রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-১৫)

 

বিজন ভট্টাচার্য


বিজন ভট্টাচার্য


বিজন ভট্টাচার্য (১৭ জুলাই ১৯০৬-১৯ জনুয়ারি ১৯৭৮): ছিলেন একজন বাঙালি নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা। অনেকগুলি নাটক রচনা করেছেন তিনি।

 

বিজন ভট্টাচার্য ১৭ জুলাই ১৯০৬ তারিখে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার খানখানাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। ভূস্বামী পরিবারে তার জন্ম। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন।

 

বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যজীবনের শুরু হয় ১৯৪০ এর দশকে। প্রচলিত বাণিজ্যিক থিয়েটারের ধারার বাইরে স্বতন্ত্র নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেন কিছু ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী। এদেরই সাংস্কৃতিক শাখা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইণ্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন যা আইপিটিএ নামে বেশি পরিচিত। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন এই গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সারির নাট্যকর্মী। চিন্তা, চেতনা এবং সংগ্রামে প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার দিশারী ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনা, অভিনয় এবং নির্দেশনা সাফল্য লাভ করেছিল এই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

 

গণনাট্য সঙ্ঘের (তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ) প্রথম নাটক ‘আগুন’  বিজন ভট্টাচার্যের রচনা। এই নাটকটি ১৯৪৩ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে তার লেখা নাটক জবানবন্দী এবং নবান্ন অভিনীত হয়েছিল। এই নাটকগুলিতে তিনি প্রধান অভিনেতা এবং নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর শ্রীরঙ্গম মঞ্চে নবান্নের প্রথম অভিনয় হয়। এই নাটকটির পটভূমিকা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলন, পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গণনাট্য আন্দোলন এবং বিজন ভট্টাচার্যের নাটক বাংলা নাটক রচনা এবং অভিনয়ের এক যুগ বদলের সূচনা করে।

 

১৯৪৮ সাল থেকে গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে বিজন ভট্টাচার্যের মতান্তর ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ তিনি বোম্বাইতে হিন্দি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৫০ সালে তিনি আবার বাংলায় ফিরে আসেন এবং নিজের নাটকের দল ক্যালকাটা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেও তিনি নাট্যকার, প্রধান অভিনেতা এবং নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। এই থিয়েটারে তার রচিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ছিল কলঙ্ক, গোত্রন্তর, মরাচাঁদ, দেবী গর্জন, গর্ভবতী জননী প্রভৃতি।  

 

১৯৭০ সালে তিনি ক্যালকাটা থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে কবচ-কুন্ডল নামে নতুন দল গঠন করেন। এখানে তার রচিত নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষ্ণপক্ষ, আজ বসন্ত, চলো সাগরে, লাস ঘুইরা যাউক প্রভৃতি।

 

পারিবারিক জীবনঃ

ভারতের বিখ্যাত লেখিকা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী মহাশ্বেতা দেবী বিজন ভট্টাচার্যের স্ত্রী।

তবে পরবর্তীকালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তাদের এক সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। নবারুণ ভট্টাচার্য একজন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং কবি।

 

রাজনৈতিক দর্শনঃ

বিজন ভট্টাচার্য মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা ও বাঁচবার কথা তার নাটকগুলির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি এই ভাবনা থেকে সরে যান। গণনাট্য সঙ্ঘ ত্যাগ এবং নিজের নাটকের দল একাধিক বার ভেঙে গড়ে তিনি তৈরি করেন। ক্রমে মার্কসীয় দর্শনের পরিবর্তে তার রচনায় লোকায়ত ধর্ম দর্শন, হিন্দু ধর্মের সমন্বয় প্রয়াসী মানসিকতা কাজ করেছিলো। চিরকালীন মাতৃকা ভাবনা তার নাটকে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।


অভিনয়ঃ

অভিনেতা হিসাবে বিজন ভট্টাচার্য অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। নানারকম চরিত্রকে মূর্ত করে তুলতে তিনি দক্ষ ছিলেন। নানা উপভাষার সংলাপ উচ্চারণেও তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রের মধ্যে ছিল বেন্দা (জবানবন্দী), প্রধান সমাদ্দার (নবান্ন), পবন ও কেতকাদাস (মরাচাঁদ), হরেন মাস্টার (গোত্রান্তর), প্রভঞ্জন (দেবীগর্জন), মামা (গর্ভবতী জননী), কেদার (আজ বসন্ত), সুরেন ডাক্তার (চলো সাগরে) প্রভৃতি।

 

নির্দেশকঃ

নাট্যনির্দেশক হিসাবেও তিনি সমান সফল ছিলেন। গণনাট্য সঙ্ঘে তার নাটক জবানবন্দী এবং নবান্ন  ছিল অসাধারণ দুটি প্রযোজনা। তিনি তার নিজের গ্রুপ থিয়েটারেও বহু নাটকের সফল প্রযোজক এবং নির্দেশক ছিলেন।

 

 

রচিত নাটক সমূহঃ

(১)    আগুন (১৯৪৩)

(২)    জবানবন্দী (১৯৪৩)

(৩)    নবান্ন (১৯৪৪)

(৪)    জীয়নকন্যা (১৯৪৫)

(৫)    মরাচাঁদ (১৯৪৬)

(৬)    অবরোধ (১৯৪৭)

(৭)    কলঙ্ক (১৯৫০)

(৮)    জননেতা (১৯৫০)

(৯)    জতুগৃহ (১৯৫২)

(১০) মাস্টারমশাই (১৯৬১)

(১১)  গোত্রান্তর (১৯৬১)\

(১২)  ছায়াপথ (১৯৬১)

(১৩) দেবীগর্জন (১৯৬৬)

(১৪) কৃষ্ণপক্ষ (১৯৬৬)

(১৫) ধর্মগোলা (১৯৬৭)

(১৬)  গর্ভবতী জননী (১৯৬৯)

(১৭) আজ বসন্ত (১৯৭০)

(১৮) লাস ঘুমাইয়া যাউক (১৯৭০)

(১৯) স্বর্ণকূম্ভ (১৯৭০)

(২০) চলো সাগরে (১৯৭২)

(২১) চুল্লি (১৯৭৪)

(২২) হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৬)

 

মৃত্যুঃ

বিজন ভট্টাচার্য ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৮ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্রঃ ইন্টারনেট

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url