রোজা : সেকালে-একালে
ছবিঃ প্রতিকী |
আমাদের ছেলেবেলায়
দেখেছি সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লোক রোজা থাকতো। বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে অপারগ,
অনিচ্ছুক, রোগগ্রস্থ, শিশু ইত্যাদি। এই ৫০ শতাংশ লোক নির্বিঘ্নে খাওয়া-দাওয়া করতো।
আমার ছেলেবেলা বলতে
কমপক্ষে ৫০-৫৫ বছর আগের কথা।
তখনকার দিনে একজন কৃষি দিনমজুরকে
সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। সে সময়কার নিয়মানুযায়ী গৃহস্থবাড়িতেই
দিনমজুরদের তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা হতো।
আমি কোনো দিনমজুরকে আষাঢ়
(জুন-জুলাই) মাসের খড়তাপে ১৫-১৬ ঘন্টা না খেয়ে রোজা রাখার সাহস করতে দেখিনি। অধিকাংশ
দিনমজুরকেই রোজা না থাকতে দেখেছি।
যাইহোক, বাড়ির রোজাদার
মা-বোনদেরকেই পরিবারের অরোজাদার সদস্য, শিশু ও দিনমজুরদের জন্য খাবার তৈরি করতে হতো। তাতে
তাদের রোজার একটুও ক্ষতি হতো না।
হাট-বাজারে কোনো
খাবারের দোকান বন্ধ রাখতে দেখতাম না,- শহরাঞ্চলেও না। বড়জোর একটা পর্দা টানানো
থাকতো, তাও সেটা রোজাদারের অসুবিধার কথা চিন্তা করে না, খাবারের দোকানে যারা ঢুকছে
তাদের গোপনীয়তার কথা চিন্তা করে দোকানদাররাই পর্দা টানাতো। পর্দা না টানালে সে
দোকানে খরিদ্দার কম হতো।
তো সেই পর্দা ভেদ করে
বিড়ির ধোঁয়া-গন্ধ সারা বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও রোজাদারদের কোনো অসুবিধা হতো না।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর
আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে। বেড়ে উঠেছেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায়। তিনি জানিয়েছেন
তার শৈশবে দেখা রমজানের চিত্র:
"তরুণদের তো কথাই নাই, বয়স্কদেরও সকলে রোজা রাখিত না। যারা রোজা রাখিত,
তারাও দিনের বেলায় পানি ও তামাক খাইত। শুধু ভাত খাওয়া হইতে বিরত থাকিত। পানি ও তামাক
খাওয়াতে রোজা নষ্ট হইত না এই বিশ্বাস তাদের ছিল।“
আমি বলেছি ৫০-৫৫ বছর আগের কথা। আবুল মনসুর আহমেদের
কথা থেকে অনুমান করা যায়, শতবছর আগে কেমন ছিলো রোজার হাল!
ইদানিং কেনো যেনো মনে
হয়; তখন কি মানুষ কম ধার্মিক ছিলো? কিন্তু তাতো হবার কথা না! আর তা যদি না হয়,
তাহলে এই সময়ে এসে বাধ্যতামুলক খাবারের দোকান বন্ধ থাকার কারণ কি? নাকি রোজাদারের
সংখ্যা বেড়েছে? খাওয়া-দাওয়ার চাকচিক্য অর্থাৎ মানুষের খাদ্যমান যে হারে বেড়েছে- রোজাদারের
সংখ্যা বাড়তেও পারে! কারণ ১৫-১৬ ঘন্টা রোজা থাকার জন্য সেহরিতে ভালো খাবারও
প্রায়োজন। তখনকার দিনে অনেককে দুইবেলা আহার জোটাতেই হিমশিম খেতে হতো। অসচ্ছল
পরিবারে মাছ মাংশের সাথে দেখা হতো কদাচিৎ। তাই রোজা পালন অনেকের কাছে দুরূহ
ব্যাপার ছিলো। এবং সেকারণেই হয়তো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে কথা!!
আচ্ছা, ধরে নিলাম
রোজাদারের সংখ্যা বেড়ে এখন ৭০ শতাংশ হয়েছে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে রোগগ্রস্থ,
শিশু, সফররত এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী থাকতে পারে। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে বাধ্যতামূলক
খাবারের দোকান বন্ধ, যে সব স্থানে পানীয় পানি সরবরাহ করার কথা, যেমন; দূরপাল্লার
বাস ইত্যাদি– সে সব সার্ভিস বন্ধ, এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটের মতো
দূরপাল্লার বাসগুলোতে পথিমধ্যে খাবার বিরতিও বন্ধ! অরোজাদার যাত্রীদের না খেয়েই
৬-৭ ঘন্টা জার্নি করতে হচ্ছে। ওই ৩০ শতাংশ লোককে কষ্ট দিয়ে আমরা কি সংযম পালন করছি,
কি ত্যাগ উৎসর্গ করছি?
আমাদের ধর্মগ্রন্থে
আছেঃ
“তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে
থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তারা
এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে”। - (সুরা বাকারা-আয়াতঃ১৮৪)
সুতরাং ধর্মগ্রন্থে রোজা না রাখার অপশনও যথারীতি আছে।
আসলে আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে না? যে, “বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়”! অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থে
কি আছে তা আমরা দেখি না। হুজুর কি বললো, সেটা কার্যকর করতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামি!
রোজার দিনে অন্যকে পানাহার
করতে দেখলে যদি কারো খেতে ইচ্ছে করে, রোজা হালকা হয়ে যায়, তাইলে বুঝতে হবে তার ইমান
মজবুত না।
শুনেছি প্রায় প্রতিটা
ধর্মেই রোজা বা উপবাস পালনের নিয়ম আছে। এই দেশে তো অন্য ধর্মের অনেক মানুষ বাস
করে। তারাও তাদের প্রথা অনুযায়ী উপবাস পালন করে। তারা তো উপবাসের সময় বলে না, ‘আপনার
খাওয়া দেখে আমার খেতে ইচ্ছে করছে’? আপনিতো
জানতেই পারবেননা যে, কে উপবাস পালন করছে।
অপরদিকে, যে দেশে
মুসলমানরা সংখ্যালঘু তারা তো কাউকে বলার হিম্মত দেখায় না, ‘আমার সামনে খাবেন না,
আমার রোজা হালকা হয়ে যাচ্ছে’। তাহলে কি ধর্মও প্রাভাব প্রতিপত্তি দিয়ে পালনের বিষয়?
না’হলে কেনো একজন
অরোজাদার বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী- হতে পারে সে বিদেশী পর্যটক;- রোজার মাসে আপনার
সামনে এক গ্লাস পানি খেতে পারবে না কেনো?
আপনার রোজাকে হেফাজত
করার দায়িত্ব কেনো জোর করে তাদের ঘাড়ে চাপাবেন?
গলি মহল্লার খাবার
দোকানগুলো বাধ্যতামূলক বন্ধ রাখার কারণে রোজা রাখতে অক্ষম শ্রমিক/অসুস্থ্য
মানুষগুলো সারাদিন না খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়। খাবার দোকান বন্ধ থাকার কারণে রাস্তার
কুকুর বেড়ালগুলোকেও অভুক্ত থাকতে হয়।
মহান আল্লাহ আমাদের
ইমানকে আরো মজবুত করে দিন। আমীন।।