রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-১৪)
কাজী হেদায়েত হোসেন
কাজী হেদায়েত হোসেন |
কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া অনুরাগী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি হিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব আস্থাভাজন। তিনি ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পশ্চিমাঞ্চলের যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য ভারতের পশ্চিম বাংলার কল্যানীতে স্থাপিত “যুব অভ্যার্থনা শিবির” এর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্র্যানজিট ক্যাম্প নামেও পরিচিত ছিলো সেটি। রাজবাড়ীতে সংক্ষেপে তাকে হিদি কাজী নামে ডাকা হতো।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাত্র ০৬ মাসের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক স্বরূপ প্রকাশ পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ০৪ জানুয়ারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের জন্ম হয় এবং এর মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
মহকুমা গোয়ালন্দ হলেও এর সদর দফতর ছিলো বর্তমান জেলা শহর রাজবাড়ীতে। ঘটনাক্রমে ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক এবং বেঙ্গল হোমিও রিসার্সের সত্ত্বাধিকারী শেখ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া রাজবাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। প্রথমে তার নেতৃত্বে রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগের যাত্রা শুরু হয়। ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী একটা মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে।
আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও অন্যান্য মিলে ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ওই সময় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করে। গোয়ালন্দ মহুকুমার এই আসনটিতে তখন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা এডভোকেট আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী।
পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে রাজবাড়ীতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখা দিলে প্রবীণ কিছু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি তরুণ ও উদ্যোমী নেতৃত্বের সন্ধানে কাজী হেদায়েত হোসেনকে সামনে নিয়ে আসেন। শুরু হয় কাজী হেদায়েত হোসেনের রাজনৈতিক পথচলা।
রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হওয়ার আগেই রাজবাড়ীর ক্রীড়া, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে কাজী হেদায়েত হোসেনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬১ সালে রাজবাড়ীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজবাড়ী কলেজ (বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারী কলেজ) প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যেক্তা ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন। তৎকালীন মহুকুমা প্রশাসক কাজী আজাহার আলীর অনুপ্রেরণায় এ কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও) হিসেবে কাজী আজাহার আলী ছিলেন কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। মূলতঃ রাজবাড়ী কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক যোগানদাতা ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন।
শুধু কলেজ প্রতিষ্ঠাই নয় কলেজে অধ্যয়নরত অনেক গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করতেন তিনি। তবে এই অর্থ যাতে কোন ছাত্র-ছাত্রী অপচয় করতে না পারে সেজন্য কাউকে নগদ টাকা হাতে না দিয়ে চাহিদানুযায়ী বই, খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ কিনে দিতেন এবং কলেজের টিউশন ফি পরিশোধ করে দিতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য রাজবাড়ী কলেজের হিন্দু ও মুসলিম হোস্টেলের বাইরেও তিনি নিজ উদ্যোগে রাজবাড়ী শহরে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। এটি তার দুরদর্শী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
ওই সময়কালে গোয়ালন্দ মহুকুমার এসএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র ছিল রাজবাড়ীতে। একারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে শত শত ছাত্র-ছাত্রীকে রাজবাড়ীতে অবস্থান করতে হতো। কিন্তু গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর রাজবাড়ী শহরে থাকা খাওয়ার সুযোগ, সামর্থ ছিলো না। কাজী হেদায়েত হোসেনের ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এসব ছাত্র-ছাত্রীর থাকা খাওয়ার পুরো ব্যবস্থা হতো। এর সুবাদে অনেকেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে।
১৯৬০ সালে কাজী হেদায়েত হোসেন রাজবাড়ী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
রাজবাড়ীর ক্রীড়াঙ্গনে ছিল তার সরব উপস্থিতি। এরই অংশ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “বয়েজ ক্লাব”। এতদ্বঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে বয়েজ ক্লাবের পরিচিতি ছিলো স্মরণ করার মতো। কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্টপোষক। তার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠালাভের ক্ষেত্রে বয়েজ ক্লাবের কার্যক্রম একটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকার ধারাবাহিকতায় তিনি মহুকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাজবাড়ী স্টেডিয়ামটি কাজী হেদায়েত হোসেন স্টেডিয়াম হিসেবে নামকরণ করা হয়। মৃত্যুর দিনও তিনি এই স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজের তদারকী করেছেন।
পাকিস্তানের লাহোর জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ ছিলো কাজী হেদায়েত হোসেনের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনি রাজবাড়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় (সাবেক গোয়ালন্দ মডেল হাইস্কুল) ও আরএসকে ইনস্টিটিউশন এর ছাত্রদের নিয়ে ওই জাম্বুরীতে অংশ নেন। তৎকালীন সময়ে সরাসরি ট্রেনযোগে স্কাউটরা লাহোরের ওই স্কাউট জাম্বুরীতে যোগদান করে। এর পুরো নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন কাজী হেদায়েত হোসেন।
১৯৬২ সালে কাজী হেদায়েত হোসেনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় মহুকুমা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরের বছর ১৯৬৩ সালে রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে তারই প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে প্রয়াত এডভোকেট চিত্তরঞ্জন গুহ (ভিপি) ও নাজিবর রহমান (জিএস) সহ পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করে। ছাত্রলীগের এই বিজয় এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির উপর ভর করেই রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগের শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৬৫ সালের ০২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানে্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দীতা করেন। সে সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের অধিকাংশ মহুকুমায় মুসলিম লীগ প্রার্থী আইয়ুব খান বিজয় লাভ করলেও রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগ সহ বিরোধী দলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে প্রচারণার মূল নেতৃত্বে ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন।
পরবর্তী সময়ে সকল রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা এবং বিপুল জনসমর্থনের কারণে দলগতভাবে বিশেষ কোনো পদে আসীন হওয়ার আগেই তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মহুকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী হেদায়েত হোসেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি রাজবাড়ী অঞ্চলের প্রধান সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এখানকার যুব সমাজকে সংগঠিত করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান সহ সকল প্রতিরোধ কার্যক্রমে তার বলিষ্ট ভূমিকা ছিল। এ অপরাধে শহরের সজ্জনকান্দা এলাকায় তার নিজ বাড়ীতে স্বাধীনতা বিরোধীরা অগ্নিসংযোগ করে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রাজবাড়ী শহরে পাক আর্মি প্রবেশের পর কাজী হেদায়েত হোসেনসহ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বালিয়াকান্দির রামদিয়া এলাকায় অবস্থান নেয়। এই খবর পেয়ে রাজবাড়ীর বিহারী-অবাঙ্গালীরা রামদিয়ায় হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সেখানকার নিতাই চন্দ্র সরকার সহ ২শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। অনেকের বাড়ী-ঘর লুটপাট ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর কাজী হোদায়েত হোসেন খোকশা, কুষ্টিয়ার আকামুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ীতে পরিবারের সবাইকে রেখে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। দায়িত্ব পান “কল্যানী যুব অভ্যার্থনা কেন্দ্রের”। সেখান থেকেই তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিংএর ব্যবস্থা ও অস্ত্র জোগাড় করে ছোট ছোট গ্রুপে যার যার এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া ছিলো তার দায়িত্ব। কল্যাণী ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক।
স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজবাড়ীর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে কাজী হেদায়েত হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বলিষ্ট নেতৃত্বের কারণে এতদ্বঞ্চল (সাবেক গোয়ালন্দ মহুকুমা) আওয়ামীলীগের শক্ত ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাত্র ৩
দিন পর প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাজবাড়ী শহরের কলেজ রোড এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা
করে। ওই সময়ের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে শোনা যায় তিনি সেদিন বেলা সাড়ে
১১ টার দিকে কলেজ সংলগ্ন নিজের ইটভাটা থেকে বের হয়ে রিক্সাযোগে রাজবাড়ী শহরে আসার
জন্য রওয়ানা হন। রিক্সা কিছুদুর আসামাত্র পূর্ব থেকে ওৎপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তার
বুকে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেয়ার পর তার
মৃত্যু হয়।
এসময় তার সাথে থাকা ঠিকাদার আব্দুস শুকুর মোল্লা (বাদশা মিয়া) দুস্কৃতিকারীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজবাড়ীর সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় ছিলেন। জরুরী দু’একটি কাজ সেরে তারও ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিণতি! ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিল তার জীবন। ঢাকায় যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি।
কাজী হেদায়েত হোসেনের পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ী শহরের ধুঞ্চি এলাকায়।
তার পিতার নাম কাজী আব্দুল হামিদ। তার চার কন্যা ও ৭ পুত্র রয়েছে। জ্যেষ্ঠ পুত্র
আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য। মেজ ছেলে কাজী ইরাদত আলী
রাজবাড়ী চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি এবং জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে
দায়িত্ব পালন করছেন।