ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত তারকাগণ (পর্ব-২)-সাগর সেন

 

কৈফিয়ৎঃ “এই লেখায় শিল্পীর শ্রেণী, মান এবং সময়কালের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবেনা বলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”।


সাগর সেন

সাগর সেন


সাগর সেন(১৫ মে ১৯৩২-০৪ জানুয়ারি ১৯৮৩):  ছিলেন বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের উল্লেখযোগ্য শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলা আধুনিক গানও গেয়েছেন এবং পরিচালনা করেছেন তিনি।

 

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

সাগর সেনের জন্ম ১৫ মে ১৯৩২ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ফরিদপুর - অধুনা রাজবাড়ী জেলার বানিবহ গ্রামে। এই গ্রামে অন্তত: সাতটি জমিদারের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। তার মধ্যে রায় বাহাদুর কামিনী কুমার রায় ছিলেন সাত আনার জমিদার। কামিনী কুমার জমিদারের পরবর্তী বংশ ছিলেন বিপিন বিহারী মুন্সি। বিপিন বিহারী মুন্সির সন্তান ছিলেন বিজন বিহারী সেন। যাকে নিয়ে এই নিবন্ধ সেই সাগর সেন এই বিজনবিহারি সেনের কনিষ্ঠ পুত্র। 


রাজবাড়ী  জেলার প্রখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন সাগর সেন। অনেকেরই ধারণা তাঁর জন্ম বরানগরে  কোলকাতার মামার বাড়িতে। কিন্তু তা সঠিক নয়। 


তার পিতার নাম বিজনবিহারী সেন ও মাতা নয়নমঞ্জরী সেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্তমানের বাংলাদেশে। তবে দেশভাগের পর তারা সপরিবারে চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতার বরানগরে বসবাস শুরু করেন।


তার স্কুলের পাঠ কলকাতার তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। এরপর কলেজের পাঠ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি কলকাতাতেই। তাঁর জীবিকা বলতে মুখ্যত ছিল গান। এছাড়া কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গীত শিক্ষক রূপে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। 

 

সঙ্গীত জীবন

সাগর সেন প্রধানত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৯৫৮ সালে আকাশবাণীতে তার গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রথম রেকডিং হয়।

তিনি সন্তোষ সেনগুপ্ত পরিচালিত রবীন্দ্র গীতিনাট্য 'শাপমোচন' (১৯৬৬) এবং 'বাল্মীকি প্রতিভা' (১৯৬৭)য় কণ্ঠদান করেন। ১৯৬৮ সালে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য 'মায়ার খেলা'য় তার গাওয়া 'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান' তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের খ্যাতনামা শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়।

 

স্বকীয় উপস্থাপনা শৈলীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন তার সুললিত দরাজ কন্ঠের মাধ্যমে। সহজিয়া রীতিতে এবং আবেগাপ্লুত গায়কিতে তার নিবেদিত সঙ্গীতের মূর্ছনা শ্রোতাদের বিভোর করে।

 

পরবর্তী সত্তর ও আশির দশকে তৎকালীন ‘গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া’ (বর্তমানের সারেগামা ইন্ডিয়া) থেকে তার সঙ্গীতের বহু রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৭৪ সালে 'পূজা' পর্যায়ের সাতটি ও 'প্রেম' পর্যায়ে সাতটি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে স্টেরিয়োফনিক লং প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয় তার। শতাধিক গানের রেকর্ড আছে সাগর সেনের।  

 

"রবিরশ্মি" সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় স্থাপন করেন নিজস্ব সঙ্গীত বিদ্যালয় "রবিরশ্মি"। তার অভিভাবকত্বে 'রবিরশ্মি'র ছাত্র ছাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্র সদনে, শিশির মঞ্চে, কলামন্দিরে 'শ্রাবণসন্ধ্যা', 'শাপমোচন', 'ঋতুরঙ্গ', 'স্বদেশী নায়ে বিদেশী খেয়া', 'বিশ্বজন মোহিছে' নামীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন। এই অনুষ্ঠানগুলিতে তিনি নিজে এমনকি খ্যাতনামা সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, বাণী ঠাকুর প্রমুখেরা অংশ নিতেন।

 

কলকাতা দূরদর্শণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে কলকাতা দূরদর্শনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশনার সম্মান পান তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেন। দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘আজি এ আনন্দসন্ধ্যা’। সাগর সেন এককভাবে পরিবেশন করেছিলেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ ও ‘বিশ্বভরা প্রাণ’ গান দুটি।

 

বিদেশে সঙ্গীত পরিবেশন

১৯৬২ সালে বার্মায়, বাংলাদেশে তিন বার এবং ১৯৭৬ সালে টেগোর মিউজিক সোসাইটির আমন্ত্রণে কানাডা, আমেরিকা ও সুইজারল্যান্ড গিয়েছেন তিনি। সাগর সেনের প্রকৃতিদত্ত বলিষ্ঠ-উদার-ভাবময় কণ্ঠ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। বলতে গেলে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকখানি শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে তার কণ্ঠ বেয়ে। ভারত, বাংলাদেশ মিলিয়ে দেশে-বিদেশে অসংখ্য অনুরাগী আছে তার।

 

আধুনিক বাংলা গান ও নেপথ্যকণ্ঠদানে

বাংলা চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। 'পরিচয়' চলচ্চিত্রে 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে' গানটির জন্য ১৯৭৯ সালের নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে ‘বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি’ পুরস্কার লাভ করেন। তবে আধুনিক বাংলা গান অল্প কয়েকটি গেয়েছেন তিনি।

 

পারিবারিক জীবন

সাগর সেন ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সুমিত্রা সেনকে বিয়ে করেন। তাদের তিন পুত্র সন্তান। এরা হলেন- প্রিয়ম সেন, প্রিতম সেন ও প্রমিত সেন। প্রমিত সেন একজন সঙ্গীত শিল্পী এবং অবিকল বাবার মতোই কণ্ঠ।

 

জীবনাবসান

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে তার ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। তবুও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমানভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে গেছেন তিনি। ১৯৮৩ সালের ০৪ জানুয়ারি মাত্র ৫১ বৎসর বয়সে মারা যান এই গুণী সঙ্গীত শিল্পী।

 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url