বাংলা বিহার উড়িষ্যার পরাধীনতা - ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাস
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার
স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিলো মুন্নী নামক এক নটীর (নর্তকী) কারণে,- যদিও ঐতিহাসিকগণ
এবং আমরা দায়ী করি ঘষেটি বেগমকে।
মুন্নীর পরিচয়
মুন্নীর
জন্ম উত্তরপ্রদেশের সিকান্দার বলকুন্দায়। ছোটবেলায় তার মা তাকে বিশু নামের এক নর্তকীর
কাছে বিক্রি করে দেন। বিশু মুন্নীকে নাচ শেখান এবং মুন্নীকে তার নাচের দলে অন্তর্ভূক্ত
করেন। মুন্নী দলবল নিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজকীয় বাড়িতে নেচে বেড়াতেন, রাজসভায় নাচতেন।
তিনি তার সৌন্দর্য এবং দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
মারাঠাদের
বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে মীরজাফর খ্যাতি লাভ করে। ধীরে ধীরে নবাব আলীবর্দী খাঁ’র সাথে
তার সখ্যতা বাড়তে থাকে। নবাব তাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানম সাহিবাকে তার সাথে বিয়ে
দেন।
নিজের
চেয়ে উঁচু পরিবারে বিয়ে করলে অধিকাংশ পুরুষের অবস্থা হয় ‘ফান্দে পড়া বগার’ মতো।
মীরজাফরের অবস্থাও হয়েছিলো সেরকম। আলীবর্দী খাঁ’র বোন শাহ খানম চোখে পড়ার মত অতো
সুন্দরী ছিলো না। তার চেয়ে মহলের দাসীরা অধিক সুন্দরী ছিলো।
মীরন
এবং ফাতিমার জন্মের পর থেকে প্রায় সময়ই শাহ খানম অসুস্থ থাকতেন। “অসুস্থ ঘোড়ায়
চড়ে রাস্তা পার হওয়া যায়, কিন্তু যুদ্ধ জয় করা যায় না”। অসুস্থ স্ত্রী নিয়ে সংসার
করা গেলেও কামনা পূরণ সম্ভব নয়।
আলীবর্দী
খাঁ’র তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই হাজী আহমেদের তিন ছেলের সাথে। এর
মাঝে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম ছিলেন নিঃসন্তান।
তিনি
আমিনার ছেলে সিরাজউদ্দৌলার ভাই একরামুদ্দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলেন। একরামুদ্দৌলার
বিয়ের উৎসবে জৌলুস বাড়ানোর জন্য নটীর দল আনা হয়। ঐ নটীদলের সদস্য ছিলো মুন্নী
বাঈ।
একরামুদ্দৌলার
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে পরবর্তীতে আরো অনুষ্ঠান পাওয়ার আশায় নটীর দল মুর্শিদাবাদে
থেকে যায়। অসম্ভব সুন্দর দেহবল্লবীর অধিকারিণী ছিলো মুন্নী বাঈ।
তার রূপ
মাধুরী আর নুপুরের নিক্কনে মহলের যুবা-বৃদ্ধ অনেক পুরুষেরই অন্তরে কাঁপন ধরে। সুন্দরী
মুন্নী বাঈ আলীবর্দী খাঁ’র প্রধান সেনাপতি মীর জাফরেরও নজর কাড়ে। মীরজাফর প্রায়ই
জলসা ঘরে গিয়ে মুন্নী বাঈয়ের সাথে খোশগল্প, ফূর্তিতে মেতে উঠতেন।
"কাম
হতে হয় প্রেমের উদয়, প্রেম হলে কাম থাকে না", মীরজাফরের জীবনে যেন এর
বাস্তবরূপ পাওয়া যায়। কাম বাসনা চরিতার্থ করার জন্য মীরজাফর মুন্নীর জলসাতে গেলেও
এক সময় প্রেমে পড়ে যায়।
মীরজাফরের
মরু হৃদয়ে সে যেনো এক বহতা নদী। কিন্তু সে নদী যে যেকোনো সময়ে গতিপথ বদল করতে
পারে,- তাই সে দখল করতে চাইলো।
তৎকালে
রাজা, বাদশাহ, শাহজাদা, আমত্যদের জন্য ইন্দ্রিয়বিলাস দোষের কিছু ছিলো না। কিন্তু
তখনকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অভিজাত শ্রেণীর পুরুষেরা দাসীদের বিয়ে করতে পারলেও রং
মহলের কোনো নটীকে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না।
দাসীদের
মর্যাদা অনেকটা বর্তমান সময়ের গৃহকর্মীর ন্যায়; আর নাচনেওয়ালী নটীদের মূল্য
পতিতাদের চেয়ে বেশি না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়ও অনেকে গৃহকর্মী বিয়ে করলেও পতিতাকে
সহজে বিয়ে করে না।
মুন্নী
বাঈ মীরজাফরের কাছে শাহ খানমের চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠলেও তাকে বিয়ে করে সমাজকে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মত হিম্মত মীরজাফরের ছিলো না। কারণ,
একেতো সে
নবাবের ভগ্নিপতি, অন্যদিকে প্রধান সেনাপতি। তার নিজস্ব কোনো ঘরও নেই যে মুন্নীকে
বিয়ে করে সে ঘরে তুলবে। বোনকে দেওয়া নবাবের জাফরাগঞ্জ মঞ্জিল ছিলো তার বাস।
সুতরাং
মুন্নী বাঈকে ঘরে তোলার স্বপ্ন বুকে মাটি চাপা দিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া তার সামনে
আর কোন পথ ছিলো না।
নবাব
আলীবর্দী খাঁ'র মৃত্যু এবং সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে আরোহন তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন
করার পথ সুগম করে দেয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র পনেরো মাস মসনদে ছিলেন।
পলাশীর
যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর সে তার খায়েশ পূরণ
করে বাংলার নবাব হয়ে।
সকল লোক
লজ্জাকে পায়ে ঠেলে পঁয়ষট্রি বছরের বৃদ্ধ নবাব মীর জাফর আলী খাঁ এক নটীকে বিয়ে করে।
মীরজফরই
প্রথম ব্যক্তি যিনি নটীকে বেগমের মর্যাদা প্রদান করেছেন। শাহজাদা সেলিমের প্রেম
যেখানে ব্যর্থ, মীরজাফরের প্রেম সেখানে সফল। তার এই প্রেম কাহিনী নিয়ে অমর প্রেমের
গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচিত হতে পারতো।
প্রেমিক
প্রবরদের কাছে সে হতে পারতো আদর্শ। কিন্তু তা হয়নি। কারণ যেভাবে সফল হয়েছে সেভাবে
সফল হওয়া লোকদের মানুষ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঘৃণাই করে।
পরে
মীরজাফর রব্বু বাঈ নামে আরেক নটীকে বিয়ে করে এবং রাহাতুন নিসা বেগম নাম্মী একজনকে
মুতাহ বিয়ে করে (ক্ষণিকের নবাব হলে কতো সাধ আহ্লাদই না মেটানো যায়!)।
উল্লেখ্য,
মীর জাফরের মৃত্যুর পর মুন্নী রবার্ট ক্লাইভেরও ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং তার
ছেলে নাজিমুদ্দিন আলি খানের মসনদে আরোহণ নিশ্চিত করেন। বিনিময়ে লর্ড ক্লাইভকে
তিনি অর্ধ মিলিয়ন রূপী ঘুষ দেন। মুন্নী নবাব পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা
সদস্য হয়ে ওঠেন। তিনি রাজকীয় পরিবারের এস্টেট এবং বেতন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।
তার পুত্র নবাব হওয়ায় তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মীরজাফরের
মৃত্যুর পর থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই দুই নটীর গর্ভজাত সন্তান
এবং তাদের উত্তরাধিকাররা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিলো।
কিন্তু
তাদের নিয়ে ঐতিহাসিকদের কাছে না তেমন তথ্য পাওয়া যায়, না জনগণের মুখে কোনো কথা
শোনা যায়।
কারণ, “নটীর
পোলাদের” নিয়ে মাথা ঘামিয়ে ঐতিহাসিকগণ বা জনগণ সময় নষ্ট করতে চায়নি। “নবাবের আসনে
শতবছর আসীন থাকলেও নটীর পোলা নটীর পোলাই থাকে”।
জাফরগঞ্জ কবস্থানে মুন্নী বেগমের সমাধী
লেখক : আনোয়ার হোসেন
সৌজন্যে : বিপ্লব কুমার দে
(পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত)