রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-১৮)
রাজা সূর্য কুমার
আর এস কে ইন্সটিউশন |
রাজা সূর্য কুমার ছিলের বাংলাদেশের রাজবাড়ী অঞ্চলের একজন জমিদার। তার নামানুসারে রাজবাড়ীর নামকরণ করা হয়। তার পিতামহ প্রভুরাম
নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজকর্মী ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে
সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর তিনি রাজবাড়ীর লক্ষ্মীকোলে এসে আত্মগোপন করেন। পরে তার
পুত্র দ্বিগেন্দ্র প্রসাদ এই অঞ্চলে জমিদারি গড়ে তোলেন। দ্বিগেন্দ্র প্রসাদের
পুত্র রাজা সূর্যকুমার ১৮৮৫ সালে জনহিতকর কাজের জন্য রাজা উপাধি পান।
সূর্যকুমারের কাশিমনগর পরগনার পদ্মার
তীরবর্তী অঞ্চল (পদ্মা তখন লক্ষ্মীকোল থেকে ৬ মাইল অর্থাৎ প্রায় ১০ কিলোমিটার
উত্তর দিয়ে প্রবহমান ছিলো), সূর্যনগর, দিনাজপুর, ভুবনেশ্বর, কলিকাতা, কাবিলপুর
পরগনায় জমিদারী ছিল।
প্রাথমিক জীবন
লক্ষীকোল এস্টেটের উত্তরাধিকারী জমিদার
দ্বিগেন্দ্র প্রসাদ গুহ রায়ের কোনো সন্তান না থাকায় অনুমান ১৮৪০ এর দশকের শেষে
সূর্য কুমারকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।
লক্ষ্মীকোল গ্রামে রাজা সূর্য কুমার
রায়ের বসতবাড়ি ছিলো। বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী সূর্য কুমার
গুহরায় ছিলেন দরদী ও প্রজাপ্রেমী। তিনি সমাজসচেতন পাঠাগার, রাস্তাঘাট, পোস্ট
অফিস, মন্দির নির্মাণ করেছেন। তার আশ্রয়ে লালিত পালিত হয়েছে ছাত্র, আশ্রয়হীন
বালক, দরিদ্র ঘরের অসহায় সস্তান।
রাজার দুই রাণী ছিলো। কোনো রাণীরই
সন্তান না থাকায় রাজা যেনো সকলের সন্তানকে আপন সন্তান ভাবতেন। নিজের শ্যালকদের
পুত্রবৎ স্নেহে স্বগৃহে আশ্রয় দিয়ে পালন করেছেন।
রাজা উপাধি
জনশ্রুতি অনুযায়ী রাজা সূর্যকুমার
একজন তেজন্বী অথচ কোমল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রতাপশালী বৃটিশ রাজের
কাছে তিনি মাথা নোয়াবার পাত্র ছিলেন না। স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনে তিনি পরোক্ষ
পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। জাতীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। একবার বড়লাট অত্র
এলাকার সকলকে বলছিলেন “তিনি একজন রাজা বটে”! অনেকে মনে করেন সেই ঘটনা থেকে রাজা
বলে পরিচিত। কিন্ত ব্যাপারটা এমন নয়। সূর্য কূমারের ব্যক্তিত্ব, জনহিতকর কাজ,
শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং প্রজাপ্রেমের জন্য ১৮৮০'র দশকে করোনেশনের মাধ্যমে তাকে
'রাজা' উপাধি দেওয়া হয়।
বর্তমান
অবস্থা
বর্তমানে তাঁর বাড়িটির অস্তিত্ব নেই।
শুধু তিনটি পুকুর আছে। একটি রাজার পুকুর, একটি রণীর পুকুর ও আরেকটি বড় পুকুর নামে
পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে পুকুরগুলো খাস হয়ে যায়। এরপর থেকে তা সরকারিভাবে
দেখভাল করা হতো। পুকুরপাড়ের বটগাছতলায় মেলা বসতো। তবে বছর দশেক ধরে মেলার আয়োজন
করা হচ্ছে না। রাজার উত্তরসূরিরা কেউ এখন আর রাজবাড়ীতে থাকেন না। গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের
শুরুতে রাজার বাড়ির পুকুরটির পাশে ‘কালেক্টর দিঘি’ নাম দিয়ে সাইনবোর্ড টানানো
হয়েছে। তবে পুকুরটির সঙ্গে ঐতিহ্য ও রাজার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায় পুকুরটির নাম
পরিবর্তনের বিষয়ে স্থানীয়রা আপত্তি জানিয়ে নামটি অপরিবর্তিত রাখার দাবি
জানিয়েছে।
রাজবাড়ীর পুকুর |
রাজা সূর্য কুমার
সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি
তৎকালীন জমিদারের শোষণ, অত্যাচারের নানা কাহিনী ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু
প্রতাপশালী রাজা সূর্য কুমারের এরূপ কোনো ঘটনা রাজবাডীর কোনো মানুষের মুখে শোনা যায়
না।
প্রবীনদের মুখে শোনা যায়, দ্বিগেন্দ্র প্রসাদ দত্তক গ্রহণে সূর্যনগরের
নিকবর্তী কোনো গ্রামে (মতভেদে চরনারায়ণপুর) পালকি প্রেরণ করেন। সুর্য কুমারেরা ছিলেন
দুই ভ্রাতা। দৈহিককান্তির যে ছেলেটিকে দত্তক নেয়ার কথা ছিলো সে পালকিতে চড়ে না। শীর্ণকায়
ভাইটি পালকিতে ওঠে। এই ভাইটিই সূর্য কুমার।
দ্বিগেন্দ্র প্রসাদের মৃত্যুর পর সূর্য কুমার এস্টেটের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত
হন। প্রথম অবস্থায় লক্ষ্মীকোল, বিনোদপুর মৌজা এবং লক্ষ্মীকোলের উত্তর পূর্বে কাশিমনগর
পরগনার পদ্মা তীরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে লক্ষ্মীকোল এস্টেটের বিস্তৃতি ছিলো। উল্লেখ্য,
রাজা সূর্যকুমারের মৃত্যুর পর লক্ষ্মীকোল এস্টেট তেঁওতার রাজার সাথে মামলায় জড়িয়ে পড়ে।
রাজা সূর্য কুমারের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ। রাজা, রাণী, রাজার বাড়ী,
লক্ষ্মীকোল এস্টেটের অনেক কাহিনী ও ঘটনার সাক্ষী ত্রৈলোক্যনাথ। এর অনেক বিষয় তিনি
“আমার স্মৃতিকথা" গ্রন্থে লিখেছেন। ত্রৈলোক্যনাথ তার বইয়ে লিখেছেন, "আমি
যখন এই বিল্ডিং এর কাজে হাত দিলাম (১৯১৪) ঠিক সেই সময়ে লক্ষ্মীকোল এস্টেট একটি বড় রকমের
মোকদ্দমায় জড়িত হইয়া পড়ে। পদ্মার চর লইয়া তেঁওতার জমিদারদের সঙ্গে মামলার জন্য স্টেট
হইতে টাকা দিয়া বিল্ডিং শেষ করা সম্ভব হয় নাই। (আমার স্মৃতিকথা-ত্রৈলোক্যনাথ-পৃষ্ঠা-২৬)”।
এ সকল জমিদারী থেকে লক্ষ্মীকোল এস্টেটের বাৎসরিক আয় তখনকার দিনে ছিলো
প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।
রাজপ্রাসাদ ও রাজার বাড়ীর নাম ছিলো দেশখ্যাত। প্রায় ৬০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত
প্রাসাদ, অতিথিশালা, পোস্ট অফিস, আঙিনা, বাগানবাড়ী, শান বাধানো পুকুর ঘাট, টোল, বৈঠকখানা,
অফিস কর্মচারী, পাইক পেয়াদা, গোশালা, আস্তাবল নিয়ে রাজার বাড়ী ছিলো জমজমাট।
এ ছাড়াও রাজা কলিকাতায় বাসস্থান নির্মাণ করেন। দুই রাণীর কোনো রাণীরই
সন্তানাদি না থাকায় রাজা ১৮৯০ এর দশকের শুরুতে নরেন্দ্রনাথকে প্রথমে দত্তক পুত্র হিসেবে
গ্রহণ করেন। নরেন্দ্রনাথ মেট্রোপলিটান কলেজিয়েট স্কুলে পড়ালেখা করতেন এবং ক্লাসে প্রথম
স্থান অধিকার করতেন। কিন্তু সহসাই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে নরেন্দ্রনাথ মারা যান। এর
পূর্বে রাজার এক শ্যালক হীরালাল যাকে রাজা পুত্রবৎ স্নেহ করতেন তিনিও রাজবাড়ীতে দুর্ঘটনায়
মারা যান। স্নেহপ্রবণ রাজা শ্যালক ও পুত্রের অকাল মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে পুরিধামে গমন
করেন এবং পুরিতে ষাট হাজার টাকা ব্যয়ে সমুদ্র তীরে বাড়ী নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন।
রাজা এই বাড়ীর নাম রাখেন ‘নরেন্দ্র কুটির’। পুত্রের স্মৃতি রক্ষার্থেই এ নামকরণ করা
হয়। অবশ্য রাজার মৃত্যুর পর এ বাড়ীর নাম দেওয়া হয় ‘ভিষ্টোরিয়া ক্লাব’। রাজা ভূবেনেশ্বরেও
একখানি বাড়ী তৈরি করেন এবং সেখানে অনেক ভূ-সম্পত্তি করেন।
পারিবারিক জীবন
রাজা সূর্য কুমার ১৮৬০ দশকের মাঝামাঝি বরিশালের গাভা নিবাসি উমাচরণ ঘোষ
দস্তিদারের কন্যা ক্ষীরোদ রানীকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় রাজা দুই শ্যালক হীরালাল ও মতিলালকে
সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পুত্রবৎ তাদের লালন পালন করেন। ১৭-১৮ বছর দাম্পত্য জীবনে ক্ষীরোদ
রাণীর গর্ভে সন্তানাদি জন্মায় না। রাণীর পরামর্শে রাজা লক্ষ্মীকোলের নিকটবর্তী ভবদিয়ায়
বসবাসরত কুচবিহারের মোক্তার অভয়চরণ মজুমদারের কন্যা শরৎ সুন্দরীকে বিয়ে করেন। এ ঘরেও
কোনো সন্তানাদি জন্মায় না। অনুমান ১৮৯১ সালে রাজা স্ত্রীদের পরামর্শে রাজবাড়ীতেই নরেন্দ্রনাথকে
পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন। এ সময় ত্রৈলোক্যনাথ রাজার বাড়ীতে সূর্যকূমার ইনস্টিটিউশনে লেখাপড়া
করতেন। রাজার দুই শ্যালক, ত্রৈলোক্যনাথ এবং পোষ্যপুত্র নরেন্দ্র একসাথে চলাফেরা করতেন।
বিশেষ করে রাজার শ্যালকদের সাথে ত্রৈলোক্যনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এ সময় একটি দুর্ঘটনাঘটে।
ত্রৈলোক্যনাথের কথায়-
“এ সময় রাজবাড়ীতে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পুত্রেষ্টি উপলক্ষে রাজবাড়ীতে খুব
ধুমধাম হয়। যাত্রা, থিয়েটার, বাজী পোড়ানো ইত্যাদিতে বহু অর্থ ব্যয় হয়। বাহির আঙ্গিনায়
বৃহৎ মঞ্চ তৈয়ারী হইতেছে, মঞ্চ বাঁধিতে অন্যসব লোকের সঙ্গে রাজার শ্যালক হীরালালও মঞ্চে
গিয়া ওঠে এবং হঠাৎ পড়িয়া গিয়া প্রাণ হারায়। যাহা হউক, উৎসব নিরানন্দের মধ্যে কোনো রকমে
শেষ হইয়া গেলো বটে, কিন্তু রাজা এই ধাক্কা সহ্য করিতে পারিলেন না। দেশত্যাগী হইয়া কলিকাতাবাসী
হইলেন। রাজা তখন স্বপরিবারে কলিকাতাবাসী হইলেও রাজবাড়ীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় না।
নরেন্দ্রের মৃত্যুর পর রাজা পুরিধামে বসবাস করতে থাকেন এবং পুনরায় দত্তক গ্রহণের ইচ্ছা
প্রকাশ করেন। রাজা ও দুই রাণীসহ রাজা শ্রীমান সৌরেন্দ্র মোহনকে দত্তক গ্রহণ করেন। এ
উৎসব পুরিধামে নিজ বাড়ীতে সম্পন্ন হয়। (‘আমার স্মৃতিকথা’ ত্রৈলোক্যনাথ- পৃ-১১)।
যথা সময়ে সৌরেন্দ্র মোহন সাবালক হলে লক্ষ্মীকোল এস্টেটের উত্তরাধিকারী
হন। রাজা সূর্য কুমারের অমর কীর্তির মধ্যে লক্ষ্মীকোলে সুদৃশ্য প্রাসাদ নির্মাণ, লাইব্রেরি
প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল নির্মাণ, লক্ষ্মীকোল পোস্ট অফিস স্থাপন, রাজা সূর্যকূমার ইনস্টিটিউশন
(হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠা, নিজ জমিদারী সূর্যনগরে রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠা অন্যতম কাজ।
লক্ষ্মীকোল রাজার বাড়ী ছিলো ঐতিহ্যের ধারক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে
রাজবাড়ী দর্শনে আসতো। দেশের দর্শনীয় ঐতিহ্য হিসেবে পরিগণিত হতো। স্বাধীনতার পর লক্ষীকোল
রাজবাড়ীর ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে রাজবাড়ী একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রটি কয়েক
বার টিভি পর্দায় দেখানো হয়েছে।
রাজার বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বলতে বর্তমানে কিছুই নেই। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে একটি বটবৃক্ষ। শান বাঁধানো পুকুরটি ভরাট হলেও পুকুরের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।
প্রতি বছর এখানে নববর্ষের আগমনে বৈশাখী মেলা বসে। তবে ১৮৮৮ সালে তার হাতে গড়া রাজা
সূর্য কুমার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউশন তার স্মৃতি বহন করছে।
রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ ও পুকুর |
রাজা সূর্যকুমার আমোদপ্রবণ ও রসিক প্রকৃতির ছিলেন। তার সময়েই লক্ষ্মীকোল
মেলা জেলার ঐতিহ্যবাহী মেলায় পরিণত হয়। রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান
হতো। বসতো সঙ্গীত, যাত্রা ও পালাগানের আসর। রাজার বাড়ীর অন্দর মহলের আনন্দ উচ্ছাস বিষয়ে
ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন-
“রাত্রে রাজবাড়ীর চেহারা বদলাইয়া যইতো। বৈঠকখানায় গান, বাজনা, আমোদ প্রমোদ
-মদ পর্যন্ত চলিতো”। রাজা মদ খাইতেন কোনো কোনো দিন নামমাত্র। তবে বন্ধুদের যোগাইতেন
প্রচুর। বড় মা (বড় রাণী) আমাকে একদিন বলিলেন, ‘তুমি নায়েব মশাইকে বলো, চাকর গিয়া টাকা
চাহিলেও যেনো না দেন। বলিবে আমার হুকুম’। আমি বলিলাম, কিন্তু রাজা যদি আমাকে ঘাড় ধরিয়া
বাহির করিয়া দেন তখন? বটে! তাহা আমি বুঝিবো, তুমি যাও। আমি তাহার আদেশ পালন করিলাম।
রাজা আমাদের ষড়যন্ত্র টের পাইলেন। তবে আমাকে কিছু বলিলেন না। বরং তখন হইতে আমাকে অধিকতর
স্নেহ করিতে লাগিলেন। তার কিছু দিন পর অনুমান ১৮৯১ নরেন্দ্রনাথকে পোষ্যপুত্র লওয়া হইল
তখন রাজবাড়ী হইতে মদ'তো উঠিয়া গেলোই; বাদ্যযন্ত্র সব, পাখোয়াজ, তবলা, বেহালা প্রভৃতি
বন্ধুবান্ধবদিগের মধ্যে বিলাইয়া দিলেন, বলিলেন- এসব থাকিলে ছেলে নষ্ট হইবে-তার লেখাপড়া
কিছু হইবে না (আমার স্মৃতিকথা পৃষ্ঠা-৯)”।
পারিবারিক স্নেহ মমতায় আবিষ্ট রাজা ছিলেন অত্যন্ত কৌতুক প্রিয় এবং গভীর
জ্ঞানের অধিকারী। আমাদের দেশে এখনো নতুন ঘর বা পাকা বাড়ী নির্মাণের সময় সাধারণতঃ দুই
চার কোপ মাটি কেটে মোনাজাত করা হয়। অনেক সময় গর্তের মধ্যে টাকা পয়সা ফেলা হয়। তখনকার
দিনে গর্তমধ্যে সোনা, রূপা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। রাজা আরএসকে স্কুলের মূল বিল্ডিংয়ের
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে সোনা আনা হয়েছিল, কিন্তু রূপা আনা হয় নাই। ত্রৈলোক্যনাথের
পকেটে দুই আনার রূপার মুদ্রা ছিলো। তিনি তা গর্তমধ্যে ফেললে রাজা হেসে বললেন; ‘বেশ
হইলো, এই স্কুল বিল্ডিং এর দুই আনা সত্ব হইলো তোমার। আমি বলিলাম, ‘এ হাতী পোষা রাজরাজাদেরই
খাটে- গরীব স্কুল মাস্টারের কাজ নয়’ (স্মৃতিকথা-২১)”।
আরেকদিনের কথা, স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য রাজা ঢাকা থেকে গ্রীনবোট এনে
বেলগাছি নিয়ে পদ্মা নদীতে অবস্থান করছিলেন। ত্রৈলোক্যনাথের কথায়-“আমি গিয়া বোটে উঠিলাম।
রাজা তখন নৌকায় বসিয়া ছিপ দিয়া মাছ ধরিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, ‘কী হে, ব্যাপার
কী’? ঠিক এ সময়ে ভারী ওজনের একটি কাতলা মাছ লাফ দিয়া নৌকা গর্ভে পড়িল। তিনি আনন্দিত
হইয়া বলিলেন- ‘তুমি তো আচ্ছা মৎস্যরাশির মানুষ? আমি এক ঘণ্টা বসিয়া আছি একটি মাছেও
টোপ গিলছে না, আর তুমি আসা মাত্র তোমাকে দেখিতে আসিলো।‘ (পৃষ্ঠা-১৭)”।
ত্রৈলোক্যনাথ গ্রীনবোটে রাজার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন একটা বিষয়ে পরামর্শ
করতে। ফরিদপুরের সেটেলমেন্ট অফিসার জ্যাক সাহেব (আইসিএস) গ্রাজুয়েটদের মধ্য থেকে কানুনগো
নিয়োগ করছেন। যারা এখন ঢুকবে তারা কানুগো কাজ শেষ হইলে সাব ডেপুটির কাজ পাবে। ত্রৈলোক্যনাথ
জ্যাক সাহেবের সাথে দেখা করে চাকরিতে যোগদানের জন্য সাত দিনের সময় নিয়ে এসেছেন। এখন
রাজার অনুমতি পেলে যোগদান করবেন।
ত্রৈলোক্যনাথের সব কথা শুনে রাজা বললেন, 'বেশ তো স্কুল ঘরে তালা লাগাইয়া
যাও। আমি স্কুল করিয়াছিলাম যখন রাজবাড়ীর চর্তুদিকে ২০ মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল ছিলো
না। একমাত্র ফরিদপুর জেলা স্কুল ছাড়া রাজবাড়ীতে মাত্র ঈশ্বর পন্ডিতের ছাত্রবৃত্তি স্কুল
ছিলো। তাহাও ভালোরূপ চলিতো না। আমি স্কুল করিবার ৫ বছর পর বাণীবহের বাবুরা স্কুল করিলেন
(গোয়ালন্দ হাইস্কুল)। তখন আর আমার স্কুল রাখিবার কী প্রয়োজন ছিলো? একমাত্র তোমার জন্যই
স্কুল রাখিয়াছিলাম। তুমি ডাকঘরে চাকরি পাইলে তাতে মন বসিলো না। আসিলে রাজবাডী স্কুলে-২৫০
টাকা ছাড়িয়া ৫০ টাকায়। এখন চাও মেঠো আমিনী করিতে। জ্যাক সাহেবের বাচচা -জল কাদা ভাঙ্গিয়া,
ঝড় বৃষ্টি মাথায় করিয়া বুট পায়ে ছুটিবে মাঠে ঘাটে। তোমাকেও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইতে হইবে।
পারিবে তাল সামলাইতে?' (পৃ-১৭১৮)”। এরপর ত্রৈলোক্যনাথ স্কুল ছেড়ে যাননি। সুদীর্ঘ ৪২
বছর উক্ত বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
রাজা বিদ্যান ছিলেন না কিন্তু বিদ্যার প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। গোয়ালন্দ
মহকুমার গভর্নমেন্ট সাহায্যকৃত হাইস্কুলটি পদ্মার ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হলে রাজবাড়ী
উঠে আসে এবং তৎকালীন ডিপিআইসিএ মার্টিন সাহেবের অনুরোধে রাজা সূর্যকুমার তার পরিচালনার
ভার গ্রহণ করেন। রাজা সূর্য কুমার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল সংলগ্ন স্থানে (বর্তমান এসপি
ও সিভিল সার্জন এর বাসা যে স্থানে এ স্থানটিতে সূর্যকুমার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ছিল।
পরে তা সিভিল সার্জনের অফিস ছিল।) স্থানান্তর করা হয়। কোনো কারণে বিদ্যালয়টি পরিচালনা
সম্ভব না হওয়ায় রাজা ১৮৮৮ সালে রাজা সূর্যকুমার ইনস্টিটিউশনটি (আরএসকে) প্রতিষ্ঠা করেন।
কেবল রাজবাড়ীর এতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরএসকে ইনস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতাই
নন, নিজ গৃহে গড়ে তোলেন লাইব্রেরি। রাজার মৃত্যুর পর শ্যালক মতিলাল জমিদারী দেখাশোনা
করতেন। তিনি কিছুটা অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। লাইব্রেরি বিষয়ে ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন-“একদিন
শুনিলাম মতিলাল রাজার লাইব্রেরিটি রাজবাড়ী উডহেড লাইব্রেরিকে দান করিয়া বসিয়াছেন-আলমারী
বুককেসসহ এবং এসডিও আর এস দাসকে কথা পর্যন্ত দিয়া ফেলিয়াছেন।
আমি সারা থেকে (ত্রৈলোক্যনাথ ১৯১৯ হইতে ১৯২৪ পর্যন্ত সারা স্কুলে ছিলেন)
ছুটিয়া আসিয়া এসডিও"র সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলাম, ‘এ লাইব্রেরিটি রাণীদের। তাহারা
বহু টাকা ব্যয় করিয়াছেন উহার পিছনে। তাহা্রা এখনো জীবিত। তাছাড়া আমরা এস্টেটের একজিকিউটর
মাত্র। এস্টেটের বা অন্যের সম্পত্তি দান করিবার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আপনি কিছু
মনে করিবেন না।' অতঃপর মতিকে বললেন, 'একি তোমার পৈত্রিক সম্পত্তি যে দান করিয়া বসেছিলে।'
(পৃষ্ঠা ৮০)? এরপর মতিলাল ঘোষ দস্তিদার কাবিলপুর পরগনা পরিদর্শন করতে যেয়ে জগন্নাথ
বেশ ধারণ করেন। প্রকৃতপক্ষে তার মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে (১৯২২)”।
পূর্বেই বলা হয়েছে রাজা ভুবেনশ্বরে একখানি বাড়ী এবং ভূ-সম্পত্তি করেন।
রাণীদের নিয়ে রাজা শেষজীবন ভূবনেশ্বরেই কাটান। অনুমান ১৯১২ সালে রাজা ভূবনেশ্বরে দেহত্যাগ
করেন। সেখানেই রাজার শ্রাদ্ধাদি এবং পারলৌকিক কার্যাদি সম্পন্ন হয়। রাজার শ্রাদ্ধতে
এক হাজার ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হন। পান্ডাদের সাহায্যে এবং নিমন্ত্রিত অতিথিদের ভোজন
ও দক্ষিণা দ্বারা আপ্যায়িত ও পরিতুষ্ট করা হয়। পূর্ব হইতেই রাজাকে যেখানে দাহ করা হয়
সেখানে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার সংকল্প ছিলো এবং যথাসময়ে রাজার প্রথম পক্ষের শ্যালক এবং
দ্বিতীয় পক্ষের সম্পর্কীয় শ্যালক অধিকাচরণ মজুমদার (ফরিদপুর) এবং ত্রৈলোক্যনাথ এর সহযোগিতায়
শিবমন্দির নির্মাণ করা হয়। শিবমন্দির নির্মাণ করতে অনেক টাকা কড়ি খরচ হয় যা রাজবাড়ীর
জমিদারী থেকে লওয়া হয়।
মৃত্যুর পূর্বে রাজা উইল রেখে যান। উক্ত উইলে রাজার দুই রাণী, শ্যালক
মতিলাল ঘোষ এবং ত্রৈলোক্যনাথকে এস্টেটের একজিকিউটর নিযুক্ত করেন। উইলে আরো একটি শর্ত
ছিলো, রাজার জীবনান্তে মতিলাল ও তার স্ত্রী পুত্রগণ (সাবালক না হওয়া পর্যন্ত) মাসোহারা
পাইবেন। কুমারের (সৌরেন্দ্র) তখন সাবালক হওয়ার এক বছর বাকি ছিলো। এরমধ্যে মতিলাল জমিদারী
দেখাশোনা করলেও তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। ত্রৈলোক্যনাথ তখন ফরিদপুরের ডিএস-জেএ
উডহেড (আইসিএস) এবং উকিল অশ্বিকাচরণ মজুমদারের সাথে আলাপ করে সৌরেন্দ্র মোহনের হাতে
স্টেটের ভার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এতে ডিএস সম্মত হন। সৌরেন্দ্র মোহনকে স্টেটের
ভার বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে অপ্রকৃতস্থ মতিলালকে এক রকম জোর করে বরিশালে নেওয়া হয়।
সে খুব কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকে। অপ্রকৃতস্থ হলেও মতিলাল রাজবাড়ী এসে উকিলের
সাহায্যে উইলের শর্ত ধরে কুমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ
মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সৌরেন্দ্র মোহন এস্টেটের মালিক হয়ে জমিদারী পরিচালনা
করেন।
বর্তমানে রাজার বাড়ীর কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাজার
পালক ছেলেরা সমস্ত জমি বিক্রি করে দেন। রাজার বাড়ী ও মন্দিরের পাশে বর্তমানে রয়েছে
আল্লা নেওয়াজ খায়রু একাডেমী। রয়েছে ২টি পুকুর ও রাজার স্মৃতি চিহ্ন একটি বড় আকারের
বট গাছ। যদিও একটি পুকুর রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায় আরেকটি রয়েছে, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের
অধিনে “কালেক্টরেট দীঘি” নামে। আর এ দীঘিটার তীরেই রয়েছে ওই বট গাছটি।
(তথ্য সূত্র – ‘রাজবাড়ী
জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’- লেখক : প্রফেসর মতিয়র রহমান এবং স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা।
মাধ্যমঃ “আগামী নিউজ” এবং ইন্টারনেট)।