রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-৬)
কাজী আনোয়ার হোসেন
কাজী আনয়ার হোসেন |
কাজী
আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন বাংলাদেশি লেখক,
অনুবাদক এবং প্রকাশক। জনপ্রিয় গোয়েন্দা উপন্যাস “মাসুদ রানা” (ধারাবাহিক) তার
অনবদ্য সৃষ্টি। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি ষাটের
দশকের মধ্যভাগে “মাসুদ রানা” নামক গুপ্তচর চরিত্র
সৃষ্টি করে সাড়া ফেলেন। এর কিছু আগে “কুয়াশা” নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র
তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে “বিদ্যুৎ মিত্র” ও “শামসুদ্দীন নওয়াব” নাম ব্যবহার করতেন।
কাজী
আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ
করেন। তার পুরো নাম কাজী
শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম 'নবাব'। তার পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ি জেলার পাংশা
উপজেলায়। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন এবং
মাতা সাজেদা খাতুন। তারা ছিলেন ৪ ভাই, ৭ বোন।
কাজী আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তার পিতা ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীতে নিজেদের বাসা সেগুনবাগিচায় চলে আসেন।
কাজী
আনোয়ার হোসেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ১৯৫২
সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা
সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
পড়াশুনা
শেষে তিনি বেতারে নিয়মিত গান গাওয়া শুরু করেন। গানের কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও
বাড়িতে গানের চর্চা ছিলো সবসময়। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা
বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। রেডিও ছাড়াও টিভি এবং সিনেমায়ও গান করেছেন কাজী
আনোয়ার হোসেন। ১৯৬৭ সালে গান গাওয়া পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দেন। তার স্ত্রী ফরিদা
ইয়ায়সমীনও (নিলুফার ইয়ায়াসমীন ও সাবিনা ইয়াসমীনের বোন) নামকরা সংগীতশিল্পী ছিলেন।
কাজী আনোয়ার হোসেনের তিন বোন সানজীদা
খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনও রবীন্দ্র
সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬৩ সালে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় “সেগুন বাগান” প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় “সেবা প্রকাশনী”। তার প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৬২
সালে কণ্ঠশিল্পী “ফরিদা ইয়াসমিন”কে বিয়ে করেন তিনি। কাজী আনোয়ার
হোসেনের এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। তার মেয়ে শাহরীন সোনিয়াও একজন কন্ঠশিল্পী ছিলেন। বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখি এবং সেবা
প্রকাশনীর সাথে জড়িত।
কাজী আনোয়ার হোসেনের অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশী
কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। কুয়াশা সিরিজের কুয়াশা-১-এর মাধ্যমে লেখালেখির জগতে বিচরণ ঘটে তার। তার ভাষাশৈলীতে
অসাধারণ রকমের যাদু যা পাঠককে আবিষ্ট করে। তার মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ।
মাসুদ
রানা তার
সৃষ্টি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। ১৯৬৬ সালে ধ্বংস পাহাড় নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা
প্রকাশনীহতে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে চার শতাধিক গুপ্তচর কাহিনীর
বই প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজের প্রথম ৩টি বই "ধ্বংস পাহাড়",
"ভারতনাট্যম" এবং "হ্যাকার" ছাড়া বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য
ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাসুদ রানার চরিত্রটি মূলত ইয়ান
ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির
বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৭৪
সালে মাসুদ রানা'র কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ
করা হয়। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর
পেরিয়ে'র কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা
সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে।
১৯৭৪
সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে “বাচসাস পুরস্কার” লাভ
করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এছাড়া পেয়েছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির
রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।
মৃত্যুঃ ২০২১ তার প্রোস্টেট ক্যান্সার
ধরা পড়ে। এরপর ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্টএটাক হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ১৯
জানুয়ারী ২০২২ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন।