রাজবাড়ী জেলার কীর্তিমানদের কথা (পর্ব-২)
ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন
ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন |
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক।
কাজী মোতাহার হোসেন ১৮৯৭ সালের ৩০
জুলাই কুষ্টিয়া (তখন নদীয়া) জেলার কুমারখালি থানার
লক্ষ্মীপুর গ্রামে তার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমার (বর্তমান রাজবাড়ি জেলা) পাংশা থানার (বর্তমানে
উপজেলা) বাগমারা গ্রামে। তার পিতা কাজী গওহরউদ্দীন
আহমদ ছিলেন সরকারি সেটেলমেন্ট বিভাগের সার্ভেয়ার। তার মায়ের নাম তাসিরুন্নেসা। কাজী মোতাহার হোসেন শৈশব কাটিয়েছেন তার নিজ গ্রামে।
কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২১ সালে এম এ
শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমানের কন্যা
সাজেদা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে চার পুত্র ও সাত কন্যা ছিলো। তাদের মধ্যে - সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন প্রমুখ।
কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু
হয় কুষ্টিয়াতে। মেধাবী ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাথমিক ও ১৯০৯
সালে উচ্চ প্রথমিক পাশ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস
করার পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরে ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান
অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে এমএ পাশ
করেন। উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথম শ্রেণি পান নি। ১৯৩৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল
ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। একইসাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার ডক্টরাল থিসিসে তিনি একটি নতুন তত্ত্বের
অবতারণা করেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।
১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে্র পদার্থবিজ্ঞা্ন বিভাগের প্রদর্শক
হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২৩ সালে একই বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। কাজী
মোতাহার হোসেনের নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম এ কোর্স
চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত গণিত
বিভাগেও শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক
হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি পরিসংখ্যান
বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা
ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
১৯৫৫ সালে বর্ধমান হাউজে (বার্তমানে বাংলা একাডেমি) আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ'র সাথে কাজী মোতাহার হোসেন |
অসাম্প্রদায়িক
ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ়
ভিত গড়ে তোলার জন্য তিনি লেখনী পরিচালনা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর
দাবীতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার
একজন দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক। বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধাদি প্রকাশ করে এ-সব আন্দোলনে গতি
সঞ্চার করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে
আন্দোলন সংঘটিত হয় তার একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন।
১৯৬১
সালে প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় রবীন্দ্র-জন্মশত বার্ষিকী পালনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৭
সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি-সংস্কৃতি খর্ব করার জন্য রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের
যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
তিনি
বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সভাপতি হন।
ব্যক্তিগত জীবনে “কাজী নজরুল ইসলামের” অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। নজরুল তার মোতাহার নামকে আদর করে 'মোতিহার' বলে
ডাকতেন।
রচনাসমগ্র
কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে "মুসলিম সাহিত্য সমাজ" নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল 'শিখা' নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।তিনি বাংলা একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা। কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
·
সঞ্চয়ন (১৯৩৭) (প্রবন্ধ
সংকলন)
·
নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫)
·
সেই পথ লক্ষ্য করে(১৯৫৮)
·
সিম্পোজিয়াম(১৯৬৫)
·
গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০)
·
আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪)
·
নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬)
·
প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫)
অন্যতম।
সম্মাননা
১৯৬০
সালে পাকিস্তান সরকার এবং অতঃপর বাংলাদেশে সরকার অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে
বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। সেগুলো হলোঃ
·
সিতারা-ই-ইমতিয়াজ
·
১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার
·
বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ
বেসামরিক পুরস্কার “স্বাধীনতা পুরস্কার”
·
১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ তাকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে।
·
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।
·
কাজী মোতাহার হোসেন ভবন নামে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের নতুন নামকরণ করা হয়।
দাবা খেলায়
অবদান
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
দাবাড়ু হিসেবে ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক
চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি।
১৯২৫ সালে নিখিল ভারত দাবা
প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক তৈরি হয় তার। তিনি একজন আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন দাবা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে
তাকে সম্মানিত করা হয়। দাবা খেলায় তার অনন্য অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের উদ্যোগে “কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি আন্তর্জাতিক
দাবা প্রতিযোগিতা” নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
মৃত্যু
১৯৮১
সালের ৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।