মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে আসা এক রোমহর্ষক কাহিনী - আতাউর রহমান খান




পোষ্ট অপারেটিভ ইউনিটের বেডে 


সূচনাঃ

সাল: ২০১০-১২

থাকতাম নারায়ণগঞ্জ। মেয়ের বাসা উত্তরা। মেয়ে সবার বড় সন্তান। ছেলে দুজনই পড়াশুনার জন্য একেকজন একেক জায়গায়। বাসায় শুধু আমরা দুজন থাকি।

 

একদিন স্ত্রী গেছে মেয়ের বাসায় বেড়াতে। এমন অবস্থায় আমার আহারাদী সম্পন্ন করতে হতো বাইরে। একরাতে বিরিয়ানী খেয়ে বাসায় ফিরেছি। তারপর একটু একটু পেট ব্যাথা। মহল্লার ওষুধের দোকানদার ভাই প্যারামেডিক্স। খবর দিলে বাসায় এলেন। গ্যাসের ওষুধ, ব্যাথার ওষুধ দিয়ে গেলেন।

 

দু’তিনদিন যায়, ব্যাথা কমে না। ঢাকার বড় বড় হাসপাতাল, নামকরা ডাক্তারদের কাছে দৌড়ালাম। ধানমন্ডীর এক নামকরা ডাক্তার(নাম না বলি)। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে যিনি ৫০-৬০ জন লোকের গলা দিয়ে নল ঢুকিয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা কামিয়ে(২০১০-১১) বাসায় গিয়ে নাস্তার টেবিলে অপেক্ষারত স্ত্রীর সাথে নাস্তা করেন। আমার গলা দিয়ে নল ঢুকাতে না পেরে মনক্ষুন্ন হলেন। তিনিও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রেজাল্ট দেখে কয়টি ক্রিমির বড়ি আর গ্যাসের বড়ি দিয়ে বিদেয় করলেন।

পরে অবশ্য এনেস্থেসিয়া করে ল্যাবএইড থেকে এন্ডর্সকপি করিয়েছিলাম। কিছু পাওয়া যায়নি।

 

২০১২ সালের মে মাসে একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ছোলা ভূনা আর মুড়ি খাওয়ার পর চা খেয়ে পেটে তীব্র ব্যাথা। গেলাম নারায়ণগঞ্জে্র এক নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে। প্রাইভেট হাসপাতালে সাধারণতঃ ডাক্তার মজুদ থাকেন না। কেউ ভর্তির জন্য কোনো রোগী পাঠালে সেই রোগীর জন্য তিনি আসেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন- প্রাপ্য সম্মানী নেন।

 

তো সেই হাসপাতাল থেকে একজন ডাক্তারের নাম বলে তার কাছে যেতে বললো। নারায়ণগঞ্জস্থ পপুলার ডায়গনষ্ঠিক সেন্টারে তার চেম্বার। সাথে ছিলো স্ত্রী। বাসা থেকে হাসপাতাল এবং সেখান থেকে পপুলার পর্যন্ত যাওয়ার সময়ে ব্যথার তীব্রতা এতো বেশি ছিলো যে, মনে হচ্ছিলো মারা যাচ্ছি। পথে দুইবার রিকশা থেকে নেমে রাস্তায় বসে পড়েছি।  

 

যাইহোক, খুব ভালো একজন ডাক্তার পেলাম এবং সম্ভবত সেদিনই আমার প্রকৃত রোগ নির্ণীত হলো। সার্জারীর ডাক্তার। তিনি লক্ষণ দেখেই রোগ নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। তাড়াতাড়ি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আমার চিকিৎসা দিতে লাগলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে তার অনুমানই সঠিক হলো। বললেন; ‘আপনার রোগটির নাম প্যাংক্রিয়াটাটিস (Pancreatitis) যা প্যাংক্রিয়াস (Pancreas) বা অগ্নাশয়ের ইনফেকশন থেকে হয়। কিন্তু এটা অপারেশনযোগ্য নয়। যতোটা সম্ভব ওষুধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে শীঘ্রই অন্যত্র চলে যাবো জেনে দীর্ঘ মেয়াদী ওষুধ লিখে দিলেন আর বললেন, ‘প্রয়োজনে ফোন করবেন’- যা বাংলাদেশের ডাক্তাররা সচরাচর বলেন না। সে যাত্রায় ৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম।

 

পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্র ও বাসা নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তরায় স্থানান্তর করতে হয়। এরপর ২০১৫ সালে ২ দিন এবং ২০১৬ সালে ১দিন একই কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। তবে ব্যাথার তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব ২০১২ সালের মতো অতো বেশি ছিলো না। ২০১৬ সালের পর ২০২৩ সালের ০৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আর কোনোদিন ব্যাথা হয়নি।

 

মধ্যবর্তী সময়

এলো করোনা। করোনার টিকা নেয়ার পর থেকেই শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিতে লাগলো। টিকা নেয়ার পর কয়েকদিন শ্বাসকষ্টের মতো ফুসফুসে একটা চাপ অনুভূত হতো। কাশি হলে সহজে সারতো না। দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর থেকে শুরু হলো নাক দিয়ে রক্ত পড়া। এভাবে চলতে চলতে ২০২২ সালের শুরুতে তৃতীয় ডোজও নেয়া হলো। কিন্তু নাক দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। শুরু হলো ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি। মেডিসিনের ডাক্তার পাঠায় নাকের ডাক্তারের কাছে, নাকের ডক্তার পাঠায় হার্টের (কার্ডিওলোজী) ডাক্তারের কাছে। এভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে স্থায়ী হলো প্রেসারের ওষুধ।

 

এলো টিকার চতুর্থ ডোজের পালা। আগের সবগুলো টিকাই ছিলো এষ্ট্রাজেনিকার। ৪র্থ ডোজ দেয়া হলো ফাইজারের।

 

চলছিলাম। ২০২৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে (২৪ এপ্রিল-০৬ মে) স্ত্রী’র চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাই। কলকাতা আরএন ট্যাগর হসপিটাল ব্যাংঙ্গালুরুর “দেবী শেঠী’র নারায়ণা হেলথ কেয়ারে”র শাখা। সেখানে স্ত্রীর কিডনী, রিউম্যাটোলজী, চোখের ডাক্তার- এরকম দু’তিন প্রকার ডাক্তার দেখানো, বিভিন্ন প্রকার টেস্ট করানো, টেষ্ট্র রেজাল্ট সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একদিন আমার নিজেরই প্রচন্ড মাথা ঘোরা শুরু হলো। ডানদিকে কাত হয়ে শু’লে মনে হতো এখনই জ্ঞান হারাবো। তাড়াতাড়ি ওই হাসপাতালেই নিউরোলজী ডাক্তারকে দেখালাম। তিনি ব্রেইন স্ক্যান (এমআরআই) করে ভরকে দিলেন। বললেন, ‘আপনার ব্রেন ড্যামেজ হয়ে গেছে’!

 

ভাবলাম, বলে কি! যে বিচক্ষণতার(!) সাথে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেবী শেঠীর হাসপাতালের শাখা, প্রয়োজনীয় ডাক্তার খুজে বের করা, অনলাইনে ডক্তারের এপইন্টমেন্ট নেয়া ইত্যাদি করে বেড়ালাম;- এছাড়া একটু পরপরই ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট দেই, রীল ভিডিও আপলোড দেই- তার নাকি ব্রেন ড্যামেজ! পাত্তাই দিলাম না।

 

পরে এমআরআই রিপোর্ট পড়ে যা বুঝলাম, তাতে ১ মিলিয়ন গিগাবাইট ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রেনের কয়েকটা সেল সামান্য দুর্বল হয়েছে যা বয়সজনিত কারণে। উল্লেখ্য বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের ব্রেনের যে ধারণ ক্ষমতা এবং তাতে যে পরিমান ভিডিও সংরক্ষণ করা যায় তা অনবরত চালিয়ে রাখলেও শেষ হতে ৩০০ বছর লাগবে।

যাইহোক, নিউরো ডাক্তার প্রেসারের ওষুধ একটু বাড়িয়ে দিলেন। সেইসাথে কোলেস্টরেল ও হার্ট এটাক প্রতিরোধক ছোট একটা ওষুধ যোগ করলেন।

 

ওষুধের ফর্দ বড় হতে লাগলো। আগে যেখানে দিনে একটি গ্যাসের বড়ি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খেতাম না; সেখানে প্রেসার, কোলেস্টরেল, হার্ট, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম মিলিয়ে প্রতিদিন ৮/৯টি ওষুধ খাওয়া শুরু হলো।

 

ঘটনার সূত্রপাত

২০২৩ এর ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে গিয়েছিলাম। ০৫ তারিখ রাতে হঠাৎ পেটব্যাথা শুরু হলো। ব্যথা ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো। প্রসংগতঃ এ ব্যথা শুরু হলে মুখে কিছু খাওয়া যায়না। কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই ব্যাথা শুরু হলে নিশ্চিত হাসপাতাল/ক্লিনিকে যেতে হয়, স্যালাইন নিতে হয় এবং স্যালাইনের মাধ্যমেই ব্যাথানাশক, এন্টিবায়টিক ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হয়।

 

আমার প্রাইভেট ক্লিনিকের উপর ভরসা কম। তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা পাই। ০৬ ডিসেম্বর সকালে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার যথারীতি ভর্তি করে নিলেন এবং উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিতে আরম্ভ করলেন। কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বললেন। কিন্তু পরীক্ষাগুলো ঐ হাসপাতালে করার ব্যাবস্থা নেই। নিজ খরচে বাইরে থেকে করাতে হবে।

 

আগেই বলেছি, বাইরের ক্লিনিকে আস্থা কম। বিশেষ করে মফস্বল শহরের প্রাইভেট ল্যাবরেটরীতে একদমই আস্থা নেই। অপরদিকে ঢাকায় উন্নতমানের সরকারি ল্যাবরেটরীতে বিনা পয়সায় করাতে পারবো।

 

এছাড়াও অল্প সময়ে, নিরাপদে ও সাচ্ছন্দে ঢাকা আসার জন্য অনলাইনে বেনাপোল এক্সপ্রেসের দুটি অগ্রীম টিকেট কিনে রেখেছিলাম। রাজবাড়ী থেকে টিকেট না পেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ৩ ঘন্টা আগের ষ্টেশন কোটচাঁদপুর থেকে টিকেট কিনেছিলাম- যেখানে রাজবাড়ী থেকে ঢাকা আসতে লাগে ২ ঘন্টা ২৫ মিনিট। তাই বিকালে একটু সুস্থ্য বোধ করায় সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় চলে আসার। সেদিনই হাসপাতাল থেকে চলে আসি এবং তার একদিন পর ঢাকায় আসি।

 

ঢাকা এসে প্রথমে যাই সরকারি কর্মচারি হাসপাতালে। ডাক্তার বিস্তারিত শুনে পরীক্ষার পরিমান আরো বাড়িয়ে দিলেন। পরীক্ষাগুলি করানোর পর গল ব্লাডারে পাথর হয়েছে বলে আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে জানা যায়। কেস মেডিসিন বিভাগ থেকে সার্জিক্যালে স্থানান্তর। কারণ, গল স্টোনের শৈল্য চিকিৎসা ব্যাতীত অন্য কোনো চিকিৎসা নাই। কিন্তু ঐ হাসপাতালের সিনিয়র সার্জন(জেনারেল সার্জন) বললেন, ‘আপনার যে বয়স, সমস্য হলো এনেস্থেসিয়া করানো। আপনি আরো সিনিয়র ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন’।

 

হাসপাতালটিও নির্মানাধীন। সম্ভবত সেখানে ল্যাপরোস্কপি মেশিনও নাই। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) রেফার করে দিলেন। শুরু হলো আরেক অভিযান।

 

মূল ঘটনা

যদিও পারতপক্ষে কখনো দেহ কাটাছেঁড়া করতে চাইনি। কিন্তু শুনেছি এবং কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের লেখা আর্টিকেল পড়ে জেনেছি, গল স্টোন অপারেশন না করালে আস্তে আস্তে জীবননাশী রোগের জন্ম দেয়। ডাক্তারদের পরামর্শও তাই। আত্মীয় পরিজন ও চেনাজানা অনেকেই করিয়েছেন, বিষয়টা অতো কঠিন বলে মনে হলো না। সবকিছু ভেবেচিন্তে পরিবারের সদস্যদের মতামত নিয়ে অপারেশনের সিদ্ধান্তই নিলাম।

 

গেলাম বিএসএমএমইউতে। সেখানকার অধ্যাপক সার্জনেরও একই কথা। তিনি আগের রিপোর্ট দেখেই ভর্তি করে নিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত একটি কেবিনও বরাদ্ধ পেলাম। কিন্তু খটকা লাগলো ১০০ টাকা ভর্তি ফি দাবি করায়। জিজ্ঞ্যেস করায় বললো, আপনার কেবিন, চিকিৎসা তো ফ্রি, ভর্তি ফি সবাইকে দিতে হয়। ভাবলাম, হতেও পারে।

 

যাইহোক, ১০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে কাগজটা নিয়ে ভাবলাম, আগামিকাল সকালে এসে কেবিনে উঠবো- তার আগে একটু পরিবেশটা দেখে যাই। কারণ মাস তিনেক আগেই (অক্টোবরে) এখানে আমার একটি নাতি জন্মলাভ করার পর ৬ দিন এনআইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যায়। তখন দেখেছি রোগীর লোকজনকে কি পরিমান দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।


বিএসএমএমইউ বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চমানের হাসপাতাল বলেই জানি। বাংলাদেশের একমাত্র চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যলয়। অথচ রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল– এসব হাসপাতাল নতুন হলেও নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় সার্ভার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত। রোগীর সব তথ্য সার্ভারে থাকে। হাসপাতালের যে কোনো কম্পিউটারে আইডি দিয়ে সার্চ করলেই তথ্য পাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশের ১ নম্বর সরকারি হাসপাতাল “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল” এখনো চলছে ‘ম্যানুয়্যাল’ পদ্ধতিতে। কাগজ হাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। তাছাড়া শতভাগ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা থাকলেও ভর্তি ফি যেহেতু নিলো, অন্যান্য ব্যবস্থা কেমন সেটাও একটু বুঝে যাই।

 

গেলাম কেবিন দেখতে। দেখি করিডোরে, কেবিনের ভেতরে এটেন্ডেন্টদের বিছানাপত্রে ঠাসা। কর্তব্যরত এক ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেলো, ভর্তি রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা বা যে কোনো কাজের জন্য রোগী অথবা রোগীর লোককেই দৌড়াতে হয়। জনবল স্বল্পতাই এর কারণ।

 

এক কেবিনে এক মুক্তিযোদ্ধা পেয়ে গেলাম। দেখলাম তার অপারেশনের জন্য যাবতীয় ওষুধপত্র ও অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় আনুসংগিক জিনিসপত্র তার নিজের টাকায় কিনে প্রস্তুত রেখেছে।

 

‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হাসপাতালসমূহের ব্যয় মেটানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে বার্ষিক বরাদ্ধ দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় বেঁধে দেয়া হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এছাড়াও ভর্তি রোগীর জন্য রয়েছে আলাদা নির্দেশ। ভর্তি রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কেনার কথাও নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেজন্যে মাসিক বিল সাবমিট করে পেমেন্ট নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এতদ্বসত্বেও বিএসএমএমইউ-তে মুক্তিযোদ্ধার কেবিনে গিয়ে ওই দৃশ্য দেখতে পেলাম’। কে শোনে কার কথা!!

 

যাইহোক, বাসায় এসে ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলে বিএসএমএমইউতে ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরেরদিন গেলাম সিএমএইচ। সেখানেও ভর্তি এবং অপারেশনের পরামর্শ। তবে তার আগে পূনরায় প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে সবশেষে এনেস্থেসিয়া প্রি-টেস্ট সম্পন্ন করে ভর্তির জন্য যেতে হবে। যেহেতু সচল রোগী তাই এগুলো ভর্তির আগেই করিয়ে যেতে হবে।


সব রেজাল্ট নিয়ে এনেস্থেসিয়া প্রি-টেস্ট করাতে গেলে বলা হলো আপনার ইসিজি রিপোর্টে একটু সমস্যা আছে, কার্ডিওলোজিষ্টকে দেখিয়ে পুনরায় আসুন। কার্ডিওলোজি থেকে পরামর্শ দিলেন ইকো করাতে। করিয়ে দেখালাম, সমস্যা না থাকায় পাশ করে দিলেন। সেই মোতাবেক এনেস্থেসিয়া বিভাগ থেকেও পাশ করে দিলেন। এবার ভর্তির পালা।

 

সবকিছুর রেজাল্ট নিয়ে গেলাম সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউ হাসপাতালে জেনারেল সার্জনকে দেখালেও সিএমএইচে নির্দিষ্ট লিভার-পিত্ত বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সার্জন অর্থাৎ ‘হেপাটোবিলিয়ারী’ সার্জনের অধীনে চিকিৎসাধীন। রেজাল্ট দেখে ডাক্তার ভর্তির নির্দেশ দিয়ে দিলেন। সর্বশেষ ০৫ ফেব্রুয়ারী সব পরীক্ষা শেষে ঐদিনই ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি হিসেব নিকেষ করে ১৭ ফেব্রুয়ারি ভর্তি তারিখ দিলেন। কারণ, রোগীর বেশ চাপ থাকে।

 

এরমধ্যে ০৮ ফেব্রুয়ারীর পর থেকে আমার প্রচন্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা। কোনোমতেই কমছে না। শুনেছি ঠান্ডা, কাশি, এজমা থাকলে এনেস্থেসিয়ায় সমস্যা হয়। তবুও ওই অবস্থায়ই ভর্তি হয়ে গেলাম এবং দায়িত্বরত ডাক্তারকে খুলে বললাম। তিনি ঠান্ডা-কাশির ওষুধ দিলেন। দু’তিন দিন খেয়েও কাশি পুরোপুরি সারলো না। এ অবস্থায় ২২ ফেব্রুয়ারি অপারেশনের তারিখ পড়লো। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে নেবুলাইজ করে ওটিতে পাঠানো হলো এবং বলে দেয়া হলো, ওটিতে দায়িত্বরত ডাক্তারকে কাশির বিষয়টা জানাতে।

 

স্বাভাবিকভাবে হেঁটে ওটির টেবিলে গিয়ে শুয়েছি। শরীরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লাগানো হচ্ছিলো। পেটের লোম কেটে গেলেও তা ভালোভাবে পরিস্কার না হওয়ায় ওটির টেবিলে লোম কাটা হচ্ছিলো। হঠাৎ কি হলো জানিনা, আমার বুকের মধ্যে বানের ধারার মতো ভেসে যাচ্ছিলো, খুব অস্থির লাগছিলো। বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় জ্ঞান থাকতেই বলতে পেড়েছিলাম। স্বাভাবিক বিষয় ভেবে যদি চুপ থাকতাম তাহলে হয়তো অজ্ঞান হতাম, অপারেশন হতো, জ্ঞান ফিরতো না। আর রিকোভার করা সম্ভব হতো না।

 

বিষয়টা জানানোর সাথে সাথে পাশ থেকে ওটির দায়িত্বরত একজন সহকারী (মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট) বলে উঠলেন, উঠে বসেন। উঠে বসা দেখে Hepatobilliary Surgery বিভাগের প্রধান ও অপারেশন বোর্ডের প্রধান (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) বললেন, ‘তাহলে কি আপনি অপারেশন করাবেন না’? বললাম, আমার খুব অস্থির লাগছে এবং আমার ঠান্ডা-কাশি আছে। বললেন, কাশি থাকলে তো আপনাকে অপারেশন করবো না। তার সাথে কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

 

পরে যা জেনেছিঃ

অপারেশন থিয়েটারে ওটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সার্জন, সহকারী সার্জন ও অন্যান্য সাহায্যকারী এবং সেই বিভাগের প্রধান ছাড়াও প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সার্জনও বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। হয়তোবা এটাই নিয়ম।

 

সাথে সাথে আমার মূল অপারেশন বাদ দিয়ে কেসটি Thoracic Surgeon কে রেফার করে। Thoracic Surgeon দ্রুত SICU তে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রেখে CT Scan করিয়ে ফুসফুসে বাতাস বা বুদবুদ দেখতে পান, যার ফ্লো আমার হার্টের ক্রিয়াও থামিয়ে দিয়েছিলো প্রায় এবং যেজন্যে লাইফ সাপোর্ট দিতে হয়। লাইফ সাপোর্টেও আমার হার্টবিট নাকি ছিলো মাত্র ২০-২৫।

 

তার আগে ডাক্তাররা ছেলেমেয়েদের ডেকে বলে দিয়েছিলেন, ‘সকালের মধ্যে ভালো-মন্দ রেজাল্ট পাবেন। তবে রেজাল্ট খারাপ হলে যে কোনো সময় ফোন পেতে পারেন’। ছেলেরা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য গাড়িতে উঠেছে। হঠাৎ ফোনের পর ফোন। বলা হচ্ছে, ‘তাড়াতাড়ি আসেন’।

 

ছেলেমেয়েদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। সবার শরীরে কম্পন শুরু হয়ে গেছে। যাওয়ার পর বলা হলো, ‘আপনার আব্বার বুকে একটা অপারেশন- ‘থোরাসিক সার্জারি’ (Thoracic) করতে হবে, সেজন্যে একটা কাগজ স্বাক্ষর করতে হবে। কাগজে স্বাক্ষর করতে গিয়ে বড় ছেলে জ্ঞান হারানোর উপক্রম। হাত নড়ছে না। পরে কয়েজন তাকে ধরে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করে স্বাক্ষর নেয়।

 

যাইহোক, বুকের বাম পাঁজরে ফুটো করে ফুসফুসে ড্রেন পাইপ করে সেই বাতাস বা বুদবুদ বের করা হয়। গলার রগে ‘সেন্ট্রাল ক্যানোলা’ করে সরাসরি হৃৎপিন্ডে ওষুধ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাথেডার পরানো হয়। এগুলো কখন করানো হয় আমি কিছুই জানিনা। বাইরে অপেক্ষমান উদ্বিঘ্ন ছেলেমেয়ে। ডাক্তার বেরিয়ে আশ্বস্ত করেন যে, যে অপারেশনের জন্য আপনাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে তা সাকসেসফুলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আশাকরি রিস্ক কেটে গেছে। তবে ফাইনাল রেজাল্ট পেতে জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আপনারা আগামিকাল সকাল ১০টা ১১টার দিকে আসেন। 



                               
                                                    ভিডিও সিম্বলিক

হঠাৎ জ্ঞান ফেরার পর সামনের ঘড়িতে দেখতে পেলাম সাড়ে ৬টা বাজে। ভেবেছিলাম সেদিনের সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। তাই অনেককে ৬-৭ ঘন্টার কথা বলেছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম সেটা ছিলো পরেরদিন সকাল। আইসিইউতে দিন না রাত বোঝা যায়নি। সকাল ১০-১১ টায় হারানো জ্ঞান ১৮-২০ ঘন্টা পর পরেরদিন সকাল সাড়ে ৬টার পর ফিরে পাই এবং সকাল ১১টার দিকে লাইফ সাপোর্ট খোলা হয়। আমার জন্য চিন্তিত বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। উদ্বিঘ্ন ছেলেমেয়েরা দেহে প্রাণ ফিরে পায়।

 

সকালেই আমার অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হেপাটোবিলিয়ারী সার্জন এবং Thoracic সার্জন এলেন দেখতে। বললেন, অপারেশন টেবিলে না থাকলে আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।

 

আমি এখন ভাবি এবং সিএমএইচের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বললেনও, সিএমএইচ ছাড়া অন্য কোথাও হলেও জীবনের আশংকা ছিলো। কারণ, সিএমএইচে'র মতো এতো আধুনিক যন্ত্রপাতি, সুযোগ সুবিধা এবং জবাবদিহিতামূলক দায়িত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আর কোনো বেসামরিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে বলে আমার মনে হয়নি। এবার আরো ভালো করে বোঝার সুযোগ হলো, তারা কতোটা কর্তব্যপরায়ণ ও আন্তরিক। মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদের ডাক্তারদের যে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় পেয়েছি তা অন্য কোনো সরকারি বিভাগে নাই এটা জোর দিয়ে বলতে পারি।


বিপদমুক্ত হওয়ার পর কেবিনে


 

যাইহোক, ২ দিন SICU তে রেখে ২৪ তারিখ Post Operative ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ৩ দিন থাকার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি কেবিনে দেয়। ০৬ মার্চ হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে বাসায় আসি। এখনো মুখে এন্টিবায়টিক চলছে। শরীর এখনো খুব দুর্বল। খাবার-দাবার স্বাভাবিক হয়নি।

 

একমাস গতকাল ২৩ মার্চ পরিবারের সবাই একত্র হয়েছিলাম। তাদের কাছে বিস্তারিত শুনে, ওদের মনের অবস্থ কল্পনা করে চোখে পানি এসে গিয়েছিলো।

 

সবাই দোয়া করবেন।



 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url