রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-৩)
মীর মশাররফ হোসেন
মীর মশাররফ হোসেন |
মীর মশাররফ হোসেন (১৩ নভেম্বর ১৮৪৭-১৯ ডিসেম্বর ১৯১১) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার
ও প্রাবন্ধিক। তাঁর পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের
পথিকৃৎ। কারবালার যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত” বিষাদ সিন্ধু” তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম।
সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন
তৎকালিন ব্রিটিশ-ভারত - বর্তমান বাংলাদেশ-এর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার
একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার
পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকন্দি উপজেলার পদমদি গ্রামে। তার পিতা নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন সম্ভ্রান্ত
মুসলিম ব্যক্তি ও তৎকালীন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনী পাড়ার জমিদার এবং মাতার
নাম দৌলতুন্নেছা।
পদমদি গ্রামে তার
স্মৃতিস্বরূপ
সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেনের
স্কুল জীবন কেটেছে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে পদমদী এবং শেষে কৃষ্ণনগর শহরে। জগমোহন নন্দীর
পাঠশালা, কুমারখালির ইংলিশ স্কুল, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়ার কথা লেখকের
আত্নজীবনীতে লেখা আছে।
মাত্র আঠারো বছরে বয়সে তার পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয়।
তার
জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস
করেন।
মীর মশাররফ হোসেন তার বহুমুখী প্রতিভার
মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত
বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন।
তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮ সালে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয় যা দক্ষিন
এশিয়ার মধ্যে ছাত্রদের জন্য তৈরীকৃত ২য় বৃহৎ আবাসিক হল।
রচনাবলী
সৈয়দ
মীর মশাররফ হোসেনের লেখা মোট ৩৬ টি বইয়ের তথ্য পাওয়া যায়। তারমধ্যে কয়েকটির নাম
নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
নাম ধরণ প্রকাশকাল
রত্নবতী উপন্যাস ১৮৬৯
গোরাই-ব্রিজ
অথবা গৌরী-সেতু কবিতা ১৮৭৩
বসন্তকুমারী নাটক ১৮৭৩
জমিদার
দর্পণ নাটক ১৮৭৩
বিষাদ
সিন্ধু মহরম পর্ব উপন্যাস ১৮৮৫
বিষাদ
সিন্ধু উদ্ধার পর্ব উপন্যাস ১৮৮৭
বিষাদ
সিন্ধু এজিদ বধ পর্ব উপন্যাস ১৮৯১
গো-জীবন প্রবন্ধ ১৮৮৯
উদাসীন পথিকের মনের কথা উপন্যাস ১৮৯০
তহমিনা উপন্যাস ১৮৯৭
নিয়তি
কি অবনতি নাটক ১৮৯৮
পঞ্চনারী পদ্য কবিতা ১৮৯৯
মৌলুদ শরীফ ধর্ম
বিষয়ক ১৯০৩
বিতর্ক
১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রবন্ধ গো-জীবন। গো-জীবনের লেখক মূলত উপমহাদেশে গোরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানের যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান তার ব্যাপারে মন্তব্য রাখেন নিজের। তাঁর মত ছিল গোরু কুরবানির বদলে অন্য কিছু (যেমনঃ ছাগল) কুরবানি দেওয়ার। তার মতামত ছিলোঃ
·
"খাদ্য
সম্বন্ধে বিধি আছে যে খাওয়া যাইতে পারে-খাইতেই হইবে, গো-মাংস না খাইলে মোসলমান
থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে….একথা কোথাও লিখা নাই।"
·
"এই
বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম
ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না।
আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ
নাই, রক্ষার উপায় নাই।..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা,
তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী?"
·
"আরবে
কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র,
নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে।
এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের
ব্যবস্থা।"
·
"গরু
কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।"
এই
প্রবন্ধ লেখার পর সৈয়দ মীর মোশারাফ হোসেন প্রবল নিন্দার সম্মুখীন হন। তাঁর নামে
ফতোয়া জারি হয়। ধর্মসভা ডেকে তাঁকে কাফের এবং তাঁর স্ত্রীকে হারাম জারি করা হয়।
তাঁকে বলা হয় 'তওবা' করতে।
ক্ষুব্ধ লেখক প্রথমে একটি
মামলা দায়ের করলেও পরে ব্যাপারটি আপসে মিটিয়ে নেন। কিন্তু গো-জীবন এর
পরবর্তীকালে আর ছাপা হয়নি।
মৃত্যু
১৯ ডিসেম্বর, ১৯১১ সালে
দেলদুয়ার জমিদার এস্টেটে নায়েব বা ম্যানেজার থাকাকালেই সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন
পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়। এখানেই 'মীর মশাররফ
হোসেন স্মৃতি কমপ্লেক্স' অবস্থিত।
মীর
মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র
রাজবাড়ী জেলার পদমদি গ্রামে
বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত “মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র” দর্ধনার্থীদের জন্য
একটি আকর্ষণীয় স্থান। স্মৃতিকেন্দ্রের একটি ছবিঃ