বঙ্গভঙ্গ, যুক্তবঙ্গ এবং প্রাসঙ্গিক বাতাবরণ -খোন্দকার আব্দুল হান্নান

 

অবিভক্ত বাংলার মানচিত্র


লেখক পরিচিতিঃ

[বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার আব্দুল হান্নান পেশায় প্রকৌশলী। মুক্তিযুদ্ধকালিন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রবাসে থাকাকালিন “স্মারণিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন যা ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত চালু ছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব উৎসব-১০ এ বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।]

 

অবতরণিকাঃ

একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিজয় নিয়ে আমরা এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষ। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। আমরা বাঙালি জাতি। আমরা যখন আমাদের এই সত্তার সন্ধানে ইতিহাসের বিচিত্র পথে হাঁটি সেখানে দেখি অনেক বাঁক, অনেক চরাই আর উৎরাই। এতো কিছুর মধ্যে যেটা খুবই প্রখর -- তা হলো আমাদের ভাগ হওয়া, এক হওয়া এবং ফের আবার ভাগ হওয়া। আসুন, একটু পেছনে গিয়ে আমরা অতীতের মুখোমুখি হই। আমাদের বিচিত্র এই ইতিহাসের ধারা অবলোকন করিII

 

মূল নিবন্ধঃ

কতকগুলো ঘটনার মাইলফলক ভিত্তির ডেটলাইন দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করছি:

O  কলকাতা, ১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫। বাংলাকে ভাগ করা হলো। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা। পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা আর পূর্ব বাংলার রাজধানী হলো ঢাকা।

O  দিল্লী দরবার হল, ১২ই ডিসেম্বর,১৯১১। সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঘোষণা দিলেন -ইতিপূর্বে বিভক্ত বাংলাকে এক করা হলো। পরের বছর পয়লা এপ্রিল থেকে এটা কার্যকরী হবে। ভারত সরকার কলকাতার বদলে এখন থেকে দিল্লিতে বসে কাজ করবে।

O  দিল্লী, আগস্ট ১৪ ও ১৫, ১৯৪৭। দু'টো তারিখের মধ্যবর্তী মুহূর্তে রাত বারটার এক মিনিট আগে এবং পরে পাকিস্তান ও ভারত দুটো পৃথক শব্দের নাম ব্যবহার করে ব্রিটিশ রাজশক্তি উপমহাদেশকে স্বাধীনতা প্রদান করলেন। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭। বিয়াল্লিশ বছরের হিসাব। তিনটা ঘটনার বেড়াজালে ইতিহাস সীমিত। ঘটনা যতই সংক্ষিপ্ত হোক, বর্ণনা যতই সরল-সোজা হোক, ইতিহাস অনেক আঁকাবাঁকা দীর্ঘ, চরাই-উৎরাই সম্বলিত। বহু পথ মাড়িয়ে, বহু জীবন ধ্বংস করে ব্রিটিশরাজের চিরভাস্বর সূর্যকে আটলান্টিকে ডুবিয়ে অবিরাম প্রবাহমান উপমহাদেশের এ ইতিহাস উপমহাদেশেই অবশেষে ফিরে এলোI

 

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫:

কলকাতাকে কেন্দ্র করেই বেনিয়া ইংরেজের ব্যবসা ও সেই সঙ্গে রাজত্ব গড়ে ওঠে। তারপর প্রায় দেড়শ' বছর পার হয়ে গেছে। এরমধ্যে কলকাতা একটা বন্দর শহর থেকে মহানগরীতে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ রাজত্ব বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মধ্যে সীমিত না থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ করায়ত্ব করে ফেলেছে। কিন্তু প্রদেশ হিসাবে ১৮৫৪ সন থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি একক বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট-ই রয়ে গেছে। তখন এর আয়তন কিঞ্চিতোধিক আড়াই লক্ষ বর্গমাইল বা সাড়েছ' লক্ষ বর্গকিলোমিটার। একটা প্রদেশের আয়তন হিসাবেই এটা বিশাল। ইংরেজ সরকার এটাকে কমাতে চাইলেন।

 

১৮৭৪ সনে বাংলাভাষাভাষী কিছু অঞ্চল নিয়ে যেমন সিলেট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া জেলাসহ আসাম-প্রদেশ' গঠন করা হয় এবং একজন চিফ কমিশনারের 'পর এর শাসনভার ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু প্রদেশটির আয়তন অতিশয় ক্ষুদ্র হওয়ায় এখানকার দায়িত্ব পালন সম্মান হানিকর হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৮৯৪ সনে সমস্যাটির সমাধানকল্পে একটি প্রস্তাব আসে--চট্টগ্রাম বিভাগকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। এবারে সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর আপত্তি ওঠে এবং প্রস্তাবটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।

 

যাই হোক, এসব ঘটনার ভেতর দিয়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি যেখানে এসে দাঁড়ালো তাতে তার আয়তন ১৮৯,০০০ বর্গমাইল অর্থাৎ চার লক্ষ নব্বই হাজার বর্গ কিলোমিটার। এই পরিমান আয়তনও যথাযথ শাসন-ব্যবস্থা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, নিরাপত্তা বিধান সবকিছুর জন্যেই বেশ দুঃসাধ্য কর্ম।

 

১৭৫৭ সনে কিছুটা যুদ্ধ ও তার চেয়ে অনেক বেশি ষড়যন্ত্র করে ইংরেজ বেনিয়ারা এদেশে তাদের সাম্রাজ্যের পত্তন করে। তারপর দেড়শ' বছর পেরিয়ে গেছে। ইউরোপের মানুষ রেনেসাঁ, ধর্মীয় সংস্কার, শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব – এসবের মাধ্যমে তাঁদের জীবনে মধ্যযুগ ছেড়ে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে বাঙালিরাও কিন্তু থেমে থাকে নাই। আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়ায়, স্থানীয় এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়--এসবের মাধ্যমে তারাও গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, নারীর সচেতনতা, সামাজিক সাম্য, সার্বজনীন ভোটাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে। ১৮৮৬ সনে কংগ্রেসের জন্ম হলে সভা সমাবেশ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের বক্তৃতা দেবার ও বিষয়-বস্তু উপস্থাপনের ক্ষমতা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষায় উন্নতির সাথে সাথে তাদের সাহিত্যকর্মও বাঙালিকে এমন জায়গায় এনে দিয়েছে, যেখানে বাঙালিরা আর জাতি নয়, তারা এই ভারতের বুকে একটা মহাজাতিতে পরিণত হয়েছে। লর্ড কার্জণ ভাইসরয় হিসাবে ভারতের বুকে পা দিয়েই মনোভাব ব্যক্ত করলেন--- মহাজাতি নামধারী এই বাঙালিকে ভাগ করতে হবে। তাদের শক্তি খর্ব করতে হবে।

 

যেই কথা সেই কাজ। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এগিয়ে চললো। যথোপোযুক্ত ভূমি বা প্রেক্ষাপট তৈয়ার করে নিতে হবে। লর্ড কার্জন স্বয়ং মাঠে নামলেন। তিনি ঢাকা গেলেন, ময়মনসিং গেলেন। সভা করলেন, সমাবেশ করলেন। পূর্ববঙ্গের পশ্চাদপদ মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বললেন। তখনকার অবহেলিত মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বললেন। তাদের হাতে উন্নয়নের সোপান ধরিয়ে দিবেন অঙ্গীকার করলেন।

 

ঢাকা নগরীর একচ্ছত্র অধিপতি তখন ঢাকার নওয়াব পরিবার। ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিদ্রোহ কালে ব্রিটিশের সহযোগিতা প্রদানে অসামান্য অবদান রাখায় আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ব্যবসায়ী থেকে বিত্তশালী এবং অতঃপর ঢাকার নওয়াব হয়ে যায়। নওয়াবদের পারিবারিক ব্যবসাকে আরো জোরদার করার জন্যে ব্রিটিশ রাজ এক্ষণে এঁদেরকে সামান্য সুদে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দেন। আটঘাট বেঁধে বৃটিশরাজ সেই পরম মুহূর্তের দিকে এগোলেন। ১৯০৫ এর জুলাই মাসে লর্ড কার্জণ ঘোষণা দেন পরবর্তী ১৬ই অক্টোবর থেকে বাংলা ভাগ করে দুটো প্রদেশ হবে। পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা আর পূর্ববাংলার রাজধানী হবে ঢাকা।

 

বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা হয়ে গেলো। ঘোষণা কার্যকরী হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেলো প্রতিবাদ। ২৮শে সেপ্টেম্বর ছিল মহালয়ার রাত। পরদিন কালীপূজা। কলকাতার সমস্ত এলাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনতা কালীঘাটের পূজামণ্ডপে এসে হাজির হয়। কালীকে শক্তির প্রতীক বিবেচনায় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তারা। এর বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে কালির কাছে শক্তি যাচনা করে। এই বাংলা ভাগকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দেড়শ' বছরের পুঞ্জীভূত খেদ-ক্ষোভ-আক্রোশ সব ঝরে পড়ে। সারা বাংলায় শুধু লিফলেট তৈরী করে বিতরণ-ই হয় নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ হাজার।

 

পূর্ব বাংলার এই নবগঠিত প্রদেশটাতেই প্রতিবাদ-সমাবেশের আয়োজন ঘটে প্রায় পাঁচ শ'I বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ চলতে লাগলো সমাজের সর্বস্তরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করলেনঃ

'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' [স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমানে জাতীয় সংগীত]।

তিনি প্রার্থনা বাণী উচ্চারণ করলেন --,

“বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার বায়ু বাংলার ফল

পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক হে ভগবান।

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,

বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন

এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।“

 

আন্দোলন চললো। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এ আন্দোলন। কিন্তু এর নাম স্বদেশী আন্দোলনও। বিলাতি দ্রব্য বর্জন চললো। সেই সঙ্গে চললো হরতাল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ-কর্মসূচিI বাজারে বিলেতি পণ্য চলাচল হারালো। বিলাতি মানুষের পথচলার নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। 'বঙ্গভঙ্গ-রদ' নামের এ আন্দোলন শুধু বাংলার চৌহদ্দির মধ্যে থাকলো না। ছড়িয়ে পড়লো বাংলার বাইরে --পাঞ্জাবে, মহারাষ্ট্রে, যুক্তপ্রদেশের দিল্লি, লাখনৌ, এলাহাবাদে--এমনকি সীমান্ত প্রদেশেও।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুনলেন। শয়নে-স্বপনে তাঁরা বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেলেন।

 

যুক্ত বঙ্গ ঘোষণা ১৯১১

বিলেতি পণ্য বর্জন, শ্বেতাংগ শাসক গোষ্ঠীর নিরাপত্তায় বিঘ্ন, অব্যাহত বিক্ষোভ বিদ্রোহ--সব মিলিয়ে সর্বভারতে এমন এক অরাজক পরিবেশ হয়ে গেলো যা শুধু ভারতবর্ষেই নয় বিলাতেরও সর্বমহলে আলোচনা হতে লাগলো। এমনকি ভারতের গভর্নর-জেনারেলের নির্বাহী কাউন্সিলের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সদস্য জন জেঙ্কিন্স তো বলেই বসলেন; ‘সমগ্র ভারতবর্ষের শরীরে বঙ্গ হচ্ছে একটি দুষ্ট ক্ষত, যে ক্ষত কেটে না ফেললে শরীর রক্ষা করা যাবে না’।

 

চরম এই বিরাজমান সমস্যা মেটানোর জন্যে তিনি দুই বাংলাকে এক করার পক্ষে মত দেন। নাজুক এই বিষয়টি নিয়ে ভারত সচিব ক্রু-ও একমত পোষণ করেন। এরই মধ্যে লর্ড হার্ডিঞ্জ নুতন ভাইস-রয়ের নিয়োগ পেয়ে ভারতে আসেন। অন্য ভাইস-রয়দের থেকে ভিন্ন একটি কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্য মনে নিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জের ভারতে আগমন। সেটা হলো সদ্য ব্রিটিশ-সিংহাসনে আসীন সম্রাট পঞ্চম জর্জকে ভারতের বুকে সম্বর্ধনা প্রদান। সাব্যস্ত হলো ১৯১১ সনের ১২ ই ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে এই মহাসম্বর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। এর জন্যে প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। সুতরাং প্রেক্ষাপট পাল্টে গেলো। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টালো। সাব্যস্ত হলো এই অভিষেকে সম্রাট পঞ্চম জর্জ নুতন কিছু ঘোষণা দিবেন, যার  মধ্যে অন্যতম থাকবে দুই বাংলার একত্রীকরণ, ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তর ইত্যাদি।

 

যথারীতি দিনটি ঘনিয়ে এলো। সম্রাট –সম্রাজ্ঞীর দিল্লি নগরীতে শুভাগমন ঘটলো। সুসজ্জিত দরবার হলে ব্রিটিশ রাজাধিরাজের অভিষেক। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা” সংগীত [বর্তমানে ভারতের জাতীয় সংগীত] দিয়ে রাজদম্পতীকে বরণ করা হলো। সম্রাট ঘোষণা দিলেন:

(১) দুই বাংলা মিলে এক প্রদেশ হবে।

২) ভারত সরকার এর পর কলকাতায় নয়, দিল্লিতে বসে কাজ করবে।

৩) বিহার, ওড়িশা ও আসাম অঞ্চলগুলো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তারা নিজেরাই প্রদেশ গঠন করবে।

৪) ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী শিক্ষার সুযোগ লাভে সমর্থ হবেI

 

পুণর্বার বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭

দুই বাংলা এক হওয়ার কার্যকারিতা শুরু ১৯১২ এর পয়লা এপ্রিল থেকে। এর পর এই মিলিত বঙ্গদেশ পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়েছে । এর মধ্যে ঘটনা ঘটেছে অনেক। প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৩-১৯১৭) ঘটেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ঘটেছে। ভারত শাসন আইন-১৯৩৫ চালু হয়েছে। এর ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনের রায়ে ১৯৩৭ এর পয়লা এপ্রিল এ কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন।

 

বছর চারেকের মাথায় এই মন্ত্রীসভার পতন ঘটলে এ কে ফজলুল হক হিন্দুমহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে কোয়ালিশন করে নুতন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৩ এ হক মন্ত্রিসভা ভেঙে যায় এবং খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সনের পয়লা এপ্রিল প্রধান মন্ত্রীর পদে আসীন হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

 

এখানে একটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন --১৯৩৭ থেকে পরবর্তী সাড়ে দশ বছর ধরে ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) অনুযায়ী নির্বাচিত যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী অবিভক্ত বাংলা শাসন করলেন তার একটা প্রতিফলন বাঙালির পরবর্তী ইতিহাসের উপর আমরা ভীষণ ভাবে লক্ষ্য করি। ইতিমধ্যে পৃথিবীর পরিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। উপনিবেশের অস্তিত্বে ভাটার টান পড়েছে। ভারত থেকে ব্রিটিশের বিদায়ও নিশ্চিত লক্ষ্যে স্থির হয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বিজয়ী গোষ্ঠী বিলাতের রক্ষণশীল দলের পরাজয় ঘটে গেছে। এখন লেবার পার্টি বিলাতের ক্ষমতায়। ভারতকে যত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা প্রদান করা যায় -এটাই তাদের দৃঢ় সংকল্প।

 

এইখানে একটি বিষয়কে একটু গুরুত্ব দিয়ে সম্যক উপলব্ধি করতে হবে। এটা বলা যথার্থ হবে যে ভারতীয় উপমহাদেশে যদিও হিন্দু ধর্মালম্বীরা সংখ্যাগুরু, তবুও অন্য ধর্মানুসারীরাও আছে এবং তন্মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যায় যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ১৭৫৭ এর পলাশীর যুদ্ধ থেকে ১৮৫৭ এর সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত ভারতবর্ষের একশ' বছরের ইতিহাস মানে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানো আর ব্রিটিশ বেনিয়াদের ক্ষমতা লাভের ইতিহাস। ফলে শতাব্দী শেষে মুসলিম জনগণ রিক্ত-নিঃস্ব সর্বস্ব বঞ্চিত সামাজিকভাবে নিগৃহীত এক পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী।

 

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কংগ্রেসের ভূমিকাটি সর্বভারতীয় -এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ড যদি ধর্মাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তবে সেখানকার সার্বজনীনতা আর কোনো মতেই অক্ষুন্ন থাকতে পারে না। কংগ্রেসকে নিয়ে তাই হলো। দলে দলে ভারতীয় মুসলিম জনগণ তাদের একান্ত নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে মুসলিম লীগ গড়ে নিলো। ব্রিটিশ-বিদায় পূর্ব পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ডের মাইল ফলক গুলো নিম্নরূপ:

·       ৩০ শে ডিসেম্বর,১৯০৬ ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের গোড়াপত্তন।

·       ১৯১৩ সনে মুসলিম লীগ কর্তৃক 'স্বরাজ' কে নীতি হিসাবে গ্রহণ।

·       ১৯১৬ সনে লাখনৌ এ অনুষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন, যেটা বিখ্যাত লাখনৌ প্যাক্ট নামে পরিচিত।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগ ও অম্বিকাচরণ মজুমদার কংগ্রেস বৈঠকের সভাপতি। অনেক কিছুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো কেন্দ্রীয় আইন সভায় পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থায় এক তৃতীয়াংশ মুসলিম সদস্যের আসন রক্ষিত থাকবে।

 

১৯২৮ সনে সর্বদলীয় প্রস্তাবনা আকারে ভারত শাসনের নিমিত্তে ভারতবাসীর পক্ষে কিছু দাবি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে ও জওহরলাল নেহরুর সম্পাদনায় নেহেরু রিপোর্ট নামের এই প্রস্তাবনায় মুসলিম স্বার্থ রক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মুসলিমলীগের পক্ষ থেকে মিস্টার জিন্নাহ ১৪ দফা পেশ করেন।

·       ২৩ শে মার্চ ১৯৪০ লাহোরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্তী এ কে ফজলুল হক উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ নিয়ে মুসলিম জনগণের জন্য পৃথক পৃথক সারভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

·       এপ্রিল ৯, ১৯৪৬। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের সম্মেলনে অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্তী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করেন।

 

দিল্লীর এ সভায় পাকিস্তান দাবি উত্থাপনের পর মুসলিম লীগের একটিই কার্যক্রম মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো --সেটা হলো 'পাকিস্তান' শব্দটি যত নুতনই হোক একে জনসমক্ষে পরিচিত করা এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। ভারতবর্ষের সর্বত্র মুসলিম লীগের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। পাশাপাশি মোটেও কোনো শিথিলতা না নিয়ে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ভাবে পাকিস্তান শব্দটিসহ মুসলিম লীগের তাবৎ কর্মকান্ডকে ঘিরে শ্লেষ, ভ্রূকুটি ও বিদ্রুপের বর্ষণ চলতে লাগলো।

 

এমনি পরিবেশে ১৯৪৬ এর ১৬ ই আগস্টকে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সমগ্র ভারতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (ডাইরেক্ট অ্যাকশন) দিবস ঘোষণা করা হলো। এই কর্মসূচি উপলক্ষে কলকাতার গড়ের মাঠে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। লক্ষ লক্ষ জনতার এ সমাবেশ একটি দাবির স্লোগান মুখে সভাস্থল থেকে বাইরে এগুলো।  সেটা হলো -লড়কে লঙ্গে পাকিস্তান। ঠিক এমনি অবস্থায় কলকাতার রাজপথে মিছিল আক্রান্ত হলো। আক্রমন-পাল্টা আক্রমণ চললো। দিনের পর দিন ধরে চললো। কলকাতা শহর এক ভয়াল আতঙ্কগ্রস্ত শহরে পরিণত হলো। দলে দলে লোক কলকাতা ত্যাগ করে গ্রামে নিজের ঘরমুখো পালাতে লাগলো। সবকিছুরই শেষ আছে। এ ভয়াবহ দাঙ্গাও শেষ হলো। ততদিনে অজস্র লোকের জীবন চলে গেছে। হিসাবে বিদ্যমান বিতর্ক সত্বেও নির্দ্বিধায় বলা চলে অন্তত দশ হাজার লোক এ দাঙ্গায় নিহত, পনেরো হাজার আহত এবং লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।

 

দি ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা কলকাতার এ ভয়াবহ দাঙ্গা জনমানসে একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করলো -সেটা হলো, মানুষ মানুষের পর আস্থা হারিয়ে ফেললো। ধর্মীয় বিভাজন রেখা সকল ভেদ রেখার উচ্চতা ভেদ করে আকাশ আর মাটির মধ্যে সবটুকু জায়গা নিয়ে একটি প্রাচীর তৈরী করে ফেললো, যা কারো পক্ষে আর অতিক্রম করা সম্ভব নয়। মানবপ্রেম, হাজার বছরের প্রতিবেশীর সৌহার্দ, বাঙালির প্রতি বাঙালির স্বজাত্যবোধ বা সহমর্মিতা --সব নিমেষে হাওয়ায় ভেসে গেলো।

 

এক্ষনে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে মুখত:

তিনটা রাজনৈতিক গোষ্ঠী খুব সাংঘাতিক ভাবে তৎপর ছিল। এছাড়াও তৎপরতা ছিল বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সমূহের; যেমন শিখ, খ্রিষ্টান, পারসী, বৌদ্ধ, উপজাতিসমূহ,  দেশীয় রাজন্যবর্গ ইত্যাদি। তবে দড়ি টানাটানির সতত দ্বন্দ্বে ব্রিটিশ শাসকদল, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগই ভূমিকা রেখে আসছিলো। নিঃসন্দেহে বলা চলে এই তিনপক্ষের টানাপোড়েন কোনো রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সরল সমীকরণে প্রবাহিত হয় নাই; বরং প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি জটিল ও দুরূহই বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কাছে বিবেচিত হয়েছে।

 

আবার আমরা বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসি। মোটামুটি এখানকার আবহাওয়া ভারতের আকাশ থেকে অনেক পরিচ্ছন্ন কারণ কুশীলব চরিত্র সংখ্যায় কম। কিন্তু তিনটি পারস্পরিক ভাবে সাংঘর্ষিক ইস্যু এখানে ভয়ানক মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো:

·       কলকাতার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক জনগোষ্ঠী ধর্ম ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের দাবি জানালেন এবং পশ্চিম বঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভুক্তির দাবিও পেশ করেন ।

·       বেঙ্গল মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খান, সাবেক প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ বঙ্গদেশ পাকিস্তানেরই অংশবিশেষ উল্লেখ করে তাদের ঘোষণা ব্যক্ত করেন।

·       প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দি, কংগ্রেস নেতা শরৎ বসু ও কিরণ শঙ্কর রায়, মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশেম প্রমুখ বঙ্গদেশকে ভারত ও পাকিস্তান কারো অংশে না দেওয়ার দাবি জানান এবং স্বাধীন সারভৌম প্রজাতন্ত্রী অখণ্ড বাংলা রাখার দাবি পেশ করেন।

 

এমনি একটি সাংঘর্ষিক মনস্তত্ব বাংলার গণমানসে যখন বিরাজ করছে তখন রাজনীতি আরও ক্ষিপ্র গতিতে এগোতে লাগলো। সকল ঘটনার বিস্তৃতি সন্তর্পনে এড়িয়ে আমরা চুম্বক ঘটনাগুলোকে দিনপঞ্জির শিরোনামায় সন্নিবেশ করছি:

 

·       ২৬ শে এপ্রিল, ১৯৪৭ ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের কর্মযজ্ঞ নিয়ে আগত নবনিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দির সাক্ষাৎ এবং স্বাধীন যুক্তবঙ্গের পক্ষে সোহরাওয়ার্দির যুক্তি পেশ।

·       ২৬ শে এপ্রিল কিরণ শংকর রায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও বিধান চন্দ্র রায়ের দিল্লিতে গমন, কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বঙ্গভঙ্গের সমর্থন আদায়ের জন্যে কথা বলার সিদ্ধান্ত।

·       ২৭ শে এপ্রিল অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতন্ত্ৰী বঙ্গদেশের দাবিতে দিল্লিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দির সাংবাদিক সম্মেলন। যুক্ত বঙ্গের ভবিষ্যৎ সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয়গোষ্ঠীর একক প্রভাব ক্ষুন্ন করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত।

·       ২৯ শে এপ্রিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক গভর্নর জেনারেল, নেহেরু ও প্যাটেল প্রমুখদের কাছে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব জানিয়ে পত্র প্রেরণ।

·       ৩০শে এপ্রিল ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স কর্তৃক কলকাতাসহ হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব এবং বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এ ব্যাপারে অবাঙালি বিত্তবানসহ বাঙালি শিল্পপতিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন।

·       পহেলা মে বঙ্গীয় কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ এক বিবৃতিতে বলেন, খণ্ডিত ভারতে অখণ্ড বাংলা একটা অসম্ভব বিষয়। সোহরাওয়ার্দি যদি দ্বিজাতিতত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন এবং সাম্প্রদায়িকতা পরিত্যাগ করেন তবেই তিনি বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে পারবেন।

·       ৪ ঠা মে থেকে হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগের আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তোলে।  

·       ৫ই মে আকরাম খান বিবৃতি দেন—বাংলা যদি পাকিস্তানের সাথে যোগ না দেয় তবে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য তা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।

·       ৭ই মে কলকাতার কয়েকজন বুদ্ধিজীবী যদুনাথ সরকার, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, মেঘনাথ সাহা, শিশির কুমার মিত্র, সুনীতি কুমার চ্যাটার্জী প্রমুখ কর্তৃক ভারত সচিবের কাছে সোহরাওয়ার্দি-মন্ত্রিসভার প্রতি তাঁদের অনাস্থা জ্ঞাপন এবং আলাদা প্রদেশের দাবি পেশ ।

·       ১১ই মে সোদপুরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দির সাক্ষাৎ। অখণ্ড বাংলার প্রতি গান্ধীর সমর্থনের জন্য সোহরাওয়ার্দির অনুরোধ জ্ঞাপন। প্রত্যুত্তরে গান্ধী কর্তৃক সোহরাওয়ার্দিকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার উপদেশ প্রদান ।

·       ১২ই মে শরৎ বসুর বাসভবনে সোহরাওয়ারদীর সঙ্গে শরৎ বসুর একটি সমঝোতা চুক্তি সম্পাদন যাতে উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ দৃঢ়ভাবে রক্ষার ব্যবস্থা।

·       ১৩ ই মে কলকাতা কর্পোরেশন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মত প্রদান করে।

·       ১৪ই মে আরেক বিবৃতিতে আকরাম খান বলেন-- বাংলা যদি পাকিস্তানে না আসে তবে শুধু সাড়ে তিন কোটি মুসলমানই শুধু নয়, বর্ণ হিন্দুদের শাসনের অধীনে তফসিলি হিন্দুরা চিরস্থায়ী দাসে পরিনত হবে।

·       ১৮ ই মে মি: জিন্নাহ, আকরাম খান, নুরুল আমিন, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখদেরকে জানান তিনি কখনো সোহরাওয়ার্দিকে স্বতন্ত্র বাংলা নিয়ে কথা বলতে অনুমতি দেন নাই।

·       ২০ শে মে উভয় পক্ষের প্রতিনিধি হিসাবে শরৎ বসু এবং আবুল হাশেমের চুক্তিতে স্বাক্ষর দান।

·       শরৎ বসু কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করেন যে জন্যে ২২শে মে প্যাটেল শরৎ বসুকে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় রাজনীতি থেকে সরে যেতে নিষেধ করেন।

·       ২৩শে মে শরৎ বসু মহাত্মা গান্ধীর কাছে যুক্তবঙ্গের সমর্থন চেয়ে পত্রপ্রেরণ করেন। উত্তরে গান্ধী জানান, তিনি বিষয়টি কংগ্রেস কমিটিতে উত্থাপন করবেন।

·       ২৭শে মে শরৎ বসু বলেন, সমগ্র বাংলার সকল হিন্দুর অধিকাংশই বাংলাভাগের বিরুদ্ধে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই বিভক্তির জন্যে আমাদেরকেই দোষারোপ করবে।

 

বাংলা-ভাগ ও যোগের তাবৎ রাজনীতির ঘটনা-প্রবাহের মোটামুটি শেষপর্যায়ে আমরা এসে গেছি। ভাগ-যোগের ব্যাপারটার সঙ্গে হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের সামাজিক সম্পর্কের বিষয়টিও ভীষণ ভাবে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে কিছু তথ্য এখানে সন্নিবেশ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।

 

এটা ঠিক এই বাংলায় এক সময়ে কোনো মুসলমান ছিল না। চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বন্দর থাকার কারণে ইসলামের শুরু থেকেই কিছু কিছু মুসলমানের এখানে আগমন ঘটতো এবং তারা অনেকে এখানে স্থায়ী নিবাসও গড়ে তোলে। ব্যাপক ভাবে মুসলিম বসবাস শুরু ১২০৩ সনে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বাংলা দখলের পর। সেখান থেকে শুরু করে পরবর্তী সাড়ে পাঁচশ' বছর রাজত্ব করলেও তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই প্রতিনিধিত্ব করেছে। প্রথম এই বাংলায় তারা সংখ্যা গুরুর মর্যাদা পেলো ১৮৮১ সনের আদম শুমারিতে।

 

১৯০৫ সনের বিভক্ত বাংলা সম্রাট পঞ্চম জর্জের এক নির্দেশে এক হয়ে গেলো। এটাতো প্রশাসনিক একত্রীকরণ। কিন্তু বাংলার বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী তো হিন্দুদের তুলনায় একেবারেই পশ্চাদপদ। সেই সময়ের কংগ্রেস নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং হিন্দু মুসলিম উভয়ের অবস্থান সমতা ভিত্তিক করার কথা বলেন।

 

“মুসলিম জনতা সরকারি চাকুরী থেকে বঞ্চিত। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবেশ করতে পারে না; উকিল-ডাক্তার-শিক্ষক -এসব পেশাজীবীদের মধ্যে কোনোই প্রতিনিধিত্ব নাই। দেশের উন্নতি করতে হলে হিন্দুর সঙ্গে মুসলিমদেরও নিয়ে করতে হবে। সমস্যার সমাধানকল্পে তিনি তাঁর বিখ্যাত বেঙ্গল প্যাক্ট বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটিতে পেশ করলেন (১৬-১২-১৯২৩)। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিন চ্ন্দ্র পাল- বিখ্যাত জাঁদরেল কয়েকজন নেতার বিরোধিতা সত্বেও প্রায় সব কংগ্রেস নেতা বাংলা থেকে তাঁকে সমর্থন দেন। এঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শরৎ বসু, সুভাষ বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, কিরণ শংকর রায়, ডাক্তার বিধান রায় প্রমুখ। ইতিমধ্যে অক্সফোর্ড থেকে সদ্যাগত তরুণ ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে কর্মকান্ড শুরু করেছেন। মুসলিম সম্প্রদায় বেঙ্গল প্যাক্টকে স্বাগত জানায়। এ প্রসঙ্গে এ কে ফজলুল হক,মাওলানা আকরাম খান উল্লেখযোগ্য।“

 

যথারীতি বেঙ্গল প্যাক্ট-কে নিয়ে দেশবন্ধু সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে গেলেন। কংগ্রেসের কেন্দ্রে তখন চরম গ্রুপিং। গান্ধী বনাম দেশবন্ধু। বেঙ্গল প্রাদেশিক কংগ্রেসে কমিটিতে প্যাক্টক্টি অনুমোদন পেলেও কেন্দ্রে গিয়ে এটা তোপের মুখে পড়লো। কোকোনাদা বার্ষিক সম্মেলনে(ডিসেম্বর ১৯২৩) প্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত হলো। ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে দেশবন্ধু বাংলায় ফিরে এলেন। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গেলো। অপরিণত বয়সে ভগ্নহৃদয়ে তিনি মৃত্যুর দ্বারস্থ হলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বেঙ্গল প্যাক্ট অথবা হিন্দু-মুসলিম সমন্বিত-রাজনীতি কিংবা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান বোধ হয় চিরদিনের জন্যেই মুখ থুবড়ে পড়লো।

 

এই বাংলার ভাগের কথা বলতে বলতে অনেকদূর এসে গেলাম। একটু পেছনে গিয়ে বেঙ্গল প্যাক্টের অঙ্কুরেই বিনাশ হওয়ার কাহিনীও বর্ণনা করেছি। ভাগ ছেড়ে একটু যোগের কথায় আসি।

 

আসাম প্রদেশের কিছু জায়গায় মুসলিম জনসংখ্যা বেশি। যাচাই করতে হবে তারা পাকিস্তান চায় কিনা? সুতরাং রেফেরেন্ডম বা গণভোট প্রয়োজন। সোহরাওয়ার্দি সাহেব কলকাতা থেকে তাঁর বিশাল কর্মীবাহিনী পাঠালেন। খাবার-দাবার পথ-খরচ এসবের ব্যবস্থা করলেন। সার্বিক আয়োজনে ও ব্যবস্থাপনায় তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিব।

 

ভোট হলো। সিলেটের মুসলমানরা পাকিস্তানের নুতন ঠিকানায় অর্থাৎ শতবর্ষ পূর্বে (১৮৫৩ এ) ছেড়ে যাওয়া বাংলায় আবার ফিরে এলো। এই সময় একটি চমৎকার ঘটনা ঘটলো। সিলেটের গণপরিষদ সদস্যরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েই সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁরা তাঁদের জেলা থেকে নুতন প্রাদেশিক সরকারে দুটো মন্ত্রী চাইলেন। সোহরাওয়ার্দি সাহেব রেগে গেলেন। তখনকার দিনে বৃহত্তর একটি জেলায় একটি মন্ত্রীও পায় না। সারা বাংলায় মন্ত্রীর পরিমান দশ কি বারো। সেখানে এক জেলার দাবি দুই। এটা অসম্ভব এবং অযৌক্তিক। যাই হোক সাক্ষাৎকার ব্যর্থ হলো।

 

সিলেটি সদস্যরা যিনি রেফারেন্ডামে বিন্দুমাত্র অবদান রাখেন নাই, তাদের জেলার মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে এবার তাঁর কাছে গেলেন-- তিনি খাজা নাজিমুদ্দিন। তাঁর কাছে প্রস্তাব করা মাত্র তিনি দুটো মন্ত্রী দিতে রাজি হলেন। এর পর খুবই সোজা হিসাব। সিলেটি সদস্যদের ভোটগুলো পেয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। আর সোহরাওয়ার্দি সাহেব অখণ্ড স্বাধীন বাংলা দাবি তুলে ব্যর্থ হলেন। এর পরই সিলেটকে ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানে এনে ঐ জেলার সদস্যদের আস্থাবঞ্চিত হয়ে আরেকবার ব্যর্থ হলেন। ভারতে অবস্থানরত সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের তখন বড় দুর্দিন। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি গান্ধীর শান্তি মিশনে যোগ দিলেন। যাই হোক, এই ঘটনা এখানেই শেষ নয়। একটু হলেও আরো খানিকটা বাকি আছে।

 

পরিষদের আস্থা অর্জন করে খাজা সাহেব মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তিনি তখনি সিলেট জেলা থেকে একটা মন্ত্রী নিলেন। অন্য সদস্যরা প্রথমে ক্ষুন্ন হলো; এরপর ক্ষুব্ধ হলো। নাজিমুদ্দিন তাদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে বললেন। একদিন ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেলো। তারা সদলবলে জিজ্ঞেস করলো তাদের দ্বিতীয় মন্ত্রী কবে নেওয়া হবে। নাজিমুদ্দিনের সরল উত্তর-একটাতো আমি নিয়েছি; আরেকটা তোমরা দাও। পরে আর কোনোদিনও ওই সদস্যরা দ্বিতীয় মন্ত্রীটি কে হবেন তা নির্ণয় করতে পারেন নাই।

 

আবার আমরা ফিরে আসি ব্রিটিশ রাজ্যের বিদায়ের মুহূর্তে এই বাংলায়।

মারমুখো কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ কেমন এক জাদু প্রক্রিয়ায় একটি সাধারণ সূত্রে নিশ্ছিদ্র ঐক্যে পৌঁছলো এটা এতো বছর পর ভাবতে অবাক লাগে। সে সূত্রটি হলো বাংলা ভাগের প্রশ্নে। মুসলিম লীগ বঙ্গীয় মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান চায়; বঙ্গীয় কংগ্রেস এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসও তাদের বাংলায় মুসলিম বর্জিত শাসন চায়। সুতরাং দুই ভিন্ন ধারা এক জায়গায় এসে মিললো --সেটা বাংলার বিভক্তি। সেখানে দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) অথবা বসু-সোহরাওয়ার্দির স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড সমাজবাদী বাংলার পরিকল্পনা (১৯৪৭)--এ সবকিছুই বঙ্গপ্রেমের নিষ্ফল ক্রন্দনের মতোই শুনালো। এমনকি রবীন্দ্রনাথের --

"বাংলার ঘরে যত ভাই-বোন

এক হউক, এক হউক, এক হউক, হে ভগবান"—

১৯০৫ সনের এই প্রার্থনা সংগীতও সকল আবেদন-মূল্য হারিয়ে একান্তই বর্জ-পদার্থে পরিণত হলো। এবং তারপর যা হবার তাই হলো; বাংলা আবার ভাগ হলো।

 

উনিশ শ' সাতচল্লিশ সন-আগস্ট মাস -১৪ তারিখে পূর্ব বাংলা আর ১৫ তারিখে পশ্চিম বাংলা ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হলো। অর্থাৎ আমরা স্বাধীন হলাম। 'মুসলমানরা ভাই-ভাই' স্লোগানে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে হাজার মাইলের ব্যবধান নিয়ে, ভাষা-খাদ্য-চেহারা-পোশাক-ইতিহাস-ভূগোল আলাদা নিয়ে একসঙ্গে পথ-চলা শুরু করলাম। চব্বিশ বছর চললো।

 

ব্রিটিশের উপনিবেশে আমরা নিগৃহীত ছিলাম কিন্তু তখন আইনের শাসন ছিল। এবারে আসলো সামরিক আইন--পৃথিবীর কোনো যুক্তি তর্ক সভ্যতা-ভব্যতার আইন নয়। আমরা নিষ্পেষিত হলাম এবং হতে লাগলাম। চব্বিশ বছরের শেষে শুরু হলো ওদের মরণ কামড় -হায়েনার হিংস্র আক্রমণ। মরণ-পণ যুদ্ধ করে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হলাম। আর আমাদের পড়শী ভাইয়েরা। হাজার বছরের সাথী। একসাথে জন্মে' একসাথেই বড় হয়েছি। সাতচল্লিশে ডাকলাম, বললাম চলো একসাথে আমরা থাকি। সূখে-দুঃখে মিলে-মিশে চলবো। তারা পুব ছেড়ে পশ্চিমে গেলেন।

 

ইতিহাস থেকে আমরা জানি প্রাচীন ভারতের বৈদিক সভ্যতার বইয়ের পাতায় এই বঙ্গের কোন সম্মানজনক অবস্থান নেই; জনপদ তালিকায় বঙ্গের নামটি পর্যন্ত নেই। প্রথম বঙ্গের নাম আমরা উল্লেখ পাই জৈন সূত্রে 'ব্যাখ্যাপ্রজ্ঞাপ্তি'তে। তারপর বঙ্গের সম্রাট গঙ্গাহৃদয়, পাল সম্রাটগণ, সেন রাজারা সুনামের সাথে মাথা উঁচু রেখে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

 

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের উজ্জ্বল পাতা থেকেই জানি সুবর্ণগ্রাম, সপ্তগ্রাম ও লক্ষণাবতী এই রাজধানীগুলোকেন্দ্রিক খণ্ডিত ও বিক্ষিপ্ত বাংলাকে এক করেন 'শাহ-ই-বাংলা' শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৫২-১৩৫৮)। তিনিই ইতিহাসের মহানায়ক যিনি সমগ্র বাংলার প্রথম সম্রাট এবং বাংলা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। বাংলার প্রতি পশ্চিমাদের মারাঠি-বর্গীদের আচরণ এক ঘুমপাড়ানি গান উচ্চারণ করলেই বুঝা যায়:

"ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে?

ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনার উপায় কি?

আর ক'টা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি।"

 

আমরা কি ভুলে গেছি নবাব আলীবর্দী খান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা কিভাবে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বাংলার নিরীহ মানুষের যান-মাল বর্গীর হামলা থেকে রক্ষা করেছেন?

 

যে বাংলাকে নিয়ে এতো সাহিত্য, এতো কবিতা, সেই বাংলার সবকিছু ভুলে গিয়ে আমাদের পড়শী-ভাইরা পশ্চিম মুখী হয়ে গেলেন। কিন্তু কি লাভ হয়েছে তাদের? আগে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের একটি করে সভা হতো অবিভক্ত বাংলার যুগে। এই বঙ্গসন্তানই সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন ডজন খানেক নেতার সন্ধান নিকট অতীতের ইতিহাসে মিলে। আর এখন --সাতচল্লিশের পর একটা সভাপতির নামও তো খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

বলতে বলতে অনেক কথা এসে গেলো। এবারে ব্রিটিশদের নিয়ে একটা কথা বলি। তারা আমাদের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে রাজ্য নিলো। মুর্শিদাবাদ থেকে নিলো। ফেরত দিলে তো মুর্শিদাবাদকেই দিবে; দিল্লি-করাচিকে তো নয়।

তারপর সময়ের হিসাবের কথা বলি;

দেখেছি তো পৃথিবীর বিখ্যাত বন্দরগুলো তারা যখন দখলে নিয়েছে, একে একে তাদেরকে ফেরত দিয়েছে। যেটা আগে নিয়েছে সেটা আগে ফেরত দিয়েছে। সে হিসাবে দিল্লি দখলের একশো বছর আগে মুর্শিদাবাদ দখল তারা করেছিল। তাহলে তো দিল্লির একশো বছর আগেই তো মুর্শিদাবাদের স্বাধীন হওয়ার কথা। একরাতে একসাথে তো হওয়ার কথা নয়। ব্রিটিশরা আইন মেনে চলে, রীতি-নীতি রক্ষা করা তাদের দৈনন্দিন কার্যাভ্যাস। অথচ আমাদের বেলায় কোন কিছুই দেখলাম না।

 

লেখার একেবারেই শেষে এসে গেছি।

আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি বাঙালিরা ভাই ভাই, সাতচল্লিশে আমাদের পড়শী-ভাইরা এক উন্নাসিক দৃষ্টি মেলে পশ্চিমমুখী হলেন আর আমাদেরকে বর্জন করলেন। আমরা আমাদের মুসলমান ভাইদের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম; পথ-চলা শুরু করলাম। চব্বিশ বছর চললাম। এই চব্বিশ বছরে চব্বিশ হাজার নরকের যন্ত্রনা ভোগ করলাম। তারপর পাঁজরের হাড় সম্বল করে ঘরে ফিরলাম। মনে মনে আবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করলাম এবং উচ্চারণ করলাম:

"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥

যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা,

যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—

তবে পরান খুলে……

ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥

যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—

তবে পথের কাঁটা……

ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥

যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে-

তবে বজ্রানলে……

আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে ।।"

           ---: সমাপ্ত :---

আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।I

লেখকঃ খোন্দকার আব্দুল হান্নান (Khoandkar Hannan

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url