ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা - কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্যি
বাঁ'থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুধাংশু শেখর হালদার, মিযানুর রহমান চৌধুরী |
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
"০৪ এপ্রিল ১৯৭৯ সাল। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সংবিধানের
পঞ্চম সংশোধনী বিল উথাপন করলেন তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিষ্টার আবদুস সালাম
তালুকদার। সংসদে বিএনপির আসন সংখ্যা ২০৭। আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মালেক)
এর সংসদ সদস্য ৩৯ জন। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মিজান) এর সদস্য
সংখ্যা ২ জন। অন্যান্যের মধ্যে সংসদে আছেন, তৎকালীন একতা পার্টির নেতা সুরঞ্জিত
সেনগুপ্ত।
সংসদে বিএনপির দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য। তাই সংবিধান সংশোধনী
পাশ তাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বিল উত্থাপন করা হয়। এই
বিলে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ অনেকগুলো মানবতা বিরোধী এবং নিপীড়ন মূলক কালো
আইনকে বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলের উল্লেখযোগ্য সংশোধনীঃ
·
সংবিধানের প্রস্তাবনায় “বিস্মিল্লাহির-রাহ্মানির রাহিম" সংযোজন
করা হয়।
·
সংবিধান থেকে "বাঙালি জাতীয়তাবাদ" অপসারণ করে
"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
·
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
সপরিবারে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিয়ে জারি করা ইনডেমনিটি
অধ্যাসদেশকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
·
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত সামরিক
সরকারের সকল কার্যাবলীর বৈধতা দেওয়া হয়।
·
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং
উক্ত দলগুলোর নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয়।
·
সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সংবিধানের
প্রস্তাবনার আগে "সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস"
যুক্ত করা হয়।
·
সংবিধানের মূলনীতিতে থাকা সমাজতন্ত্রকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে
"সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র" রাখা হয় ।
·
সমাজতন্ত্রকে অপসারণ করে এবং শোষণ থেকে স্বাধীনতা ক্রমবর্ধমান
স্থানীয় সরকার এবং মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা হয়।
·
২৫(২) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির
ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার
করিতে সচেষ্ট হইবেন’।
বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর সংসদের বিরোধী দলের নেতা
আসাদুজ্জামান খান এই বিলের তীব্র বিরোধীতা করেন। এ নিয়ে বিরোধী দলকে বক্তব্য রাখার
সুযোগ দেয়া হলো না।
পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে একতা পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন,
“আজ সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে আপনারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রোধ করেছেন, ৭২ এর
সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করছেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না, এই দিন আপনাদের থাকবে না। যে
অন্যায় আজ আপনারা করছেন, সেই অন্যায়ের বিচার এই সংসদেই হবে। তখন আপনাদের পক্ষে কথা
বলার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে আপনাদের দলের লোক খুঁজতে ‘দূরবীন’ লাগবে”। তিনি
আরো বলেন, “ইতিহাস বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না, আপনাদেরও করবে না”।
বাকেরগঞ্জ ১৪ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এডভোকেট
সুধাংশু শেখর হালদার পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে বলেন, “আজ আইনের শাসন এবং সংবিধানকে
যেভাবে পদদলিত করা হলো, একদিন ইতিহাস তার বিচার করবে। এই সংসদই একদিন আপনাদের
অপকর্মের বিচার করবে। সেইদিন আপনাদের অনুশোচনা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না”। তিনি
বলেন, “সাড়ে চার লাখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে বিনা বিচারে আটক রেখেছেন। তাদের উপর
নৃশংস নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিল তিল করে কারাগারে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা চিকিৎসায়
মারা হচ্ছে। এই পরিণতি একদিন আপনাদেরও হবে। তখন বুঝবেন, আজ কি ভুল করছেন”।
আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, “সংখ্যা
গরিষ্ঠতার বড়াই কইরেন না। ২০৭ একদিন ০৭ হয়ে যাবে। তখন বুঝবেন ‘গণতন্ত্র’ কতো
দরকার। আজ আমাদের কথা বলতে দেন না। হত্যা করেন, জেলে পুরেন। আজ যদি এই বিল পাশ
করেন তাহলে প্রতিহিংসার আগুনে আপনারাও পুড়বেন”।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ঠিক ত্রিশ বছর পর সেই এপ্রিলেই
বিএনপির সংসদে সদস্য সংখ্যা ৭ জনও না, মাত্র ৫ জন। তাদের খুঁজতে সত্যি ‘দুরবীন’
লাগে।
যে প্রতিহিংসার সূচনা জিয়াউর রহমান করেছিলেন, মাত্র দুই বছরের
মাথায় সেই প্রতিহিংসার আগুনে তিনি নিজেই পুড়ে ছারখার হন। এখন পুড়ছে তার স্ত্রী,
সন্তান ও তার দল।
উল্লেখ্য সংবিধানের ৫ম সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী বিধায় ২০১০
সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল ঘোষণা করে।
অতএব,
‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না’ কথাটা রাজনৈতিক বোল মনে হলেও, তা
যে হারেহারে সত্যি হয় তার প্রমাণ বর্তমানে জাজ্বল্যমান।