।

 

পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে বড় সূরা হলো ‘সূরা বাকারা’। বাকারা শব্দের অর্থ গরু। এই সূরায় গরু সম্পর্কিত দারুণ শিক্ষনীয় একটি ঘটনা রয়েছে। আর সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সূরাটির নামকরণ।

“বনী ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজনকে হত্যা করেছিল এক গোপন খুনি। পুলিশ যখন এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি, তখন তারা মুসা(আঃ)’র কাছে এসে বললো, ‘আপনি আল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করে বলুন, খুনি কে? মুসা(আঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলে এসে জানালেন, ‘তোমরা একটা গরু জবেহ করো এবং তার হাড় দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে আঘাত করো। ওই লোক জীবিত হয়ে বলবে কে তাকে হত্যা করেছে। কেনো করেছে এবং কিভাবে করেছে’।

 

খুবই সহজ একটি সমাধান। কিন্তু এতোবড় সমস্যার এতো সহজ সমাধান পছন্দ হয়নি ইসরায়েলীদের। তারা একের পর এক প্রশ্ন করা শুরু করলো মুসা নবীকে। গরু কি বলদ না গাভী? গরুর বয়স কতো হওয়া উচিত? রং কি? আকৃতি কি? মুসা(আঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলে এসে একে একে উত্তর দিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সেই বর্ণনা অনুযায়ী গরু খুঁজে পাওয়াই অসম্ভব। অথচ তাদেরকে শুধু একটি গরু জবেহ করতে বলা হয়েছিলো।

 

‘সবচেয়ে জটিল দক্ষতা হলো কোনোকিছুকে সহজ ভাবা’। তাই সহজ করে চিন্তা করুন এবং আপনার চিন্তার অনুশীলন করুন। সহজ করে চিন্তা করলে দেখবেন, জীবন অনেক সহজ। ধন্যবাদ।।

 

(ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে পবিত্র কোরআন যাচাইপূর্বক সংকলিত)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url