রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-১২)
কাজী আবদুল ওদুদ
কাজী আব্দুল ওদুদ |
কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন একজন কৃতী অধ্যাপক, চিন্তাশীল বাঙালী প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, বিশিষ্ট সমালোচক, নাট্যকার ও জীবনীকার। বিশের দশকে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং "শিখা" পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
কাজী
আবদুল ওদুদ ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল বর্তমান
রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী সগীরুদ্দিন ওরফে কাজী
সৈয়দ হোসেন। মায়ের নাম খোদেজা খাতুন। তার পিতা ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার।
১৯১৬ সালে তিনি তার চাচাতো বোন জামিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। জামিলা খাতুন ১৯৫৪ সালে মারা যান।
কাজী আবদুল ওদুদ ১৯১৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করার পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আইএ এবং ১৯১৭ সালে বিএ পাস করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তার একটি গল্পগ্রন্থ “মীর পরিবার”-(১৯১৮) এবং উপন্যাস “নদীবক্ষে”-(১৯১৯) প্রকাশিত হয়।
এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে(বর্তমানে ঢাকা কলেজ) বাংলার প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন।
তার মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন লেখার জন্য ঢাকার নবাব পরিবার কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে ১৯৪০ সালে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ওই বছরই বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রীডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
কাজী আবদুল ওদুদ কলেজে অধ্যায়নকালেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। এমএ পাশ করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির
আবাসিক ভবনে অবস্থান করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে
সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠতো। কাজী আবদুল
ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তার চিন্তা
ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র
“শিখা”র প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ
ছিলো। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে “সংকল্প” ও “তরুণপত্র” নামে দুটি
সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমন্ডলীর
সভাপতি।
১৯১৯ সালে প্রকাশিত তার
উপন্যাস "নদীবক্ষে" সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “উপন্যাসখানিতে মুসলমান চাষি
গৃহস্থের যে সরল জীবনের ছবিখানি নিপুণভাবে পাঠকের কাছে তুলিয়া দিয়াছেন তাহার
স্বাভাবিকত্ব, সরসত্ব ও নতুনত্বে আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছি”।
১৯৬৬ সালে তিনি পবিত্র কোরআন - কোরানের
বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন।
১৯৭০ সালে তিনি 'শিশির কুমার পদক' লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রবন্ধকার হিসাবে খ্যাত কাজী আব্দুল ওদুদ বাংলার পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণা জাগ্রত করার জন্য সাহিত্য সাধনার আত্মনিয়োগ করেন।
কাজী আবদুল ওদুদ স্বদেশচেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কর্মক্ষেত্রের নিবিষ্ট পাঠক ও আলোচক ছিলেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রচিত গ্রন্থে তার গভীর সাহিত্যবোধ ও ব্যাপক মননশীলতার পরিচয় বহন করে।
“হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম” তার পরিণত বয়সের রচনা। তিনি এ গ্রন্থে হজরত মোহাম্মদকে রক্ত-মাংসের মানুষ এবং ঐতিহাসিক এক সঙ্কটকালের মহৎ পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি যাঁর ছিল অপরিসীম দরদ ও দায়িত্ব। হজরত মোহাম্মদ মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্যদৃষ্টি ও জ্ঞানানুরাগের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ এ বক্তব্যটি তার উক্ত গ্রন্থে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন।
১৯৫৩
সালে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় “ব্যবহারিক শব্দকোষ” - একটি আধুনিক বাংলা ভাষার জনপ্রিয় অভিধান। উক্ত অভিধান সংকলনে তার
ভাষা সচেতন মনের পরিচয় মেলে। অভিধানটির বিশেষত্ব হলো, এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরবি,
ফার্সি ও তুর্কি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের প্রয়াস আছে এবং বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত
শব্দসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শিক্ষকতার জন্য
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কাজী আবদুল ওদুদ দেশভাগকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। সেকারণে
তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সকলে ঢাকায় থেকে গেলেও তিনি কখনো ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ
ছাড়েননি। আমৃত্যু থেকে গিয়েছিলেন তার পার্ক সার্কাস অঞ্চলের ৮ বি, তারক দত্ত
রোডের বাড়িটিতে।
তার বাড়ির-ই আরেক তলায়
থাকতেন রফিউদ্দিন আহমদ, যিনি হুগলীর খানাকুল, রামমোহনের জন্মস্থানে একাধিক বছর
দারাশিকো এবং রাজা রামমোহন-কে স্মরণ করে মেলার আয়োজন করতেন। দেশভাগের পর
হিন্দু-মুসলমানের ভিতর ক্ষত নিরাময়ের উদ্দেশ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুব,
বিচারপতি মাসুদ প্রমুখেরা আয়োজন করতেন এই মেলা। রফিউদ্দিনের ভাই রবিউদ্দিন আহমদও ছিলেন কলকাতায় ওদুদের শেষ জীবনের নিঃসঙ্গ যাপনের অন্যতম সঙ্গী।
মৃত্যুঃ কাজী আব্দুল ওদুদ ১৯৭০ সালের ১৯ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।