৯০ বছর বয়সে উদ্যোক্তা চন্ডীগড়ের হরভজন কাউর
হরভজন কাউর |
‘সারাজীবন সংসার
সামলিয়ে ৯৪ বছর বয়সে পরিশ্রম করে নিজের জন্য উপার্জন করছেন হরভজন কাউর- শুধুমাত্র
আত্মসম্মানের জন্য। আর আমাদের দেশে সামর্থবান মেয়ে-পুরুষ রাস্তায় হেঁটে যেতে যতে হঠাৎ
নির্লজ্জের মতো হাত বাড়িয়ে দেয় পথচারীর দিকে।
গতবছর রোজার মাসে এক
মহিলাকে দেখেছি। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে মোড়ানো – চোখও দেখা যায় না; অর্থাৎ
‘ক্যামোফ্লেজ’ করা যাতে পরিচিত কেউ দেখলেও চিনতে না পারে। তার সাথে তার মেয়ে অথবা
নাতনিকে দেখে গরীব ঘরের সন্তান বলে মনে হয়নি। কাপড়ে মুড়িয়ে থাকা সত্বেও তার
অভিব্যাক্তি যতোটুকু প্রকাশ পাচ্ছিলো, তাকেও অসহায় বলে মনে হচ্ছিলো না।
মালিবাগ রেলগেটের কাছে সাদা দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবী-টুপি পরা শক্ত-সামর্থ
একজনকে দেখতাম, সিগন্যালে গাড়ি আটকে গেলে গাড়ির গ্লাসে টোকা মেরে ভিক্ষা আদায়
করতে। একদিন সামনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করলামঃ আপনার বয়স কতো? বললো ৫৫। বললাম, খুব
আরাম তাই না? ব্যাটা রেগেমেগে অন্যদিকে হাঁটা দিলো।
আমি সেজন্যে
রাস্তা-ঘাটে নিতান্ত অসহায় মনে না হলে ভিক্ষা দেই না। বরং সেই টাকা গরীব আত্মীয়স্বজনকে
দেয়া ভালো’।
কীভাবে ৯০ বছর বয়সী হরভজন কাউর তার বাড়িতে তৈরি বরফি দিয়ে উদ্যোক্তা
হয়ে উঠলেন-
ভারতের চণ্ডীগড়ের ৯৫ বছর
বয়সী একজন মহিলা হরভজন কাউর যিনি ৯০ বছর বয়সে পৌঁছেও উপার্জনের চিন্তা করেন।
"সাফল্য এবং খ্যাতি
অর্জনের জন্য বয়সের কোনো সীমা নেই। আমরা সকলেই অনেক অনুপ্রেরণামূলক নেতা এবং জনপ্রিয়
আইকনদের বক্তৃতায় প্রায়শঃই এ বিষয়ে কথা বলতে
শুনি। আপনি হয়তো ৪০ বা ৫০ বছর বয়সেও কিছু শুরু করতে পারেন এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছতে
পারেন। কিন্তু আপনি কি ৯০ বছর বয়সে এমন কাউকে দেখেছেন”? তা করে দেখিয়েছে চণ্ডীগড়ের
বাসিন্দা হরভজন কাউর"।
৯০ বছর বয়সে পৌঁছে তার প্রথম
উপার্জন ২০০০ রুপি। ২০২২ সালে “হিউম্যানস অফ বম্বে”-এর সাথে তার উপার্জনের গল্প শেয়ার
করতে গিয়ে ৯৪ বছর বয়সী মিসেস হরভজন কাউর বলেনঃ
“আমার বয়স
যখন ৯০ বছর তখন মনে মনে ভাবলাম, 'এতো বয়স হয়েছে, নিজে কোনোদিন টাকা রোজগার করিনি। এখন যখন নিরিবিলি বসে আছি দেখি না একটু চেষ্টা করে।
আমার সারাটা জীবনই কেটেছে
ঘর আর পরিবার সামলাতে। যখন আমার বাচ্চারা স্কুলে থাকতো, আর স্বামী কাজে যেতো, তখন
আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে নতুন নতুন রেসিপি চেষ্টা করতাম। কারণ আমি রান্না করতে
ভালোবাসতাম। অথচ যখন আমার বয়স ৮৪ ততোদিনে আমার সন্তানরা দূরে চলে গেছে। আমার
স্বামীও মারা গেছে। আমি একাকীত্ব অনুভব করতে শুরু করছিলাম।
আমি মেয়ের সাথে থাকতে
শুরু করলাম। কিন্তু আমার একাকীত্ব ঘোচাতে মেয়েকে বললাম, 'আমার কিছু একটা করতে হবে,
নিজের জন্য'। মেয়ে হেসে বললো, 'মা, তুমি কাছের বাজারে তোমার বরফি আর আচার বিক্রি
করতে পারো'।
আমার বাচ্চারা ওগুলো
খুব পছন্দ করতো। তাই আমার মনে হলো, এটাতো দারুণ আইডিয়া! বাজারের মালিকও সাথে সাথেই
আমার কথায় রাজি হয়ে গেলো। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যেই আমার দোকান বসে গেলো।
প্রথম দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সবকিছু বিক্রিও হয়ে গেলো! ওইদিনই আমি প্রথম অর্থ
উপার্জন করলাম।
আট বাক্স বরফি বিক্রি
করে ২০০০ রুপি আয়। আমার দু’চোখ তখন জলে ভরে গেছে... আমি নিজে প্রথম উপার্জন করেছি
এবং তাও ৯০ বছর বয়সে! আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হলাম যখন একটি কমবয়সী মেয়ে আমাকে বললো,
'নানী, আপনি আমাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন'। কথাটা শুনে আমি একছুটে বাসায় চলে
গেলাম এবং নতুন রেসিপি চেষ্টা করতে লাগলাম! ওইরকম উত্তেজনা আমি বহুদিন অনুভব করিনি!
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই
গোটা শহর আমার বরফির কথা জেনে গেলো। আমার বরফি নাকি তাদের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে
দেয়। তাই আমার নাতনি বরফির বাক্স তৈরি করে দিলো যার উপর লেখা ছিলো, “হরভজন”- ‘ভালোবাসা
দিয়ে বানানো, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়।'
বর্ষসেরা উদ্যোক্তার পুরস্কারও জিতেছেন মিসেস হরভজন কাউর
এরপর থেকে সবকিছু খুব
দ্রুত ঘটে যেতে লাগলো। এমনকি পত্রিকাও তখন আমাকে নিয়ে লিখতে শুরু করে দিয়েছে। পাঁচ
মাস আগে আমার মেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে একটা সংবাদ দেখালো। যেখানে আনন্দ মহিন্দ্র নামে
এক ভদ্রলোক বলেছেন, আমি নাকি 'এন্টারপ্রেনার অব দ্য ইয়ার'। আমি জানতাম না শব্দটার
মানে কী। তখন মেয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলো, 'এর মানে হলো তুমি একজন উদ্যোক্তা এবং তোমার
নিজের ব্যবসা শুরু করেছো'। আমি মেয়েকে বললাম, 'তাহলে তো আমি সারা জীবনভরই একজন
এন্টারপ্রেনার। কারণ আমি তোদেরকে খাইয়ে আসছি’।
বর্ষসেরা উদ্যোক্তা পুরস্কার হাতে মিসেস হরভজন কাউর |
জীবন এখন অনেক ব্যস্ত।
আমি সারাদিন রান্না করি। দোকানের বাইরেও বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় বড় অর্ডার পাচ্ছি।
যখন আমি একসাথে অনেক অর্ডার পাই, তখন সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত কাজ
করি। আমার বিরক্ত বা একাকীত্ব বোধ হয় না। আমি এখন আগের চেয়ে সাজগোজও বাড়িয়ে
দিয়েছি। প্রতিটা শাড়ির জন্য আলাদা আলাদা পুঁটলিও কিনেছি।“
হরভজন কাউরের ইচ্ছাশক্তি
এবং ইতিবাচকতা অনুপ্রেরণা পাওয়ার মতো। কর্ম তাকে করোনভাইরাসকে জয় করতেও সাহায্য করেছিলো।
১৬ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার সহ হরভজন কাউর তার নাতি-নাতনিদের সাহায্যে একজন ‘ইনস্টাগ্রাম’
তারকাও। তারা তার সমস্ত অর্জন তুলে ধরার পাশাপাশি তার সাথে রীল ভিডিও তৈরি করে।
তার ছেলে-মেয়ে,
নাতি-নাতনিরা যখন তাদের জীবনের করণীয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগে তখন তিনি তাদের বলেন,
“মন পরিবর্তন করতে কখনই দেরি করো না"। তিনি আরো যোগ করেন - "নানী যদি ৯৫
বছর বয়সে এসে কিছু করতে পারে, যে কেউ তা পারবে এবং তোমরাও পারবে”।
সূত্রঃ ইন্টারনেট