বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৪৮) – পাকিস্তান
বেনজির ভুট্টো – (খন্ড ১০ এর ৯)
বেনজির ভুট্টো |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে
সমর্থন করেছিল, কারণ তারা তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেছিল- বিশেষ
করে আফগানিস্তান যুদ্ধে। কিন্তু তারা ধীরে ধীরে মোশাররফের সফলভাবে শাসন করার ক্ষমতার
উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মোশাররফের অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা ছিল না।
২০০৭-এর মাঝামাঝি একটি জরিপে সে মাত্র ২৬% রেটিং পেয়েছিলো। ২০০৭
সালে মোশাররফ বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় যা আইনজীবীদের আন্দোলন নামে পরিচিত
ছিল। পাকিস্তান লাল মসজিদ অবরোধের মতো ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সহিংসতার ক্রমবর্ধমান
মাত্রার সম্মুখীন হয়েছিল। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৬ সালে ৪৪টি এবং ২০০৭
সালে ৮টি আত্মঘাতী বোমা হামলা সংঘটিত হয়েছিল। মার্কিন সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে বেনজির
ভুট্টোকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখছিল, যিনি পাকিস্তানের
অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারেন। তবুও তারা একটি ক্ষমতা
ভাগাভাগি চুক্তি চেয়েছিল। মোশাররফকে তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটি
গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে বিবেচনা করে ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করতে
চায়নি।
সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি-জেনারেল লুইস আয়ালা’র
সহায়তায় ২০০৬ সালে বেনজির এবং শরীফের মধ্যে সমঝোতার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আয়ালা বিশ্বাস করতেন যে, পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য উত্তরণ নিশ্চিত
করার জন্য এটি একটি পূর্বশর্ত। বেনজির এবং শরীফ উভয়েরই লন্ডনে বাসস্থান ছিল
কাছাকাছি। আইনজীবী আইতজাজ আহসানের সহায়তায় এই জুটি একটি যৌথ কর্ম পরিকল্পনা তৈরি
করে। সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য একসাথে আন্দোলন করতে মে ২০০৬ সালে তারা
উভয়েই একটি গণতন্ত্রের সনদে স্বাক্ষর করেন। তারা পিপিপি থেকে দুজন এবং পাকিস্তান
মুসলিম লিগ (নওয়াজ) থেকে চারজন পাকিস্তানি সিনেটর নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে।
অতঃপর, বেনজির প্রকাশ্যে শরীফের সমালোচনা করা এড়িয়ে চলেন, যেমন তিনি একসময় করতেন।
২০০৭ সালে সোশালিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে যোগদানকালিন দেয়া সাক্ষাৎকার |
মার্কিন সরকার মোশাররফকে বেনজির ভুট্টোর সাথে দেখা করার জন্য চাপ
দেয় এবং এমন একটি ব্যবস্থায় আসে যা তার বৈধতাকে শক্তিশালী করতে পারে। যুক্তরাজ্য সরকারকেও এ ব্যাপারে উত্সাহিত করা
হয়। জানুয়ারী ২০০৭-এ আবুধাবিতে একটি হোটেলে বেনজির ভুট্টোর সাথে মোশাররফ তার
প্রথম বৈঠক করেন। এরপর জুনে আরও আলোচনা হয়। তাদের আলোচনার ফলস্বরূপ সম্মত হয় যে,
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ভুট্টো এবং তার স্বামী উভয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সমস্ত
অভিযোগ প্রত্যাহার করবে। অধ্যাদেশ প্রবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিবিদদের
বিরুদ্ধে সমস্ত ফৌজদারি কার্যক্রম বাতিল করা হয়। অধ্যাদেশটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের উপর মোশাররফের নিষেধাজ্ঞাও তুলে
নেয়। তারা সম্মত হয় যে, যদি মোশাররফ তার সামরিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং একজন
বেসামরিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তাহলে বেনজির তার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
কাজ করতে রাজী আছেন। তবে মোশাররফের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অনেকেরই বেনজিরের এই প্রস্তাব
নিয়ে আপত্তি ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস এবং
যুক্তরাজ্যের জ্যাক স্ট্র পাকিস্তানে নির্বাচনী গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য
একত্রে কাজ করেছিল। যুক্তরাজ্য এবং স্পেন উভয়েই বেনজিরের দুর্নীতির অপরাধ তদন্ত
বাদ দিয়েছিল। তবে সুইজারল্যান্ড তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
আগষ্ট ২০০৭-এ জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমে খালিজাদ নিউ
ইয়র্ক সিটিতে বেনজির ভুট্টোর সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। সেখানে বেনজির ভুট্টো “কাউন্সিল
অফ ফরেন রিলেশন”এ একটি পাবলিক বক্তৃতাও দেন। বেনজির ভুট্টো এবং খালিজাদ
যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে দেখা করার জন্য
অ্যাস্পেন, কলোরাডোতে একটি মধ্যাহ্নভোজে যোগদান করে। অক্টোবর ২০০৭-এ মোশাররফ
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বেনজির ভুট্টো এবং
মোশাররফের করা চুক্তি অনুযায়ী পিপিপি প্রতিনিধিরা মোশাররফের মনোনয়নের বিরুদ্ধে
ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
মার্কিন প্রকাশক হার্পারকলিন্স বেনজির ভুট্টোকে একটি বই তৈরি করার
জন্য অর্ধ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছিলেন। বইয়ের নাম “পুনর্মিলন”। মার্কিন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাংবাদিক মার্ক সিগেলের সাথে সহ-লিখিত বইটি ২০০৮ সালে “পুনর্মিলন:
ইসলাম, গণতন্ত্র এবং পশ্চিম” নামে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলো। পুনর্মিলন আংশিকভাবে
সভ্যতার সংঘর্ষের তত্ত্বের একটি প্রতিক্রিয়া যা ১৯৯০ এর দশকে আমেরিকান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন দ্বারা জনপ্রিয় করা হয়। তিনি যুক্তি
দিয়েছিলেন যে হান্টিংটনের তত্ত্ব গণতান্ত্রিক আদর্শের সার্বজনীনতাকে অস্বীকার
করেছে এবং একটি "ভয়ের স্ব-পরিপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী" তৈরি করেছে যার ফলে
এটি দ্বন্দ্বগুলিকে উস্কে দিয়েছে বলে দাবি করা হয়। পুনর্মিলনে তিনি প্রস্তাব
করেছিলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির দরিদ্রদের সাহায্য
করার জন্য একটি নতুন "মার্শাল প্ল্যান" অর্থায়ন করে। তারা বিশ্বাস করে
যে, এটি পশ্চিমাদের ইসলামী মনোভাব উন্নত করবে।
বেনজির ভুট্টো অক্টোবর ২০০৭-এ পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ব্যাপকভাবে ধারণা
করা হয়েছিল যে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী
হওয়ার একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা ছিল। তবে মোশাররফের সাথে তার চুক্তি এবং মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তার জনপ্রিয়তাকে ক্ষুন্ন করেছিল এবং শরীফ আরও বেশ
কিছুদিন সৌদি আরবে ছিল। জনমত জড়িপে দেখা যায়, মোশাররফ তার আগমনে বিরক্ত হয়েছিলেন।
অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনি নির্বাচনের পরেই ফিরে আসবেন। তার স্বামী এবং মেয়েরা
দুবাইতে থেকে যায়। তার ছেলে তখনও অক্সফোর্ডে অধ্যয়নরত ছিল।
বেনজির ভুট্টো তার দেশের প্রধান সমস্যাটিকে "মধ্যপন্থা ও
চরমপন্থা" এর মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারে হতাহাগ্রস্ত
ছিলেন। মোশাররফ নিজেও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের দ্বারা বেশ কয়েকটি হত্যা প্রচেষ্টা
থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং বেনজির ভুট্টোকে সতর্ক করেছিলেন যে, তিনিও লক্ষ্যবস্তু
হবেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে
অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। তার বিস্তারিত নিরাপত্তা মোশাররফ
দ্বারা সংগঠিত হয়।
বেনজিরের একদল অশ্বারোহী সমর্থক করাচিতে ভিড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার
সময় দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়। তাতে ১৪৯ জন নিহত এবং ৪০২ জন আহত হয়।
বেনজির ভুট্টো নিজে শারীরিকভাবে অক্ষত ছিলেন। বেনজির অভিযোগ করেন যে, চারটি
আত্মঘাতী স্কোয়াড তাকে নির্মূল করার জন্য পাঠানো হয়েছিল এবং সরকারের
গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা এই চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। তিনি মোশাররফের কাছে এই
কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে একটি তালিকা পাঠান। বেনজির অপরাধের তদন্তের জন্য
ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ
ইনভেস্টিগেশনকে আনতে মোশাররফকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
নভেম্বর ২০০৭-এ বেনজির তার বাসভবনের সামনে সমর্থকদের সাথে কথা বলছেন |
মোশাররফ নভেম্বর মাসে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন। বেনজির তখন দুবাই সফরে ছিলেন। ফলে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়। পিপিপি এবং পিএমএল-(এন) মোশাররফের কর্মের প্রতিবাদ শুরু করে। বেনজির দ্রুত পাকিস্তানে ফিরে আসেন। তাকে অল্প কিছুদিনের জন্য গৃহবন্দী করা হয়। তারপর তিনি প্রকাশ্যে মোশাররফের নিন্দা করেন এবং শংকা প্রকাশ করেন যে, তার সাথে কোনো সম্পর্ক তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
২৬ নভেম্বর শরীফ নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। একই দিনে বেনজির ভুট্টো
লারকানা নির্বাচনী এলাকায় দুটি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কাগজপত্র
জমা দেন। যেহেতু মোশাররফ পূর্বে বেনজির ভুট্টোর সাথে একমত হয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী সেনাপ্রধানের
পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানের বেসামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে বেনজির ভুট্টো শরিফের সাথে তাদের দাবির
বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সাক্ষাত করেন এবং মুশাররফ যেন জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের
আগে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন – সে বিষয় কথা বলেন। যদি
তিনি তা মানতে ব্যর্থ হন তবে ভোট বয়কট করার হুমকি দেন। ১৬ ডিসেম্বর মোশাররফ তাই
করেন। বেনজির ভুট্টো ঘোষণা করেন, পিপিপি "পাঁচটি ই এর" উপর প্রচারণা
চালাবে: কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শক্তি, পরিবেশ এবং সমতা। পিপিপি-এর ইশতেহারে সামরিক
ও গোয়েন্দা সংস্থার বৃহত্তর বেসামরিক তদারকি এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানানো
হয়। তারা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত গোয়েন্দা পরিষেবা পরিত্রাণ
করার অঙ্গীকার করেন।
২৭ ডিসেম্বর ২০০৭ এর সকালে বেনজির ভুট্টো আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ
কারজাইয়ের সাথে দেখা করেন। বিকেলে তিনি রাওয়ালপিন্ডির “লিয়াকত ন্যাশনাল বাগে”
অনুষ্ঠিত পিপিপি সমাবেশে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা শেষে চলে যাওয়ার সময় তিনি
আশেপাশের জনতার ঢেউ দেখে তাদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে “একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ির
এস্কেপ হ্যাচ” খুলে উঠে দাঁড়ান। গাড়ির তিন মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একজন
ব্যক্তি তাকে তিনটি গুলি করে এবং বল বিয়ারিং দিয়ে বস্তাবন্দী একটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ
ঘটায়। বেনজির ভুট্টো মারাত্মকভাবে আহত হন। তিনি গুলি বা বিস্ফোরণ দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত
হয়েছিলেন কিনা এ বিষয়ে ভিন্নমত আছে। বিস্ফোরণে আরও বাইশ জন মারা যান।
বেনজিরকে দ্রুত রাওয়ালপিন্ডি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু চিকিৎসকদের মতে তিনি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। কোন ময়নাতদন্ত হয়
না এবং মৃতদেহ দ্রুত চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত হয়। পরের দিন “লারকানার
কাছ গাড়ি খুদা বখশ নামক স্থানে তাকে তার পারিবারিক কবরস্থানে ভুট্টো পরিবারের
সমাধিতে তার বাবার পাশে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তিন দিনের রাষ্ট্রীয়
শোক ঘোষণা করেন। পিপিপি সমর্থকরা পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে দাঙ্গা করে। অন্তত ৫০ জন
নিহত হয়।
ভুট্টো পরিবারের সমাধি |
কর্তৃপক্ষ দাবি করে, হত্যাকারী ছিল দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের একটি
কিশোর বালক। পাকিস্তানি তালেবানের নেতা বায়তুল্লা মেহসুদ এই হামলার পরিকল্পনা
করেছিলেন বলে প্রমাণ আছে বলে দাবি করে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল
ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এই সম্ভাবনার কথা দাবি করেছিল। মেহসুদী এই অভিযোগ অস্বীকার
করেন। তবুও ধারণা করা হয়, মেহসুদের একটি উদ্দেশ্য ছিল: তিনি বিশ্বাস করতেন,
বেনজিরের আমেরিকাপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এজেন্ডা দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে
পাকিস্তানি তালেবানের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেবে এবং সুন্নি ইসলামপন্থী মৌলবাদের
বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। তবে আল-কায়েদা কমান্ডার মোস্তফা আবু আল-ইয়াজিদ হত্যার
দায় স্বীকার করে ঘোষণা করে যে "আমরা সবচেয়ে মূল্যবান আমেরিকান সম্পদটি বন্ধ
করে দিয়েছি যা মুজাহিদিনদের পরাজিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।"
পিপিপি দাবি করে, বেনজির গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত একজন “স্নাইপার”
দ্বারা নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জনসাধারণের ধারণা ছিল, আক্রমণটি ভারত
বা মার্কিন যুক্তরাষ্টের পরিকল্পনায় করা হতে পারে। মুশাররফ হত্যার তদন্তের জন্য
ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে আমন্ত্রণ জানাতে সম্মত হন। তবে তার চূড়ান্ত
প্রতিবেদনটি অমীমাংসিত থেকে যায়। কারণ, তার স্বামী আসিফ আলি জারদারি ময়নাতদন্তের
জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
বেনজির ভুট্টোর হত্যাকান্ডের স্থানে গোলাপি টাইলস দ্বারা ফ্রেম করা তার একটি প্রতিকৃতি |
বেনজিরের রাজনৈতিক ইচ্ছায় তিনি তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে তার
ছেলে বিলাওয়ালকে পিপিপির চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। বিলাওয়ালের বয়স
তখন ১৯ বছর। সূত্রটি আরও উল্লেখ করে, বিলাওয়ালের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ না হওয়া
পর্যন্ত জারদারিকে দলের কো-চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করা উচিত। জারদারি পিপিপির কো-চেয়ারম্যান
হন।
একাডেমিক আনা সুভোরোভা উল্লেখ করেছেন যে, বেনজির ভুট্টোর
হত্যাকাণ্ড "একটি প্রকৃত পারিবারিক কাল্ট" তৈরি করেছিল, যা বিভিন্ন
অপপ্রচার, আচার-অনুষ্ঠান এবং ধ্বংসাবশেষ দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল"। বেনজির
ভুট্টোর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০৮ পর্যন্ত
স্থগিত করা হয়।
নির্বাচনের পর পিপিপি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) একত্রিত হয়ে
একটি জোট সরকার গঠন করে। নতুন জোট পিপিপি সদস্য “ইউসুফ রাজা গিলানিকে” প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে ঘোষণা করে। সম্ভাব্য অভিশংসনের সম্মুখীন মোশাররফ আগস্টে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে
পদত্যাগ করেন এবং লন্ডনে পালিয়ে যান। ফেব্রুয়ারী ২০১১-তে রাওয়ালপিন্ডির একটি
আদালত মোশাররফের জন্য একটি সমন জারি করে এই ভিত্তিতে যে, তিনি ভুট্টোকে পরিচিত
হুমকির বিষয়ে কাজ করেননি এবং তাকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদান করেননি।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ দ্বারা জারদারি পাকিস্তানের
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৩ পর্যন্ত সেই দায়িত্বে ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে জারদারি তার স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের জন্য
জাতিসংঘের তদন্তের আহ্বান জানান। ২০০৯ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন চিলির
হেরাল্ডো মুনোজ, আইরিশ পিটার ফিটজজেরাল্ড এবং ইন্দোনেশিয়ান মারজুকি দারুসমানকে একটি
তিন সদস্যের তদন্ত দল গঠন করে, যদিও একজন অপরাধীকে শনাক্ত করা কমিশনের দায়িত্বে
ছিল না। মুনোজ পরে মতামত প্রকাশ করেন যে, “সম্ভবত মেহসুদের সমর্থনে পাকিস্তানি
তালেবানরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। তারা হয়তো দুর্বৃত্তদের সমর্থন করেছিল। দেশের
গোয়েন্দা সংস্থা এতে সহায়তা করেছিলো। তিনি মূল পুলিশ তদন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসতর্কভাবে
করা হয়েছিলো বলে মতামত দেয়”।
ফেব্রুয়ারী ২০১২-তে পাকিস্তানি সরকারী তদন্ত ২৭টি বিভিন্ন জঙ্গি
গোষ্ঠীকে হামলার জন্য দায়ী করে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১৩ সালের মে মাসে
বেনজির ভুট্টো মামলায় রাষ্ট্রের প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, জুলফিকার আলীকে
ইসলামাবাদে হত্যা করা হয়। বেনজির ভুট্টো মামলার তদন্ত একটি ”স্মোকিং গান” ছিল না।
পাকিস্তানে অনেকেরই বেনজিরের মৃত্যু চাওয়ার কারণ ছিল। কেউ কেউ তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত
হিসেবে দেখেছিলেন। তার হত্যাকাণ্ড সামরিক সংস্থা এবং ইসলামিক মৌলবাদীদের জন্য
সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়েছিল, যারা তাকে তুচ্ছ করেছিল।
বেনজির ভুট্টো গণতন্ত্র ও দেশকে আধুনিকায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলামি বিশ্বের ভবিষ্যৎ এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে নিহিত।
যাইহোক, বেনজির ভুট্টোর "মূল রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলি" আসলে কী ছিল তা
"পিন করা কঠিন"। বেনজির ভুট্টোকে "উদারবাদী প্রত্যয়" এবং
"স্ব-প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে করা হতো যে,
বেনজির ভুট্টো নিজেকে পশ্চিমাদের কাছে "রক্ষণশীল পাকিস্তানে সর্বজনীন
উদারনৈতিক মূল্যবোধের আউটপোস্ট" হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।
বেনজির ভুট্টোর জীবনীকার জি.এস. ভার্গব ভেবেছিলেন, পাকিস্তানি
রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি একজন সামাজিক গণতন্ত্রের “গিরিপথ” হতে পারেন। তার বন্ধু
ক্যাথরিন ড্রাকার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন তাকে চিনতেন। তিনি বলেন, “বেনজির
ভুট্টোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তখন "দিনের হালকা বামপন্থার" মত ছিল।
ভার্গব যোগ করেন, হার্ভার্ড এবং তারপর অক্সফোর্ডে শাসন ও রাজনীতিতে তার শিক্ষার
মাধ্যমে বেনজির রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং অনুশীলনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ এবং সেইসাথে
সমসাময়িক পরিবেশে প্রয়োগ করেছিলেন”।
বেনজির ভুট্টো যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার
দ্বারা অনুসৃত থ্যাচারাইট অর্থনীতির প্রশংসা করেছিলেন। জীবনীকার মুশতাক আহমেদের
মতে, বেসরকারীকরণ এবং বাজার অর্থনীতিতে তিনি অতি উৎসাহী ছিলেন। বেনজির পাকিস্তানে
একটি সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনের পক্ষে
ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার
জন্য এটি প্রয়োজন।
পিপিপি একসময় আনুষ্ঠানিকভাবে আদর্শে সমাজতান্ত্রিক ছিল। বেনজির
ভুট্টো "একজন স্বাভাবিক সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, এমনকি জুলফিকারের মতো কথা বলতে
পারদর্শী ছিলেন না"। তিনি তার পিতার সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতির সাথে
দ্বিমত পোষণ করেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৭০-এর দশকে জাতীয়করণ করা বিভিন্ন
শিল্পের বেসরকারীকরণের চেষ্টা করেন। বেনজির ভুট্টোর অধীনে পিপিপি সমতাবাদের আদর্শ
প্রকাশ করেছিল এবং দাবি করেছিল যে, এটি কৃষক ও শ্রমিকদের কল্যাণকে বাড়িয়ে তুলবে।
এই ধরনের "প্রগতিশীল শব্দগুচ্ছ" দরিদ্রদের উপকার করার জন্য অর্থনৈতিক
নীতির অনুপস্থিতিকে প্রশ্রয় দেয়। পরিবর্তে এর নীতিগুলি প্রাথমিকভাবে
"সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী"কে উপকৃত করেছিল এবং এই হিসেবে পিপিপি বামপন্থীর
চেয়ে ডানপন্থী ছিল।
বেনজিরের কার্যকালের সময় গ্রামীণ পাকিস্তানের সামন্তবাদী
প্রকৃতিকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছুই করেননি। তার অধীনে পিপিপি-তে ধনী
সামন্ত শ্রেণীর লোকেরা "ফেডারেল এবং প্রাদেশিক উভয় স্তরেই" আধিপত্য
বিস্তার করতো। তার সময়কালে তার পিতার কর্তৃক নিয়োজিত "মৌখিক মৌলবাদে"
বিশ্বাসীদের সাথে জড়িত হওয়ার দরকার ছিল না। ভোটে জিততে এবং তাকে অনুমতি দেওয়ার
জন্য "সমাজতান্ত্রিক পরিচয়ের জন্য আওয়াজ করার" দরকার ছিল না।
"কথা ও কাজে উভয় ক্ষেত্রেই একজন বাস্তববাদী" ছিলেন। বেনজির ভুট্টোকে
নির্বাচনী প্রচারণায় পপুলিস্ট কৌশল ব্যবহারে দক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। লস
এঞ্জেলস টাইমসের ২০০৭ সালের একটি প্রবন্ধে বেনজিরের ভাগ্নি ফাতিমা ভুট্টো তাকে
"একজন পুতুল 'গণতন্ত্রী'" বলে অভিহিত করেন যা মার্কিন সরকারের নব্য
রক্ষণশীল এজেন্ডার সাথে যুক্ত।
১৯৯৬ সালে এম এম চন্দিওর সাথে সাক্ষাৎ |
বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপিপি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ
ছিল। তবে সেই সময়ে পাকিস্তানে "ধর্মনিরপেক্ষতা" শব্দটি প্রায়ই ধর্মীয়
প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিফলিত করে না, বরং নাস্তিকতা এবং ধর্মহীনতা
মনে করা হতো। সুতরাং, বেনজির ভুট্টো ইসলামিক সমাজের ধর্মনিরপেক্ষকরণের বিরোধিতা
করেছিলেন। তবে জঙ্গি ইসলাম-বাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। যদিও তাকে
পাকিস্তানের শক্তিশালী ইসলামপন্থী লবির সাথে আপস করতে হয়েছিল। তিনি দেশের জন্য
একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে ছিলেন।
বেনজির তার ক্ষমতায় থাকা বছরগুলোতে পাশ্চাত্যবাদী হয়েও কোনো
সময়ই পাকিস্তানের ইসলামপন্থীদেরকে গুরুতরভাবে চ্যালেঞ্জ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি, যদিও তার প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিয়া
প্রবর্তিত মহিলাদের উপর হুদুদ বিধিনিষেধ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন;
কিন্তু তিনি তা করেননি।
বেনজির যখন যৌনতাবাদের মুখোমুখি হন তখন ক্ষুব্ধ হন এবং নিজেকে নারী
অধিকারের একজন প্রবল সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে তিনি তত্ত্ব বা অনুশীলনে
কখনোই নারীবাদী ছিলেন না। বেনজির ভুট্টো এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে, “পুরুষ ও মহিলা
নেতাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। "নারী নেতারা আরও উদার এবং ক্ষমাশীল, পুরুষ
নেতারা আরও অনমনীয় এবং আরও কঠোর হতে থাকে।" তিনি ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীতে নারীদের
রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা জোর দিয়েছিলেন। তার দৃষ্টিতে, "এটি আমাদের ধর্মে নয়,
আমাদের ধর্ম সম্পর্কে পুরুষদের ব্যাখ্যা, যা নারীদের সুযোগ সীমাবদ্ধ করে। ইসলাম
আসলে তার শুরু থেকেই নারীদের প্রতি বেশ প্রগতিশীল ছিল।" বেনজির ভুট্টো তার
প্রধান রোল মডেল হিসাবে ইসলামের নবী মুহাম্মদ(সাঃ) কন্যা ফাতিমার কথা বর্ণনা
করেছিলেন। তিনি তার ধর্মপরায়ণতা, প্রজ্ঞা এবং সাহসের প্রশংসা করেছেন। তিনি
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবেও বর্ণনা
করেছেন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট