রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-৮)
জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রের পথিকৃৎ রাজবাড়ীর কৃতি
সন্তান বামনদাস গুহরায়
বামন দাস গুহরায় |
বামন দাস গুহরায়ঃ জন্ম রাজবাড়ী জেলার সজ্জনকান্দা গ্রামে। পিতা তারকনাথ গুহ ছিলেন আইনজীবী ও সমাজসেবক। এই প্রথিতজশা শিল্পী মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ
করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বাদ্য যন্ত্রের নতুন এক শব্দের জন্ম দেন। যার নাম ‘জলতরঙ্গ’।
ভারতের আকাশবানী থেকে যখন এই সুর ভেসে আসতো তখন সবাই অবাক হয়ে শুনতো। বামনদাস গুহ
সেই সময়ের প্রায় সব বাদ্য যন্ত্রই বাজাতে পারতেন।
জলতরঙ্গ
বাদ্যের আদি উৎস কোথায় এটা জানা না গেলেও এই উপমহাদেশে তিনিই জলযন্ত্রের জনক। জলভর্তি
বাটির প্রান্তে আঘাত করলে সঙ্গীতোপযোগী যে ধ্বনি সৃষ্টি হয় সেটাই জলতরঙ্গ। সঙ্গীতে
ব্যবহৃত স্বরের কম্পাঙ্ক নির্দিষ্ট করার জন্য পাত্রের ভিতর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ
পানি দ্বারা পূর্ণ করা হয়। এরপর কাঠের দণ্ড দিয়ে আঘাত করে স্বর সৃষ্টি করা হয়।
এক্ষেত্রে একটি সুর সৃষ্টির জন্য যতগুলো স্বরের দরকার হয় ঠিক ততোগুলো বাটি ব্যবহার
করা হয়। অনেক সময় উপযুক্ত চিনামাটির বাটির বিকল্প হিসেবে ধাতুর তৈরি বাটি ব্যবহার
করা হয়। বাদনের সময় বাটিগুলোকে
অর্ধ-বৃ্ত্তাকারে সাজানো হয়। বাদক এই বৃত্তের কেন্দ্রে বসে দুই হাতে কাঠের দণ্ড
দিয়ে বাটির প্রান্তভাগে আঘাত করে সুর তৈরি করেন। সঙ্গীত অনুসারে জলতরঙ্গের জন্য
২২টি বাটি নিয়ে জলতরঙ্গের সেট তৈরি হয়- এমন উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ১৬টি বাটি
প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনে এই সংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি হয়। স্বরের
প্রকৃতি অনুসারে বাটির পানিও হ্রাসবৃদ্ধি করা হয়।
জলতরঙ্গ বাদ্য এখন বিলুপ্তির পথে |
রাজবাড়ীর
কৃতি সন্তান বামন দাস গুহরায় এর ‘জলতরঙ্গ’ বাদ্যযন্ত্র আজ বিলুপ্তির পথে।
সর্বভারতীয় সঙ্গীতজগতে ‘জলতরঙ্গ’ বাদ্যের তিনি পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত। জল আর
সাধারণ পাত্র দিয়ে তিনি যে সুরের লহড়ী তুলতেন সে মূর্চছনায় নিত্য আনন্দ বহমান হতো।
সে সুরের সাগরে অবগাহন করা যে্তো। ‘টুং টাং টুং টাং চুড়ির তালে জলতরঙ্গ
বাজেরে’-----এ যেন হৃদয় তন্ত্রীতে নাড়া দেয়। জানা যায় বিগত চল্লিশের দশকে বামন দাস
গুহরায়ের জলতরঙ্গের একক বাদ্যসঙ্গীত হিসেবে আকাশ বাণী কলকাতা কর্তৃক গ্রামোফোন
রেকর্ড করে কলকাতা, দিল্লী, শিলিগুড়ি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হতো।
সেতারবাদক
মীর সাহেব, তবলা বাদক লেদুদাস, বংশীবাদক ধীরেন প্রমুখের সাথে তিনি যেভাবে রাজবাড়ীর
সঙ্গীতাঙ্গন সমৃদ্ধ করে গেছেন সেকথা আজও মানুষ স্মরণ করে। সেই সময়ে ডানলপ হল (যা
পরে চিত্রা সিনেমা হল) এবং রেলওয়ে হোসনেবাগ হলে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে
বামনদাসের জলতরঙ্গ ছিল প্রধান আকর্ষণ।
জলতরঙ্গ
বাদক হিসেবেই তার একমাত্র পরিচয় নয়। সঙ্গীত, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অঙ্গনে
বামনদাশ গুহরায় এক কিংবদন্তির নাম। কেবল রাজবাড়ীতে নয়, সর্বগুণে তিনি সারা
ভারতবর্ষে পরিচিতি লাভ করেন। শিল্প সাহিত্যের নানা অঙ্গনে ছিলো তার বিচরণ। তিনি
ছিলেন তৎকালীন রাজবাড়ীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। রাজবাড়ীর শিল্প,
সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, খেলাধুলায় নতুন মাত্রা সংযোজন করে গেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে
রাজবাড়ীকে তিনি উচ্চতর স্তরে উন্নীত করে গেছেন।
বিদ্যালয়ের
লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে
ফেলেন বামন দাস গুহ। তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকার। তিনি নাটক রচনা
করতেন এবং তা মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা করতেন। ‘ছায়ানট’ ‘চোরাচালান’ ‘দুর্নীতি’
প্রভৃতি নাটক তিনি রচনা করেন। তিনি ছিলেন ফরিদপুর আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও
শিক্ষক। বর্তমানে এটি ফরিদপুর শিল্পকলা একাডেমী।
সঙ্গীতাঙ্গন
ছাড়াও তিনি ছিলেন কৃতি ফুটবল খেলোয়াড়। তার সুযোগ্য কন্যা দীপ্তি গুহ রায় তৎকালীন
পূর্ব-পাকিস্তানে নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার হাতে গড়া শাম্মী
আক্তার ছিলেন দেশবরণ্য সঙ্গীতশিল্পী।
বামন দাস গুহরায়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও
পরবর্তীতে জল তরঙ্গেরর চর্চা তেমন চোখে পড়ে না। বামন দাস গুহ’র জামাতা অর্থাৎ দীপ্তি গুহ রায়ের স্বামী চিত্তরঞ্জন
গুহ প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সফল আইনজীবী। চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক এবং
জাতীয় ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্তের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয়।
মৃত্যু
বামন
দাস গুহরায় ১৯৬৮ সালে ফরিদপুর আর্ট ও সঙ্গীত নিকেতন থেকে রাজবাড়ী আসার পথে সড়ক
দুর্ঘটনায় মারা যান। সাংস্কৃতিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র বামন দাস জীবনের শেষ দিন
পর্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠায় ছিলেন আন্তরিক।
পুরস্কার
রাজবাড়ী
রশিদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ কর্তৃক ১০
এপ্রিল ২০০৯ রাজবাড়ী শিল্পকলা একাডেমীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে মরণোত্তর
সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। পদক গ্রহণ করেন তার কন্যা দীপ্তি গুহ।
এ মহান
শিল্পী রাজবাড়ী তথা জাতির জন্য অনন্য অবদান রেখে গেছেন।
তথ্য ও
ছবির জন্য কৃতজ্ঞতাঃ মকবুল খান ও নেহাল আহমেদ - রাজবাড়ী