পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে একটি মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ করে হিন্দু পরিবার
আমানতি মসজিদ
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত শহরে অবস্থিত ‘আমানতি মসজিদ’। মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে একটি হিন্দু পরিবার। ফলে আশপাশের মুসলমানরা এখানে নামাজ আদায় করলেও এর পরিচিতি ‘বোস বাড়ির মসজিদ’ হিসেবে।
তিন শতাধিক বছরের পুরনো
এই মসজিদটি গত প্রায় ৬ দশক ধরে দেখভাল করছেন স্থানীয় বসু পরিবারের সদস্যরা। তাদের
জমিতেই রয়েছে এই মসজিদ। বর্তমানে বসু পরিবারের পক্ষে মসজিদটি দেখভাল করেন
পার্থসারথি বসু ও তার পরিবার।
১৯৬০ সালের কথা। সে সময়ের
বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ওই জমি পায় বসু পরিবার। এরপর থেকে বংশপরম্পরায় দাদা-দাদির
কথা মেনে তারা মসজিদটি দেখাশোনা করে আসছে।
জানা যায়, নবপল্লীর
প্রতাপাদিত্য রোডের তৎকালীন বাসিন্দা ওয়াজুদ্দিন মোড়লের কাছ থেকে বিনিময়ের মাধ্যমে
ওই জমি পায় দুইভাই- নীরদ কৃষ্ণ বসু ও বিনোদ বিহারী বসু। বিনিময় প্রথার প্রক্রিয়া
হিসাবে ওয়াজুদ্দিন বাংলাদেশে (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) বসু পরিবারের জমি পান। ওই
জমিতেই ভেঙেচুড়ে যাওয়া একটি ঘরের হদিস পায় বসু পরিবার। সেই ঘরের আকৃতি দেখে পার্থ সারথির নানার মনে হয়
এটি মসজিদ। এরপরই বাংলাদেশে ওয়াজুদ্দিন পরিবারের সাথে কথা বলেন তিনি। ওয়াজুদ্দিন
জানান, মসজিদ ভেঙে ফেলা বা রেখে দেওয়া তাদের মর্জি। কিন্তু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী
পার্থ সারথির নানা সে সময় মসজিদটি না ভেঙ্গে তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হাতে তুলে
নেন। নানার নির্দেশেই গত কয়েক দশক ধরে তারা মসজিদটি দেখভাল করে আসছে।
ওই এলাকায় একটিও মুসলিম
পরিবারের বসবাস নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মসজিদে আগত মুসলিমদের ভালবাসা, সম্মান,
শ্রদ্ধা প্রদানে এলাকার স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বী মানুষদের কোনো কৃপনতা নেই।
‘আমানতি মসজিদ’
আমানত শব্দের অর্থ কারো
কাছে কিছু গচ্ছিত রাখা। সেই আমানত রক্ষা করে চলেছেন মধ্যবয়সী পার্থসারথি বসু ও তার
পরিবার। তবে কেবলমাত্র মসজিদের দেখভালই করেন না তিনি। রমজান মাসে প্রায় শতাধিক
রোজাদার মুসলমানের সাথে ইফতারেও শামিল হন। তার মতে, রাজনীতিবিদরা শুধু মুখেই
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বুলি আওড়ান। কিন্তু বাস্তববে সম্প্রীতির ছবি দেখতে গেলে
তাদের এই এলাকায় আসতে হবে। আমৃত্যু এই মসজিদকে বাঁচিয়ে রাখতে চান বলেও জানান পার্থ
সারথি বসু।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন
‘নিজের তিন বছর বয়সে মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হয় তার। সে সময় চিকিৎসকরা পার্থের
বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন, তাদের সন্তানকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। তখন আমার মা আমাকে এই
মসজিদে রেখে যায়। এরপর আমাদের গুরুদেব আবু বক্কর সিদ্দিকী আমার মুখে পানি, তেল
দিয়ে সেবা শুশ্রষা করেন। তার দশ মিনিট পর থেকে আমি ধীরে ধীরে সুস্থ বোধ করতে থাকি।
তাই নিজের প্রাণ থাকতে ওই মসজিদ রক্ষা করাটা আমার স্বপ্ন।
মসজিদের ইমাম মাওলানা
আখতার জানান, ‘বসু পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কোনোদিনই মনে
হয়নি তারা একে অপরে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী’। মানবিকতা, ভালোবাসা, শান্তি ও
সম্প্রীতি দেশের ঐতিহ্য। আর এখান থেকেই প্রতিদিন তা প্রস্ফুটিত হয়।