জীবনযোদ্ধার রোজনামচা (১২ জানুয়ারি ২০২৪)
ছোটবেলায় শুনতাম ঢাকায় ৫২ বাজার ৫৩ গলি। এখন সে প্রবাদ বিলীন হয়ে গেছে।
তো ঢাকায় এলে অলিগলিতে হেঁটে বেড়াতাম। ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে কিছুদিন
ঢাকার বিজয়নগরে যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার বাসায় অবস্থান নিয়েছিলাম। তখন রাজনৈতিক
কারণে অনেকেই সে বাসায় আসা-যাওয়া করতো। আমাদের রাজবাড়ীর মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের
অনেকেই ঢাকায় এলে সেই বাসায় সেলটার নিতো। আবার আমাদের এলাকার ১৯৭০ সালে নির্বাচিত
এমপি (তখন বলা হতো এমপিএ অর্থাৎ মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল এসেম্বলী), ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত
এমপিও মাঝেমাঝে আসতেন। কারণ যুবলীগের নেতা হলেও কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দুতাবাসে ছিলো
তার কর্মস্থল এবং প্রবাসী সরকারের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এ কারণেই তারা
আসতেন।
আমি ছিলাম নেতার একদম কাছের লোক। একই গ্রামে খুব কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায়
ছোটবেলায় একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। তবে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র
এবং খুব ভালো ছাত্র। তিনি চতুর্থ ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন নাই।
সরাসরি তৃতীয়শ্রেণী থেকে পঞ্চমশ্রেণী পঞ্চমশ্রেণী থেকে সপ্তমশ্রেণী। তারপরও তার রেজাল্ট
ছিল খুবই ভালো। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে প্রকৌশল ও কারিগরী
বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট)-এ ভর্তি হন। তিনি সব সময় সরকারি বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া
করেছেন। বুয়েটে অধ্যয়নকালিন তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন।
১৯৬৯ সালে বুয়েটের পড়ালেখা শেষ করে বের হন এবং ভালো রেজাল্ট করায় ১৯৭১
সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে যাওয়ার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে
যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করার কারণে সে সুযোগ গ্রহণ করেননি।
‘ধান ভানতে শিবের গীত’! যাইহোক, তার বাসা তখন ছিলো একটা সরাইখানার
মতো।
তো সেখানে থাকতে সারাদিন দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলার বাণী
মুখুস্ত করতাম। সেগুলো পড়া শেষ হলে অতঃপর ইংরেজি পত্রিকা অবজারভারের বাছাই করা দুয়েকটি
কলাম যতোটুকুই বুঝতাম, পড়তে বাদ দিতাম না। আর দিনভর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন
সদরঘাট তো একদিন ওয়াজঘাট, একদিন ইসলামপুর তো একদিন মিটফোর্ড-আর্মানিটোলা, একদিন গেন্ডারিয়া,
একদিন নারিন্দা, হাটখোলা, টিকাটুলি, এদিকে ফার্মগেট - ইত্যাদি জায়গায় পায়ে হেঁটে ঘুরে
বেড়াতাম। রাত হলে নেতা বিভিন্ন মন্ত্রী কিংবা যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মণি’র বাসায়
যেতেন। আমরা নেতার সঙ্গ দিতে বাসার নিচে বসে আড্ডা দিতাম। কখনো কখনো নেতার ভাঙাচোড়া
গাড়ী রাস্তায় বন্ধ হয়ে গেলে নেমে নেতার সাথে ধ্বাক্কাতাম! তবে কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের
খবর জানতে পারলে আমাকে কেউ খুজে পেতো না। তা উপভোগ করতে সেখানে চলে যেতাম। সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের বার্তা জানার পরও সে অনুষ্ঠানে যাইনি, এমনটা মনে পড়ে না।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের সাহায্যার্থে আমেরিকায় চ্যারিটি
শো’র আয়োজক বিশ্যখ্যাত সেতার বাদক ওস্তাদ রবীশংকর, নজরুল সংগীতের অনেক গানের সুরকার
বিখ্যাত নজরুল শিল্পী ফিরোজা বেগমের স্বামী কমল দাশগুপ্তের অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য
হয়েছিলো। আমি নিজেও ১৯৭৩ সালের ২৬শে মার্চ যুবলীগ কর্তৃক আয়োজিত ট্রাক মিছিলে দ্বেশাত্ববোধক
কোরাস গানে অংশ নিয়েছিলাম। এখন যেমন মোবাইলে গান ছড়ে লাউড স্পিকারে দিলেই হয়ে যায়,
তখন সে সুযোগ ছিলো না।
এখনো ঘুরতে ইচ্ছে করে। শহরে আমি হেঁটে ঘুরতেই স্বাচ্ছন্দ পেতাম, কিন্তু
আজকাল মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায়না। সড়কে নামলেই যানবাহন, বিশেষ করে রিক্সা আর মটরসাইকেলের
উৎপাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হয়।
সরকারের উচিৎ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে জনশক্তি রপ্তানিতে জোর দেয়া।
আজকাল জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ ব্যয় করা নিরর্থক। কারণ দম্পতিরা নিজেরাই এখন অনেক
সচেতন।
আজকাল কিছুকিছু দেশ তাদের দেশের বিস্তর অনাবাদী ও জনশূন্য জায়গা পূরণ
করতে বিদেশীদের আহবান করে থাকে, সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন ও কৃষিপন্য উৎপাদন করার জন্য।
সরকার কিংবা বিত্তশালীরা উদ্যোগ নিয়ে সে সব দেশে কৃষি খামার গড়ে তুলতে পারে। দেশ
থেকে লোকজন নিয়ে সেখানে কাজে লাগাতে পারে। ইতোমধ্যে আফ্রিকার দুয়েকটি দেশে বাংলাদেশের
লোক গিয়ে কৃষি ফার্ম করেছে বলে শাঈখ সিরাজের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেনেছি। এ ধরণের কাজে
যারা পারদর্শী তাদের সে সব দেশে যাওয়ার মতো হয়তো আর্থিক সঙ্গতি কিংবা উপায় জানা নেই।
এ বিষয়ে পৃষ্ঠকতা পেলে অনেকেই হয়তো যেতে চাইবে।
যাইহোক; সারাদিন ঘরে বসে থেকে সময় কাটে, তাই একটু হাঁটাহাঁটি করার
প্রয়োজন পড়ে; তাই বিকালে কিংবা সন্ধ্যার পরে বের হই। তখন বাসার কাছাকাছি কোন স্থানে
ঘোরাফেরা করা ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। উন্মুক্ত জায়গা যেমন; রমলা পার্ক যেতে হলে সকালে
যেতে হয়। কারণ, রাতে তো আর সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থে
যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙ্গে না। এটা ছোট বেলার অভ্যাস। বেশি রাতে ঘুমানো,
বেশি বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা।
তো আজও বেরিয়েছিলাম। আজ ভাবলাম যে, মালিবাগ থেকে রামপুরা পর্যন্ত
রাস্তায় কয়টা ইউটার্ন আছে, একটু স্বচক্ষে দেখে আসবো😀। সেই মোতাবেক রাস্তার পূর্বপাশের
ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু লোকের ভিড়ে এগুনো মুশকিল। লোকজন কেউ শৃঙ্খলা মেনে
চলে না। রিক্সা, যানবাহনের মত বিশৃংখলভাবে চলাচল করে। নিজের সুবিধাটা আগে আদায় করে
নিতে চায়। অন্যকে সুযোগ দিতে চায় না। নিচে তার সামান্য চিত্র সম্বলিত ভিডিও:
ফেরত আসার সময় এলাম রাস্তার পশ্চিম পাশ দিয়ে। আসার সময় দেখলাম রামপুরা
বাজারের সামনে ফুটপাত এবং রাস্তার কিছু অংশ জুড়ে ফলের দোকান। ব্যস্ত রাস্তায় ভ্যান
দোকান তো আছেই। অবশ্য রামপুরা বাজারটা যে জায়গায় অবস্থিত, এমন জায়গায় বাজারই থাকা উচিৎ
না।
চলতে চলতে একটা জিনিষ খুজতে এক দোকানে ঢুকেছি। দোকানে এক লোক বসে আছে।
সে ক্রেতা না দোকানের লোক জানিনা। আমি দোকান পরিচালকের কাছে যাবো। কিন্তু সে রাস্তা
ব্লক করে ঠ্যাঙ্গের উপর ঠ্যাং দিয়ে লোকটা এমনভাবে বসে আছে, আমার যাওয়ার সুযোগ নাই।
তার কাছে এগিয়ে গেলে তার উচিৎ ছিলো পা টা নামিয়ে আমাকে একটু যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া,
যেমনটা আমি নিজে করে থাকি। কিন্তু তিনি তা করলেন না। হয়তো তার শিক্ষায় এটা নেই। আমি
আমার ডান পা টা উঁচু করে তার পা ডিইয়ে আমার পা মাটিতে ফেলার সময় তার পায়ে ঠাস করে
একটা গুতা মারলাম। তারপর দোকান পরিচালকের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক হকচকিয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে তার দিকে তাকানো না দেখে নজর নামিয়ে নিল। হয়তো বুঝতে পেরেছে,
আমারই ভুল হয়েছে। আপনারা আবার মাঝখান দিয়ে অন্যকিছু ভাইবেন না(!)।
যাইহোক; অন্য একটা প্রয়োজনে আবার রাস্তার পূব পাশে গেলাম। সেখানে
কাজ সেরে মোড় দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বাস এগুনো পিছানো করছে, কিন্তু প্রকৃত
এগোচ্ছে না। প্যাসেঞ্জার উঠানোর জন্য অমন করছে। আমি যেই তার সামনে দিয়ে রাস্তা পার
হওয়ার জন্য হাঁটা দিয়েছি, সেই বাসের পাশ দিয়ে অন্য গাড়ি এসে পড়ায় আমি যেতে পারছি
না, দাঁড়িয়ে গেছি। সে গাড়িটা হেঁচকা টান দিয়ে আমার কাছে এসে হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে
মুখ ঝাঁকিয়ে কি যেন বলছিল। আমি ঘুরে গিয়ে বাসে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, তুমিকি আমার উপর
দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে চাও?
সে অন্যদিকে তাকিয়ে বকবক করতে থাকলো। যাত্রীদের নিরব প্রতিক্রিয়ায়
বুঝতে পারলাম, তারা আমার বিষয়টা লক্ষ্য করেছে এবং আমার প্রতি সমর্থনসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়েছে।
হাঁটা সমাপ্ত করে বাসায় এসে এক কাপ চা খেয়ে (পান করে) লিখতে বসেছিলাম।
কিন্তু সময়মতো পোষ্ট করতে পারিনি।