রংরুট সাক্ষাৎকার: রীতা রায় মিঠু
রীতা রায় মিঠু |
রংরুট: আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?
রীতা রায় মিঠু: না, সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো আমার কাছে কখনোই বিড়ম্বনার মনে হয় নি। জীবনের কোনো পর্বেই তা মনে হয়নি। বরং যদি আবার জন্ম নেয়ার সুযোগ পাই, আমি মেয়ে হয়েই জন্ম নিতে চাই।
আমার
বর্তমান বয়স ছাপ্পান্ন, জন্ম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পিত্রালয় ঢাকার অদূরে
নারায়ণগঞ্জ শহরে।
আমার
শৈশব কৈশোর এবং বিবাহের আগ পর্যন্ত কাল কেটেছে শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত
নারায়ণগঞ্জ শহরে।
বাবা মা
তিন ভাই এবং আমাকে নিয়েই ছিলো আমাদের ছয় সদস্যের অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার।
বাবা ছিলেন সাধারণ চাকুরিজীবী এবং মা নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী
শিক্ষিকা।
নারায়ণগঞ্জ
বাণিজ্যিক শহর, ব্যবসা বাণিজ্যে রমরমা নারায়ণগঞ্জ শহরের বুকে বসে আমাদের অতি
সাধারণ বাবা মা আমাদের চার ভাইবোনকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ না দিয়ে
একাডেমিক ক্যারিয়ার তৈরির প্রতি যত্নশীল ছিলেন। আমাদের সমাজে মেয়েরা স্কুল ফাইনাল
পাশ করার পরেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার তোরজোড় শুরু হতো। তেমন সমাজে দাঁড়িয়ে বাবা মা
আমার বিয়ের জন্য পাত্র না খুঁজে অনার্স পড়তে পাঠিয়েছিলেন সাভারের জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবার বক্তব্য ছিলো পরিষ্কার, “ মেয়ে যখন তাকে তো বিয়ে দেবোই,
কিন্তু আমার মেয়েকে কারো ঘাড়ে চাপাবো না। বিয়ে দেয়ার আগে মেয়েকে এমনভাবে তৈরি করে
দেবো যেনো জীবনের সর্ব অবস্থায় আমার মেয়ের পায়ের তলায় মাটি থাকে।“
প্রশ্নটা
ছিলো আমাদের সমাজে মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে। এতোক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে
গিয়ে পরিবারের কথা উল্লেখ করার কারণ, সমাজ তো তৈরিই হয় পরিবার থেকে। পরিবার
বিস্তৃত হয়েই তৈরি হয় সমাজ। কাজেই সমাজের খোঁজ করতে গেলেই অবধারিতভাবে পরিবারের
খোঁজ চলে আসে। পরিবারে যার অবস্থান যেমন, সমাজেও তার অবস্থান তেমনই থাকে।
আমাদের
বাবা মা চার ভাইবোনের পরিবারে মেয়ে সদস্য ছিলো মাত্র দুজন, পুরুষ সদস্য চারজন। অথচ
সংখ্যালঘু সদস্য হয়েও পরিবারে আমাদের মা মেয়ের কর্তৃত্ব ছিলো প্রবল। মা শিক্ষকতা
পেশায় কর্মরত ছিলেন বিধায় সংসারে মায়ের প্রতাপটাও যেনো বেশি ছিলো। ছিলো । আর
একমাত্র কন্যা সন্তান হিসেবে সংসারে সকলের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়েছি বলেই বোধ হয়
দিনে দিনে সংসারে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছি। এতো প্রভাব যার, তার তো মেয়ে জন্ম নিয়ে
গর্ব বোধ করার কথা।
ঢাকা
বাংলাদেশের রাজধানী, তাই রাজধানীর হালচাল, হাওয়া বাতাস নয় মাইল দূরে অবস্থিত
নারায়ণগঞ্জের গায়ে লাগে। হয়তো আমার বাবা রাজধানীর প্রভাবেই প্রভাবিত হয়ে তিন ছেলের
সমমর্যাদায় একমাত্র কন্যাকে গড়ে তুলেছেন। বাবা মায়ের মুখ থেকে কখনও শুনতে হয়নি,
“মেয়ে সন্তান বিয়ে দিতে পারলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ” জাতীয় কথাবার্তা।
আমি যে
সময়ে স্কুল কলেজ জীবন সমাপ্ত করেছি, তখন নারায়ণগঞ্জে মেয়েদের জন্য কয়েকটি বালিকা
বিদ্যালয় থাকলেও কলেজ ছিলো মাত্র একটি। কলেজে ছাত্রী সংখ্যাও কম ছিলো। আসলে
অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া স্কুল পর্যন্তই যথেষ্ট মনে করা হতো। নিদেনপক্ষে
কলেজে গিয়ে দুই বছর পড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেই বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হতো। সেই
সমাজে আমি নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসা থেকে সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
( রেসিডেন্সিয়াল) কেমিস্ট্রি অনার্স পড়তে গিয়েছি।
সমাজ
ব্যবস্থা তখন কিছুটা পিছিয়ে পড়া হলেও মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে, রাস্তাঘাটে চলাফেরা
নিয়ে আমাকে অথবা আমার মতো আরও মেয়েকে কখনো সামাজিক অথবা পারিবারিক বিড়ম্বনার শিকার
হতে হয়নি।
মেয়েদের
লেখাপড়া নিয়ে খুব বেশি উচ্চাশা না থাকলেও পথেঘাটে, স্কুল কলেজে, বাসে রিক্সায়
চলাফেরায় মেয়েদের উপর কোনো বিধি নিষেধ আরোপিত ছিলো না। ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের
উপর কোনো বয়ান দিতো না কেউ। পোশাক পরিচ্ছদেও মেয়েরা ছিলো সাবলীল, একেবারে সাধারণ
বাঙালির আটপৌরে পোশাক পরেই মেয়েরা সহজ স্বাভাবিক ছন্দে দিন কাটাতো। কাজেই আমাদের
সমাজে বিয়ের যৌতুকের পয়সা জমানো ছাড়া মেয়ে সন্তান নিয়ে বাবা মায়ের অতিরিক্ত উদ্বেগ
কমই ছিলো।
বর্তমান
সমাজে মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, লেখাপড়াতেও চৌকস। এখন স্কুল ফাইনাল পাশ
করার সাথে সাথেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করে না বাবা মা। তবে মেয়েদের
জাগরণের পাশাপাশি বর্তমান সমাজে মেয়ে সন্তান নিয়ে বাবা মায়ের উদ্বেগও বেড়ে চারগুণ
হয়েছে। পথেঘাটে অফিস আদালতে মেয়েদের চলাফেরা যেমনই সহজ স্বতস্ফূর্ত হয়েছে, তেমনই
মেয়েদের জন্য সমাজের অলিগলি রাজপথ সংসার বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠেছে।
অথচ
লেখাপড়া কম জানা আমাদের সেই সমাজ ছিলো ছেলে মেয়ে সকলের জন্যই মোটামুটি নিরাপদ। আমি
একা একা বাসে চড়ে সাভার- নারায়ণগঞ্জ আসা যাওয়া করতাম। গাড়ি একসিডেন্ট ছাড়া বাবা
মা’কে অন্য কোনো বিপদের কথা চিন্তা করতে হতো না।
সেই
সমাজে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটা বিড়ম্বনার ছিলো কিনা তা বলতে পারবো না, কারণ আমার
পরিবারে আমার তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। কে জানে, হয়তো তিন ছেলের সংসারে আমি একমাত্র
মেয়ে ছিলাম বলেই আমার কদর ছিলো। যদি চিত্রটা উলটো হতো, তখন আমার অভিজ্ঞতা কেমন হতো
তা তো বলতে পারবো না।
কারণ
সেই সময়ে অনেক অসচ্ছল পরিবারে একাধিক কন্যা সন্তান নিয়ে বাবা মায়েদের দুশ্চিন্তার
অবধি ছিলো না। মেয়েদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো মেয়েদের অল্প
বয়সে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো। এবং সেই সমাজে যৌতুক প্রথা ছিলো বিষফোঁড়ার
মতো যন্ত্রণাদায়ক। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারে যৌতুক প্রথার চল ছিলো একটি অবধারিত
বিষয়। এই যৌতুক প্রথার কারণেই হিন্দু পরিবারে কন্যা সন্তান জন্মের পর বাবা মায়ের
কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তো। কন্যা সন্তান জন্মের সাথে সাথেই বাবা মাকে কন্যার বিয়ের
যৌতুকের পয়সা সঞ্চয় করতে হতো। সেই দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে, আমাদের সময়ের সমাজে
একটি পরিবারে একাধিক কন্যা সন্তান জন্মানোটা কিছুটা তো বিড়মবনারই ছিলো।
রংরুট: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে
পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?
রীতা রায় মিঠু: শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে ছেলে মেয়েদের চলাফেরা
ওঠাবসার মধ্যে পার্থক্যটা আমার কাছে তখন বেমানান ঠেকতো না। মেয়েরা একটু বড়ো হয়ে
উঠলেই হাঁটু ঢাকা জামা পরতে হয়, আরেকটু বড়ো হলে পা ঢাকা বুক ঢাকা জামা কাপড় পরতে
হয়, ছেলেরা বালক থেকে বড়ো হতে থাকলে তাদেরও হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরতে হয়,
লুঙ্গি পরতে হয়---এসবই স্বতঃসিদ্ধ এবং স্বাভাবিক নিয়ম বলেই মনে হতো। বরং মেয়েদের
তো শৈশব থেকেই মনের ভেতর চাপা অপেক্ষা থাকতো, কবে বড়ো হবো, দিদির মতো জামা পায়জামা
পরবো, বুকে ঝিলিমিলি ওড়না জড়াবো!
আসলে
আমরা এমন পরিবেশে বড়ো হয়েছি, বিশাল বাড়ির আঙিনায় ছেলেমেয়ে একসাথে আড্ডা খেলাধূলা
হইচই করেছি। আমাদের চেনা জগতে ছেলেরা মেয়েদের দিকে কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি নিয়ে
তাকায়নি। খেলতে গিয়ে ছেলেমেয়ে হুটোপুটি করেছি কিন্তু শরীরে কখনও অবাঞ্ছিত স্পর্শ
টের পাইনি।
তবে
হ্যাঁ, মেয়ে বলে মাথার উপর কিছু তো বিধি-নিষেধ ছিলোই। যেমন মেয়েরা এখানে যেতে পারে
না, ওখানে যেতে পারে না। কেনো পারে না, লোকে মন্দ বলবে।
একটা
উদাহরণ দেই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় শৈশবে আমার সাঁতার কাটা শেখা হয়নি। তাই
কৈশোরে যখন সাঁতার শিখতে চাইলাম, বলা হলো কিশোরী মেয়েরা নদীতে গিয়ে সাঁতার শিখলে
লোকে মন্দ বলবে। তখন তো নদী আর পুকুর ছাড়া ছেলেমেয়েদের সাঁতার শেখার আর কোনো উপায়
ছিলো না। আমার ছোটোভাইকে নদীতে নিয়ে সাঁতার শেখানো হলো, আমি বাদ রয়ে গেলাম। এই
“মন্দ বলে লোকে” শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই প্রযোজ্য ছিলো, এটা নিয়ে অবশ্যই মনে মনে
আফসোস করতাম কেনো এই পোড়া সমাজে জন্ম নিলাম! নদীমাতৃক দেশে শুধুমাত্র লোকে মন্দ
বলিবে তাই আমার সাঁতার শেখা হলো না, ফলে আমার জীবনখানা ষোলো আনাই ফাঁকি রয়ে গেলো।
রংরুট: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে
ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান কাল ব্যাপী।
পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই
কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি
আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?
রীতা রায় মিঠু: আমি ভাগ্যবতী, আমাদের পরিবারে আমি ছিলাম
একমাত্র কন্যা, তিন ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। বৈষম্যমূলক আচরণ পাবো কি, বরং কিছু
কিছু বিষয়ে একমাত্র কন্যা বলে বেশি প্রশ্রয় পেতাম। তবে আমাদের চার ভাইবোনের বেড়ে
ওঠায় কোথাও কোনো বৈষম্য হয়নি।
এবার
আসি আমার কথায়। আমার তিন সন্তানের তিনজনই কন্যা, কোনো পুত্র নেই। তাই কন্যাদের
কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি। তাই বলে তো আমাদের সমাজে পুত্র কন্যা সন্তানে
বৈষম্যমূলক আবরণ উবে যায়নি! আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দেখেছি, পুত্র সন্তান-কন্যা
সন্তানে অল্পবিস্তর বৈষম্য করা হতো, যা আমার পছন্দ হতো না। তবে বৈষম্য হতে দেখলেই
আমি প্রতিবাদ করতাম। সে বৈষম্য কন্যার প্রতিই হোক অথবা পুত্রের প্রতি হোক।
আমাদের
পরিবারে বাবা মায়ের তিন পুত্র ছিলো, কন্যা আমি একটাই। একা ছিলাম বলে বাবা মা
কিন্তু কন্যাকেই বেশি প্রশ্রয় দিতো। আবার উল্টোটাও ঘটতে দেখেছি, যে পরিবারে তিন
কন্যা এক পুত্র, স্বাভাবিকভাবেই দান উলটে যেতো। সকল আদর প্রশ্রয় পুত্রের জন্য তোলা
থাকতো। আসলে বৈষম্য কন্যা অথবা পুত্র দিয়ে হয় না, বৈষম্য হয় সংখ্যার বিচারে। এবং
এই বৈষম্যনীতিতে পুরুষ নয়, নারীরাই এগিয়ে।
দুঃখের
বিষয়, এতো নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলি আমরা, অথচ আমাদের সমাজে পুত্র কন্যা
সন্তানে বৈষম্যটা মা শাশুড়িরাই প্রকাশ্যে করে থাকেন। মায়েরাই পুত্র সন্তান নিয়ে
আদিখ্যেতা করতে ভালোবাসেন, মায়েরাই খাওয়ার পাতে ভালো জিনিসটা কন্যাকে ডিঙিয়ে
পুত্রের পাতে তুলে দেন।
মায়েরাই
কন্যাকে তোতাপাখির মতো শিখিয়ে যান, “সকল শ্রেষ্ঠ তোলা থাকবে পিতা পুত্র শ্বশুর
স্বামী ভাইদের জন্য। তুমি কন্যা, তুমি জায়া তুমি জননী, তোমাকে ত্যাগ করতে শিখতে
হবে। ভোগ নয় অধিকার দাবীও নয়, তুমি ত্যাগ করেই মহিমান্বিত হবে!”
আমাদের
সমাজে সর্ষের মধ্যেই ভূত, ভূত তাড়াবে কে? এইজন্যই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও
আমাদের উপমহাদেশে নারী্দের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সংসারে পূর্ণ মর্যাদা পাওয়া হয়
না।
রংরুট: পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন, সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত
ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?
রীতা রায় মিঠু: আসলে আমার মনোজগতে ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ
আলাদাভাবে বিরাজ করে না। আমার মনোজগতে মানুষ বিরাজ করে। সে মেয়েই হোক অথবা ছেলেই
হোক, বাবাই হোক অথবা মা-ই হোক, হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান লেখক অভিনেতা যে-ই
হোক, প্রত্যেককে আমি চিনি তার কর্মের মাধ্যমে। তাই নারী পুরুষ নিয়ে কথা উঠলে আমি
একচোখা অথবা একরোখা মন্তব্য করতে পারি না।
আমি
তুলারাশির জাতিকা, তাই হয়তো আমার মনে মননে চিন্তা চেতনায় সবসময় ব্যালেন্সিং চলতে
থাকে।
পরিবারে
আমরা পিতার শাসনে বড়ো হলেও মা’কেই বেশি ভয় পেতাম। বাবা সারাদিন বাইরে কাজে ব্যস্ত
থাকতো, সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতো। মায়ের অধীনেই ছিলো সংসারের চাবি। বাবা মায়ের
সংসারে থেকেই বুঝে ফেলেছিলাম, পুরুষ হচ্ছে সংসারের মেশিন, নারী্র কাছে থাকে সংসার
মেশিনের চাবি এবং মেশিনের তেল। নারী যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে মেশিনের চাবি
ঘুরায়, মেশিনে তেল দিয়ে মরচে রোধ করে, সেই সংসার মেশিন থেকে উন্নত প্রোডাক্ট তৈরি
হয়। আমাদের মা সংসার মেশিনে মরচে পড়তে দেননি, চাবিও হারিয়ে ফেলেননি।
আমার
নিজের সংসারের প্রধান পুরুষ হলেও, আমার সংসারের চাবি আমার হাতে। আমি কাউকে আদেশ
নির্দেশ দেই না, অথচ আমার সংসার চলে আমার চোখের ইশারায়। আমাদের পাঁচজনের পরিবারে
চারজনই মেয়ে, পরিবার প্রধান একমাত্র পুরুষ।
অযথাই
মানুষ বলে আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, আমি মনে করি আমাদের সমাজ যে তন্ত্রেই
বিশ্বাসী হোক না কেনো, সংসার কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক এবং খুব অল্প মানুষই তা বুঝতে
পারে।
রংরুট: নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের
অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও
সমাজ সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে
আপনার অভিমত কি?
রীতা রায় মিঠু: পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। পরিবর্তন একটি চলমান
পদ্ধতি। গতিময় জগতে পরিবর্তন আসে কখনও দ্রুত গতিতে, কখনো ধীর গতিতে।
নারীর
যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন, নারীরও যে নিজস্ব আয় উপার্জন থাকা দরকার, এই
ধারণাটাই তো পঞ্চাশ বছর আগের সমাজে ছিলো না। ধীরে হলেও সমাজে পরিবর্তন তো এসেছে,
নারী এখন পুরুষের সমকক্ষ হয়ে আয় উপার্জন করছে। হয়তো অনেক নারী নিজের উপার্জনের
অর্থ নিজের ইচ্ছেমতো ব্যয় করতে পারে না, তারপরেও কেউ কেউ তো পারে। এটাও তো সমাজে
ইতিবাচক পরিবর্তন। অনেক নারীরই আলাদা ব্যাংক একাউন্ট আছে, অনেক নারীই তার
উপার্জনের টাকায় নিজের বাবা মায়ের দেখভাল করে। আজকাল গৃহকর্মে স্ত্রীকে অনেক
স্বামীই সাহায্য করে। এটাও তো সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন।
পরিবর্তন
আসছে, সমাজে নারী পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে ধীরে হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। ইতিবাচক
পরিবর্তনের ভালো দিক হচ্ছে, একবার যা ইতিবাচক তা কখনও নেতিবাচক হয় না।
শতভাগ
ভালো পেতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে
হাইলাইট করতে হবে, প্রচার করতে হবে। আলোর রেখা দেখতে পেলে তবেই তো মানুষ অন্ধকার
থেকে বেরিয়ে আলোর রেখা বরাবর হাঁটবে।।
রংরুট: কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু এর পেছনে
পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?
রীতা রায় মিঠু: প্রবাদে বলে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে,
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।
তবে
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, সংসার আসলে সুখের হয় রমণীর গুণে বুদ্ধিতে সহনশীলতা ধৈর্য
এবং ত্যাগে।
নারীর
এমনই শক্তি এবং ক্ষমতা, সংসারে পুরুষের ভূমিকা না থাকলেও একা নারীর হাতেই সংসার
সুখের হয়ে ওঠে!
রংরুট: পেশাগত জগতে একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার,
সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর
কতটা নির্ভর করে?
রীতা রায় মিঠু: আমি আমেরিকা আছি প্রায় কুড়ি বছর, ওয়ালমার্ট
সুপার সেন্টারে চাকুরি করছি পনেরো বছরের উপর। আমার কর্মক্ষেত্রে আমি স্বাধীনভাবে
কাজ করি, এখানে কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের ভেদাভেদ দেখিনি।
দেশে
কর্মজগতের অবকাঠামো সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তবে আমার মা একটানা
বেয়াল্লিশ বছর হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন পুরুষ সহকর্মী শিক্ষকদের সাথেই। আমার
মা’কে কখনও নারী হিসেবে হতাশ হতে দেখিনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে ছিলেন আরেক
উজ্জ্বল নক্ষত্র নারী, মিসেস হেনা দাস। নারী শিক্ষক পুরুষ শিক্ষকে রেষারেষি হয়েছে
বলেও শুনিনি।
বর্তমানে
দেশে আমার অনেক নারী আত্মীয়, নারী বন্ধু কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন
করছে। তাদের কাছ থেকেও কোনো বঞ্চনার অভিযোগ শুনিনি।
রংরুট: এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন
সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ
সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!
রীতা রায় মিঠু: যেহেতু আমি পরিবারে মুক্তচিন্তার পরিবেশে বড়ো
হয়েছি, ভাই বোন সমান খেয়ে পড়ে বড়ো হয়েছি, মেয়ে বলেই আমাকে মাছের কাঁটা হাঁড়ি চাছা
খেতে হবে তেমনটা হয়নি, তাই আমাদের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি
আমাকে তেমন বিচলিত করতো না।
আর নারী
পুরুষের শারীরিক গড়নের পার্থক্যটা ঈশ্বর প্রদত্ত হিসেবে মেনে নিয়েছি। বাসে রাস্তায়
ভীড়ের মাঝে দেহের বিশেষ অংশে অবাঞ্ছিত হাতের স্পর্শকে অবধারিত একটি ব্যাপার বলে
জেনেছি। অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ছোট্ট দেহটাকে ছয় হাত লম্বা ওড়না
দিয়ে ঢেকে রাখা, ভীড়ের মধ্যে দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখার কায়দা অবশ্য
শিক্ষণীয় হিসেবেই শিখেছি। অবশ্যই খারাপ লাগতো মেয়ে হিসেবে এমন অতিরিক্ত সতর্কতা
নিয়ে পথে ঘাটে চলতে, তবুও পুরুষ মাত্রেই নারীলোলুপ, এমন কথা কখনওই ভাবিনি।
নিজে
যখন তিন কন্যা সন্তানের মা হলাম, নিজের কৈশোর যৌবনের অভিজ্ঞতার আঁচ কন্যাদের জীবনে
পড়তে দেবো না বলেই বাবা মা ভাইদের ছেড়ে তিন কন্যা নিয়ে আমেরিকা চলে এলাম। আমেরিকা
এসে আমেরিকান মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে দেখে বুঝতে পেরেছি, আমাদের দেশে
মেয়েরা ঈশ্বরের দেয়া শরীর নিয়ে আজও কতোটা বিচলিত, কতোটা আতঙ্কিত থাকে।
যদিও
সম্ভব নয়, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাকে যদি একদিনের জন্য সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা
রাখার সুযোগ দেয়া হয়, আমি মাত্র তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো।
মেয়েদের
উপর যেনো ধর্মের দোহাই না দেয়া হয় তাই প্রথমেই ধর্মচর্চাকে বাড়ির ভেতরে রাখার
নির্দেশ দেবো,
নারীর পোশাক পরিচ্ছদে যেনো কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা না যায় তাই নারী পুরুষ সবাইকে নিজের ইচ্ছেয় নিজের মতো করে সততার সাথে জীবনযাপনের নির্দেশ দেবো, আর মেয়েরা যেনো কৈশোর থেকেই পুরুষের লোভের শিকার না হয় তাই ছেলেমেয়েদের দশ বছর বয়স হলেই সেক্স এডুকেশান বাধ্যতামূলক করে দেবো। তাতে যদি নারী পুরুষে লিঙ্গ বৈষম্য কমে!
রংরুট: বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই
বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?
রীতা রায় মিঠু: নারী নির্যাতন কেনো, কোনো নির্যাতনই তো আইন করে
বন্ধ করা যায় না। ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলে নির্যাতন নিয়ন্ত্রিত হবে। সুস্থ
স্বাভাবিক অবস্থায় তো কেউ কাউকে নির্যাতন করে না।
রাষ্ট্র
না হয় আইন করলো, নারী নির্যাতন করলে শাস্তির ব্যবস্থাও করা হলো। কিন্তু আমাদের
সমাজের দিন আনা দিন খাওয়া স্বামী স্ত্রীর অভাবের সংসারে কে কখন কোথায় নির্যাতন
করছে, কে নির্যাতিত হচ্ছে এর হিসেব রাখার জন্যও তো বিশাল কর্মিবাহিনী নিয়োগ দিতে
হবে।
নইলে তো
মহা সমস্যা দেখা দিবে। যে পুলিশ একজন নির্যাতনকারীকে বন্দী করতে আসবে, সেই পুলিশের
সংসারে যে নির্যাতন হচ্ছে তার হিসেব নিবে কে!
রাষ্ট্র
আইন তৈরি করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের জনগণের মাঝে যদি আইন মানার প্রবণতা না থাকে,
আইন মেনে চলার শিক্ষা না থাকে, আইন রক্ষা করবে কে, আইন প্রয়োগই বা করবে কার উপর!
আইন করে
নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। জনগণের কর্মসংস্থান, নারী পুরুষের সহাবস্থান, নারী
পুরুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ, জনকল্যাণমুখি শিক্ষাদানের মাধ্যমে নারী
পুরুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে পারলেই সকল পর্যায়ে নির্যাতন হ্রাস করা
সম্ভব।
রংরুট: বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি
মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি
হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?
রীতা রায় মিঠু: খুব দেরীতে হলেও মেয়েরা আজ ছেলেদের সমকক্ষ হয়ে
উঠছে। মেয়েদের এই উত্থান এতোকালের পুরুষশাসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছুটা হলেও
ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘাড়ের কাছে প্রতিপক্ষ কেউ পছন্দ করে না। তাই সর্বমহলেই
নানাভাবে মেয়েদের পিছুটানার চেষ্টা শুরু হয়েছে। মেয়েদের পিছু টানার সবচে মোক্ষম
অস্ত্র ধর্মের দোহাই দেয়া। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সকলেই ধর্মভীরু। বেঁচে থেকেও
প্রতিদিন একবারের জন্য হলেও সকলে মৃত্যুর কথা ভাবে, মৃত্যুর পর বেহেশতে যাবে নাকি
নরকে যাবে, তা ভেবে কাতর হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নেতৃত্বের শীর্ষ সকল পদেই নারীরা অধিষ্ঠিত
আছেন। তারপরেও কেনো বাড়ির বাইরে মেয়েরা সুরক্ষিত নয়? অথচ এই বাংলাদেশেই ত্রিশ
পঁয়ত্রিশ বছর আগেও নারীরা তুলনামূলক নির্ভয়ে পথে ঘাটে চলাফেরা করতো। তাহলে এখন
কেনো নয়?
উত্তর
ওখানেই আছে। পঁয়ত্রিশ বছর আগে নারীরা কারো প্রতিপক্ষ ছিলো না, প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার
যোগ্যতা অর্জন করেনি তখনও। এখন নারীরা পুরুষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। একটি চেয়ারের
জন্য পুরুষ ক্যান্ডিডেটের সমান যোগ্যতা নিয়ে নারী ক্যান্ডিডেট প্রতিযোগিতায় নামে।
যোগ্যতা প্রমাণ করে চেয়ারটা অনেক সময় নারী ক্যান্ডিডেটই দখল করে নেয়।
এই
প্রতিযোগিতা সমাজের সর্বস্তরে চলছে। সেই থেকেই নারীকে পেছনে টানার এক অদৃশ্য
প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যোগ্যতা দিয়ে পারবে না বুঝেই ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে ঘরে
ঢোকানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
হঠাত
করেই বাংলাদেশে আলেম ওলামা হুজুরদের দৌরাত্ম্য, ওয়াজ মাহফিল, ধর্মের দোহাই দিয়ে
ওয়াজে নারীর বিরুদ্ধে বিষোদগার, নারীকে হেয় করে রসালো কথার ফুলঝুরি, ইউটিউবে নারী
বিষয়ক যৌন উত্তেজক ওয়াজের অডিও ভিডিও বিস্তার লাভ করেছে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ
ধর্মভীরু, তাই এসব ওয়াজ শোনার এবং ওয়াজে বয়ানকারীর সকল কথা বিশ্বাস করার মানুষের
সংখ্যাও অনেক বেশি। দেশের শীর্ষপদে নারী থাকলেও নারীর উন্নয়নের বড়ো বাধা ধর্মের
দোহাই যেখানে, সেখানে হস্তক্ষেপ করতে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই গলদটা থেকেই
যাচ্ছে।
রংরুট: আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিত
ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার
মতে?
রীতা রায় মিঠু: নির্যাতন শব্দটাই অনাকাঙ্ক্ষিত , নেতিবাচক,
নিষ্ঠুর। কারো উপরই নির্যাতন হওয়া উচিত নয়। নির্যাতন করে সবলেরা, নির্যাতন হয় দুর্বলের
উপর। দুর্বল যে কেউ হতে পারে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, গৃহকর্মী, এমনকি কোনো
কোনো পরিবারে পুরুষও দুর্বল প্রতিপক্ষ হয়। অর্থাৎ নারী মাত্রেই দুর্বল নয়, পুরুষ
মাত্রেই সবল নয়। অবস্থান বিশেষে ব্যক্তি বিশেষে সবলতা দুর্বলতা নির্ণিত হয়।
আন্তর্জাতিক
নারীদিবস নয় শুধু, আজকাল তো আন্তর্জাতিক পুরুষদিবসও পালিত হয়। আসলে বিশেষ দিবস
উদযাপনটা অনেকটাই উৎসব আনন্দ করার মতো ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে।
প্রায়
সব বিশেষ দিবস উদযাপনের শুরুটা হয় আমেরিকায়, দিবসের সাথে আনন্দ উচ্ছ্বাস সম্মান
ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে বলেই ছোটো হয়ে আসা পৃথিবীতে ধীরে ধীরে তা আন্তর্জাতিক
স্বীকৃতি পায়।
নারী
নির্যাতনের ধারাবাহিক ব্রেকিং নিউজের সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সমন্বয়
খুঁজে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক নারীদিবস তো শুধু নির্যাতিত নারীদের কথা ভেবে পালিত হয়
না। নারীদিবস পালিত হয় পৃথিবীর সকল নারীশক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে।
আর
নির্যাতন তো শুধু নারীদের উপর হয় না, নির্যাতন হয় দুর্বলের উপর। যেখানে নারী
নির্যাতিত হয়, সেখানে নারীকে সবল হয়ে উঠতে সহায়তা করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক
নারীদিবসের সংবাদ যে নারীর কাছে পৌঁছে না, তার পক্ষে জানা সম্ভব নয় পরিবারে না
হলেও, নারী হিসেবে বছরের একদিন সে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান পাচ্ছে।
তাই এই
বার্তাটুকু নির্যাতিত নারীদের কানে পৌঁছে দেয়া জরুরী। নারীকে কোনো না কোনো দিক
দিয়ে শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করতে হবে। শারীরিক শক্তিই সব নয়, মেধা মননে ভাবনা
চিন্তা বুদ্ধি বিবেচনা প্রখর হলে শারীরিক দুর্বলতা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
কলকাতার একটি টিভি চ্যানেলে ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।দশ বছর ধরে চলছে এই অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানে নারীর শক্তি, শূন্য থেকে পূর্ণ হওয়ার নারীর ক্ষমতা, অসম্ভব সাড়া জাগানিয়া আশা জাগানিয়া স্বপ্ন দেখানো একটি অনুষ্ঠান।
আমাদের
দেশে নারীদের পর্দার আড়ালে পাঠানোর প্রবণতা কমাতে হবে। ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে
নারীদের সম্পর্কে কটুক্তি আইন করে বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়,
টিভি চ্যানেলগুলোতে নারী উদ্দিপনামূলক অনুষ্ঠান যতো বেশি প্রচারিত হবে, নারী
নির্যাতনের মাত্রা তত হ্রাস পাবে।
রংরুট: সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত
হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
রীতা রায় মিঠু: সম্মান অর্জন করতে হয়, অর্জনের মাধ্যমেই
প্রতিষ্ঠা আসে। সম্মান কেউ হাতে ধরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। আজকের আলাপ শুরু
করেছিলাম কন্যা সন্তান নিয়ে আমার পারিবারিক মূল্যবোধ, পারিবারিক শিক্ষা এবং
অবস্থানের বর্ণনা দিয়ে। পুনরায় উল্লেখ করেই আজকের আলাপের ইতি টানছি।
আমাদের
বাবা মা তিন ছেলে এক মেয়ের সংসারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন
যা তিনি অর্জন করেছিলেন, এবং আমি আজও পিত্রালয়ে কন্যা হিসেবে নয়, পরিবারে একজন
দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবেই সবচে বেশি সম্মান পাই।
আমার
নিজের তিন কন্যা সন্তান, পুত্র নেই। আমার কন্যা এবং পুত্র উভয় থাকলেই ভালো হতো,
ভাইবোনে মিলে খুনসুটি করতো। তবে পুত্র নেই বলে আমার পরিবারে তারকার দ্যুতি কম নেই।
তিন কন্যাই তিন তারকা, তিনজনই যার যার অবস্থানে উজ্জ্বল।
আমাদের
সময়ে যে বাবা মায়ের সংসারে পুত্র সন্তানের পরিবর্তে তিন কন্যা সন্তান জন্ম নিতো,
কন্যা বিয়ের যৌতুকের চিন্তায় সেই বাবা মা অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যেতো।
সময়
বদলেছে, যুগ বদলেছে। এখন কন্যা সন্তান জন্ম নিলে বিড়ম্বনা নয়, অনেক বাবা মায়ের
মুখে হাসি ফোটে, ছোট্টো কন্যা শিশুটিকে ঘিরে বাবা মা একজন দৃঢ়চেতা স্বাধীনচেতা
নারীর স্বপ্ন দেখে।
আজকাল
আমার মতো আরও শত শত মায়ের ঘরে এমনই একাধিক কন্যা সন্তান জন্ম নিচ্ছে। মায়েরা এখন
আর কন্যার বিয়ের কথা ভেবে বুড়ো হয়ে যায় না। বিয়ের বদলে কন্যাকে নিজের পায়ে দাঁড়
করানোর স্বপ্ন দেখে। বাবা মায়ের সহযোগিতায় নিজের যোগ্যতাতেই মেয়েরা সমাজে নিজের
আলাদা অবস্থান তৈরি করে নেয়।
এভাবেই
আমাদের সমাজ দশ ধাপ এগিয়ে আজকের সমাজ তৈরি হয়েছে, আজকের সমাজ একশ ধাপ এগিয়ে
ভবিষ্যত সমাজ তৈরি হবে। এভাবেই যদি সমাজ এগোয়, একদিন পুরো দেশ জাতি এগিয়ে যাবে।
লেখকঃ রীতা রায় মিঠু নিবাসঃ মিসিসিপি, আমেরিকা
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
·
ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরে
·
মুহূর্তে দেখা মানুষ
·
তুমি বন্ধু তুমি সখা
·
সাগর ডাকে আয়
·
পারমিতার চিঠি
·
চোখ যায় যদ্দুর
·
সঙ-সারের গল্প।
সাক্ষাৎকার : ২০২০