বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৩৫) – কসোভো
ভজোসা ওসমানী-সাদ্রিউ
ভজোসা ওসমানী |
ভজোসা
ওসমানী-সাদ্রিউ (জন্ম ১৭ মে ১৯৮২): একজন কসোভান
আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ। ভজোসা ওসমানী ০৪ এপ্রিল ২০২১ থেকে কসোভোর রাষ্ট্রপতি
হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কসোভোর ৫ম এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি।
ভজোসা ওসমানী কসোভোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঝাবার শহরতলী মিত্রোভিকায় বেড়ে ওঠেন।
ওসমানী প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিটসবার্গ স্কুল অফ ল থেকে আইন অধ্যয়ন করেন
এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন। তিনি বিধানসভায় নির্বাচিত হওয়ার আগে কসোভোর
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফাতমির সেজদিউ-এর উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন। ওসমানী ২০২০
সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত অ্যাসেম্বলির স্পিকারের পদে
অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি হাশিম থাসির পদত্যাগের পর নভেম্বর ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১
সময়কালে কসোভোর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ভজোসা ওসমানী দ্বিতীয় নারী হিসেবে
এই পদে অধিষ্ঠিত হন। ওসমানী কসোভোর প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি উভয়
দায়িত্ব পালন করেন।
ভজোসা ওসমানী সফলভাবে দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্মে দৌড়েছেন এবং কসোভো ও
সার্বিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার
পর থেকে ভজোসা ওসমানী রাষ্ট্রপতি পদের আনুষ্ঠানিক প্রতীক হিসেবে দরদানিয়ার পতাকা
ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ভজোসা ওসমানী
১৭ মে ১৯৮২ তারিখে ঝাবার, মিত্রোভিকা, (তখন যুগোস্লাভিয়ার একটি অংশ) জাতিগত আলবেনিয়ান
পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চার ভাইবোনের সাথে বেড়ে ওঠেন। ওসমানী কসোভো যুদ্ধের
সময় একজন কিশোরী ছিলেন এবং তিনি একবার বলেছিলেন যে, তিনি একটি M70 রাইফেলের ব্যারেল
"এখনও অনুভব করতে পারেন" যেটি মিত্রোভিকায় তার বাড়িতে অভিযান চালানোর পরে
একজন সৈনিক তার মুখে জোর করে ঢুকিয়েছিল।
ভজোসা তার নিজ
শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি কসোভোর প্রিশটিনা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পিটসবার্গ স্কুল অফ ল (পিট ল) বিশ্ববিদ্যালয়ে
স্নাতক অধ্যয়ন চালিয়ে যান। ২০০৫ সালে তিনি আইনে স্নাতকোত্তর (LLM) ডিগ্রি অর্জন করেন
এবং ২০১৫ সালে বিচার বিজ্ঞানে (SJD) ডক্টরেট অর্জন করেন। তার ডক্টরেট গবেষণামূলক গবেষণাপত্রটি
কসোভোতে UN কনভেনশন অন কন্ট্রাক্টস ফর দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেল অফ গুডস (CISG) এর প্রযোজ্যতাকে
নির্দেশ করে। কারণ কসোভোর আইনি অবস্থা ১৯৮৮ সাল থেকে বিকশিত হয়েছে, যখন CISG প্রথম
কার্যকর হয়।
ওসমানী প্রিস্টিনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সহকারী, কসোভোর একজন প্রভাষক এবং পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন ভিজিটিং প্রফেসর।
ওসমানীর
রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু হয়েছিল তার কিশোর বয়সে। মধ্য-ডান ডেমোক্রেটিক লীগ অফ কসোভোর
(এলডিকে) একজন কর্মী হিসেবে। ২৭আগস্ট ২০০৯-এ তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফাতমির সেজদিউর
জন্য চিফ অফ স্টাফ নির্বাচিত হন। ওসমানী রাষ্ট্রপতির আইনি পরামর্শদাতা এবং পররাষ্ট্র
নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তিন মেয়াদে কসোভো অ্যাসেম্বলির
সদস্য ছিলেন এবং একবার কসোভান সংসদীয় ইতিহাসে একজন মহিলা রাজনীতিকের জন্য সবচেয়ে
বেশি ভোট পেয়েছিলেন।
ইউএস প্রেসিডেন্ট
বারাক ওবামার সাথে ভজোসা ওসমানী |
ওসমানী কসোভোর স্বাধীনতায় অবদান রেখেছিলেন, সংবিধান কমিশনের রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসাবে, যে সংস্থাটি কসোভান সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। তিনি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি মামলায় কসোভোর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যেখানে তিনি কসোভোর স্বাধীনতার বৈধতা রক্ষা করেছিলেন।
তার সংসদীয় দায়িত্বের অংশ হিসাবে, ওসমানী পররাষ্ট্র বিষয়ক, প্রবাসী এবং কৌশলগত বিনিয়োগ এবং ইউরোপীয় সংহতি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কসোভোতে সাংবিধানিক সংস্কার কমিটির ভাইস-চেয়ার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৯ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঈসা মুস্তফা এবং ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) প্রশাসক মার্ক গ্রিন-এর সাথে বৈঠকে ভজোসা ওসমানী
২০১৪ সালে ওসমানী
তার পার্টির নেতা ঈসা মুস্তফার পূর্বের করা প্রতিস্রুতি ভঙ্গ করে তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী
দল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব কসোভোর (পিডিকে) জোট করায় এলডিকে নেতৃত্বের সাথে সংঘর্ষে
জড়িয়ে পড়েন। ওসমানী ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও বয়কট করেছিলেন। ফলে জোট চুক্তির
অংশ হিসাবে পিডিকে নেতা হাশিম থাসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
২০১৯ সালের
স্ন্যাপ পার্লামেন্ট নির্বাচনে LDK কসোভোর সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওসমানীকে
দেখতে পেয়েছিলো। নির্বাচনের প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন যে কসোভান জনগণ একজন মহিলা
প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রস্তুত। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন এবং কসোভোর জন্য
মুক্ত বাজার সংস্কার করবেন। কিন্তু তিনি অ্যালবিন কুর্তি, বামপন্থী অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট
পার্টি ভেটেভেনডোজজের নেতার কাছে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন।
২০ জুন ২০২০-এ
ওসমানীকে তার দলের উপনেতার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। দলের সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে বিরোধিতার
কারণে LDK নেতা মোস্তফা তাকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ হোতি
LDK উপনেতা হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন। ভজোসা ওসমানী পরবর্তীতে ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০-এ
সম্পূর্ণরূপে LDK ত্যাগ করেন, এই বলে যে, পার্টি তার কোন বিকল্প রাখেনি। তবে বলেন যে,
পার্টির সংস্কার হলে তিনি ফিরে আসবেন।
২০২০ সালে হেগে
কসোভো স্পেশালিষ্ট চেম্বার এন্ড স্পেশালিষ্ট প্রসিকিউটর অফিসের অভিযোগের পর
প্রেসিডেন্ট থাসি পদত্যাগ করলে ভজোসা ওসমানী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত
হন। ভজোসা তখন সংসদের স্পীকার ছিলেন।
২০২১ সালে
কসোভোর সংসদীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ভজোসা ০২ জানুয়ারী ২০২১ তারিখে তার
নিজস্ব রাজনৈতিক দল “গুক্সো” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তিনি কুর্তি-এর ভেটেভেন্ডোজ
পার্টি সাথে জোট গঠন করেন। দূর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে দুটি দলই ভূমিধস বিজয়
অর্জন করে। ওসমানী ব্যক্তিগতভাবে একাই ৩ লক্ষ ভোট পান। নির্বাচনে ১২০ আসনের সংসদে
এক তৃতায়াংশ আসন পায় এবং মন্ত্রীসভায় তার দল ৬ টি পদ পায়।
বিপরীতে তার
পূর্বতন দল LDK নির্বাচনে খুব খারাপ করে। ফলে তাকে তার প্রাক্তন দল থেকে বহিস্কার
করার কারণ মোস্তফা কঠোর দসমালোচনার মুখে ১৪ মার্চ দল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
০৪ এপ্রিল
২০২১-এ বিধানসভার তৃতীয় রাউন্ডের ভোটের সময় ভজোসা ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট নির্বচিত
করে। ভোটের সময় দুটি বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকে। ১২০ সদস্যের সংসদে উপস্থিত মোট ৮২
জন সদস্যের ৭১ ভোট পেয়ে ভজোসা জয়লাভ করেন। তিনি ৫ বছর মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট
হিসেবে শপথ নেন। তিনি ৯৩% সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ কসোভোর দ্বিতীয় মহিলা
প্রেসিডেন্ট।
ভজোসা ওসমানী
কসোভো এবং সার্বিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আশা ব্যক্ত করেছিলেন। পাশাপাশি
তিনি কসোভোর স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে যুদ্ধের জন্য বেলগ্রেডকে ক্ষমা চাওয়ার আহবান
জানিয়েছিলেন এবং যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিলন তাদের বিচার করতে বলেছিলেন।
প্রসিডেন্ট
হিসেবে শপথ গ্রহণের আগে ভজোসা ওসমানী ‘গুক্সোর” নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
২০২২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন (মাঝে) এবং কসোভোর প্রধানমন্ত্রী আলবিন কুর্তি (ডানে) এর সাথে ওসমানী
০৮ ডিসেম্বর
২০২৩ পর্যন্ত ভজোসা ওসমানী যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি,
জাপান, জার্মানি, তুর্কি সহ বিশ্বের মোট ৭২ টি দেশ সফর করেছেন। সফরগুলির কিছু ছিলো
প্রেসিডেন্ট থাসির সফরসংগী হিসেবে। অন্যগুলি প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে
ওসমানীর স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সময় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দুবার ‘এক্সিলেন্স ফর দ্য
ফিউচার’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল
স্টাডিজ তাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে অবদানের জন্য ‘শেঠ ইন্টারন্যাশনাল ইয়াং অ্যালামনাই
অ্যাচিভমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
২৮ ফেব্রুয়ারী
২০২২ তারিখে ওসমানীকে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
২০১২ সালে ভজোসা ওসমানী
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রিন্দন সাদ্রিউকে বিয়ে করেন। তাদের যমজ
কন্যা রয়েছে। ওসমানী আলবেনিয়ান, ইংরেজি, ক্রোয়েশিয়ান, সার্বিয়ান, স্প্যানিশ এবং
তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারেন।
ভজোসা ওসমানী
৯ টি বই লিখেছেন। তার লেখা "কসোভোর রাস্তার শিশু" (Street Children in Kosovo) ফিনিশ মানবাধিকার কর্মসূচি
কসোভোতে তিনটি ভাষায় (ইংরেজি, আলবেনিয়ান, সার্বিয়ান) অনুদিত ও মূদ্রিত হয়েছে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট