বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৪৪) – পাকিস্তান
বেনজির ভুট্টো (খন্ড ১০ এর ৫)
বেনজির ভুট্টো |
ভারত ও পারমাণবিক বোমা
বেনজির ভুট্টো প্রাথমিকভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেন। জিয়ার অ-যুদ্ধ চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাহার করে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিকে ভবিষ্যত সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং তার স্ত্রী সোনিয়াকে ইসলামাবাদে তিন দিনের সফরের জন্য তার অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান।
তার ছয় মাস পর রাজীব গান্ধী দ্বিপাক্ষিক সফরে পাকিস্তান আসেন। বেনজির সাবেক ভারতীয় নেতা মোরারজি দেশাইকে নিশান-ই-পাকিস্তান পুরস্কারের জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে রাজিবকে খুশি করেন। দুই দেশ সীমান্তে তাদের সামরিক তৎপরতা কমাতে সম্মত হয় এবং তাদের নিজ নিজ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করতে সম্মত হয়।
বেনজির ভুট্টো দাবি করেছিলেন যে, তিনি ভারতে সক্রিয় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন বন্ধ করেছিলেন। জিয়া ভারতের নিয়ন্ত্রনাধীন পাঞ্জাবকে অস্থিতিশীল করতে তাদের উৎসাহিত করেছিল।
সম্পর্কের এই উষ্ণতা দেশীয় অনেক ইসলামপন্থী এবং রক্ষণশীল শক্তিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা অভিযোগ করেন যে, বেনজির এবং রাজীব গান্ধী যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তারা বলেন, বেনজির একজন ভারতীয় এজেন্ট। এই অপপ্রচারের সাথে আরো যোগ করেন যে, বেনজির ভুট্টোর পিতামহী(দাদী) একটি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নতুন উত্থাপিত এই অপপ্রচারের উপর খুব জোর দেন তারা।
ভারতের প্রতি অত্যধিক সমঝোতামূলক হওয়ার অভিযোগের পরে বেনজির ভুট্টো ভারতের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে কাশ্মীর সংঘাতের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন। ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মধ্যে এক সাক্ষাৎকারে বেনজির কাশ্মীরি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিশ্রুত কাশ্মীর গণভোটের তদারকি করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। বেনজির ভুট্টো পাকিস্তান সীমান্তে স্বাধীনতার পক্ষের কাশ্মীরিদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন এবং তাদের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলির সমর্থনে আরো বিবৃতি দিয়ে এটি সমর্থন করেছিলেন।
এক বক্তৃতায় তিনি কাশ্মীরি মুসলমানদেরকে তাদের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে উস্কানি দেন।
পরে ১৯৯৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে বেনজির ভুট্টো বলেছিলেন; "বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপমানজনক ক্ষতিতে" ভারতের ভূমিকার প্রতিশোধ হিসেবে জিয়া কর্তৃক পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরে প্রক্সি যুদ্ধকে সমর্থন করা ছিল একটি সঠিক সিদ্ধান্ত"।
১৯৯০ সালে মেজর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে সংযুক্ত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে কার্গিলে একটি সামরিক আক্রমণের প্রস্তাব করেন। বেনজির এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এতে আন্তর্জাতিক নিন্দা কঠোর হবে।
পারভেজ মোশাররফ |
উভয় দেশের সামরিক বাহিনী সীমান্তের উভয় দিকে তৎপর হওয়ার সাথে সাথে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা পারমাণবিক যুদ্ধের কারণ হতে পারে এমন আশঙ্কা ক্রমবর্ধমান ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত রবার্ট গেটসকে পাকিস্তানিদের যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে এই অঞ্চলে পাঠায় । তিনি বেনজির ভুট্টোর সাথে দেখা করতে পারেননি। কারণ, বেনজির উপসাগরীয় দেশগুলোতে সফরের অংশ হিসেবে তখন ইয়েমেনে অবস্থান করছিলেন।
রবার্ট গেটস প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খানের সাথে দেখা করে তাকে জানিয়েছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করবে না। তিনি পাকিস্তানকে শত্রুতা থেকে সরে আসতে এবং তার ভূখণ্ডে কাশ্মীরি প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি ভেঙে দিতে প্রেসিডেন্টকে রাজি করান।
বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান এবং সামরিক বাহিনী তাকে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচী সম্পর্কে কিছুই জানতে দিতেন না। বেনজির তার প্রথম মেয়াদে এই বিষয়টি সম্পর্কে কতটা জানতেন তা এখনও অজানা।
পরবর্তীতে তিনি প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে এই প্রোগ্রামের প্রধান বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে বলেছিলেন যে, "আমরা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী নই এবং আমরা তা করতেও চাই না"। ওয়াশিংটন ডিসি-তে অবস্থানকালীন তিনি সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম ওয়েবস্টারের সাথে দেখা করেন। উইলিয়াম তাকে পাকিস্তানি পারমাণবিক অস্ত্রের একটি নমুনা দেখিয়েছিলেন এবং মন্তব্য করেছিলেন যে, জিয়া সরকারের শেষ বছরগুলিতে এটি একটি ক্রেসেন্ডোতে পৌঁছেছিল।
উইলিয়ামের উদ্ঘাটন বেনজিরকে একটি ধাক্কা দিয়েছিল, কারণ তিনি পাকিস্তানের পারমাণবিক উন্নয়নের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এমন একটি মারনাস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তাকে জানিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান পারমাণবিক বোমার কোর তৈরি করা থেকে বিরত না হলে দেশটিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হবে।
জানুয়ারী এবং মার্চ ১৯৮৯ এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি বিদারণযোগ্য উপাদান ছাড়াই পারমাণবিক অস্ত্রের ঠান্ডা পরীক্ষা অনুমোদন করেন। তবে এটি সামরিক কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
১৯৯০ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার অল্প কয়েকদিন আগে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট ওকলি বেনজিরকে জানান যে, মার্কিন উপগ্রহ দ্বারা প্রাপ্ত "কাহুতা সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টে অস্ত্র-গ্রেড ইউরেনিয়াম তৈরির" তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার বিষয়ে তার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা হয়েছে।