বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৪২) – পাকিস্তান

 

বেনজির ভুট্টো – (খন্ড ১০ এর ৩)

বেনজির ভুট্টো


১৯৮৮ সালের মে মাসে জিয়াউল হক সংসদ ভেঙে দেন এবং নভেম্বরে নির্বাচন আহ্বান করেন। বেনজির ভুট্টো যাতে জিততে না পারেন সেজন্যে জিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটি সময় বেছে নেন, যখন বেনজিরের সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাব্য সময় নির্ধারিত ছিলো। এইভাবে তার প্রচারণার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিলো।

 

জিয়া বেনজিরের জেতার সম্ভাবনাকে বাধা দিতে আরো ঘোষণা দেন যে, নির্বাচন একটি অ-দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে, প্রার্থীরা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে না থেকে ব্যক্তি হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বেনজির ভুট্টো এবং পিপিপি পরবর্তী শর্তের বিরুদ্ধে একটি আইনি চ্যালেঞ্জ শুরু করে।

 

যাইহোক, আগস্টে বাহাওয়ালপুর বিমানবন্দর থেকে জিয়াউল হককে বহনকারী একটি বিমান উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হলে জিয়া হঠাৎ মারা যান। মার্কিন-পাকিস্তান মিলে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি বিমান ক্র্যাশের কারণ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। তবে এই নাশকতাকে ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হয়েছিল। সম্ভাব্য অপরাধী হিসাবে সোভিয়েত, আমেরিকা, ভারত এবং ইসরায়েলিদেরকে সন্দেহ করা হয়েছিল।

বেনজির ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে এটাকে ঈশ্বরের কাজ বলে মন্তব্য করেন।

 

জিয়ার মৃত্যুর পর সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে যে, জিয়া যে নির্দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন তার পরিবর্তে একটি দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়া উচিত।

 

বেনজির পিপিপিকে জোটের বাইরে আলাদাভাবে প্রচারণা চালানোর উপর জোর দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক থ্যাচারিজমের পক্ষে এবং মুক্ত বাজারের প্রতিশ্রুতিতে তার সমাজতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে আসেন।

 

পিপিপি জিতবে এমন ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে দলটির জন্য ১৮ হাজার সম্ভাব্য প্রার্থী সামনে আসে। অনেকে নির্বাচনের জন্য পার্টিকে অর্থ প্রদান করে। নতুন সদস্য এবং প্রার্থীদের এই প্রবাহ অনেক প্রতিষ্ঠিত সদস্যদের বিপর্যস্ত করেছিল, যারা অনুমান করতে শুরু করেছিল যে, বেনজির তাদের পরিত্যাগ করছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতিতে পাকিস্তানি সমাজের উদারপন্থী সেক্টরগুলির মধ্যে একটি বড় আশার সঞ্চার হয়েছিল।  

 

যাইহোক, ইসলামী মৌলবাদীরা বলেছিল যে, দেশে একজন মহিলা নেতা থাকা অনৈসলামিক। প্যারিসের একটি নাইটক্লাবে বেনজিরের একটি নাচের ছবি উপস্থাপন করে তারা তার অনৈসলামিক আচরণ হিসেবে তাদের প্রচারণার প্রধান বিষয়বস্তু করেছিল।

 

আইএসআই-এর সহযোগিতা ও অর্থায়নে জিয়ার অনুগত এবং ইসলামী মৌলবাদীরা একত্রিত হয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল “ইসলামী জামহুরি ইত্তেহাদ (আইজেআই)” গঠন করে। সেই দলের বিজয় নিশ্চিত করার প্রয়াসে আইএসআই ভোট কারচুপির সাথেও জড়িত ছিলো। এই অসুবিধা সত্ত্বেও বেনজির নির্বাচনে পিপিপিকে বিজয়ী করতে নেতৃত্ব দেন এবং ২০৫টি আসনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৯৩টিতে জয়লাভ করেন। জিয়া সমর্থিত দল “আইজেআই” পেয়েছিলো মাত্র ৫৪টি আসন, যদিও দলটি দেশের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদেশ পাঞ্জাব-এর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো।

 

পিপিপি-র সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ছিল। পিপিপি এবং আইজেআই উভয়ই স্বতন্ত্র সাংসদদেরকে তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ডানপন্থী ও অন্যান্য স্বতন্ত্র সাংসদদের আইজেআই’কে সমর্থন করতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়।

 

রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান সাংবিধানিকভাবে বেনজিরকে পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তা করতে বিলম্ব করছিলেন। দেশটির প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনিচ্ছা সত্বেও ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পরে অবশেষে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান বেনজিরকে সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য হন।

 

বেনজির সরকার গঠনের জন্য মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (MQM) পার্টির সাথে একটি জোট গঠন করেন। সংসদে তাদের ১৩টি আসন ছিল। ০২ ডিসেম্বর ১৯৮৮ তারিখে বেনজির পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বেনজির ভুট্টো প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। পাশাপাশি তিনি জাতীয়ভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। ৩৫ বছর বয়সী বেনজির ভুট্টো ছিলেন ইসলামী বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নির্বাচিত নেতা, বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

 

তার নির্বাচনের পর পার্টি কর্মীরা তাকে মোহতারমা ("সম্মানিত ভদ্রমহিলা") হিসেবে উল্লেখ করতে উৎসাহিত হন। অনেক পর্যবেক্ষকআশা করেছিল যে, তার প্রধানমন্ত্রীত্ব বহু-দলীয় গণতন্ত্র, ক্রমবর্ধমান লিঙ্গ সমতা, এবং ভারতের সাথে আরও ভাল সম্পর্কের একটি নতুন যুগ হিসেবে চিহ্নিত করবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, তার নির্বাচনী বিজয় ছিল "ইসলামে নারীর ভূমিকা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে বিতর্কের শীর্ষস্থানীয় পয়েন্ট"।

 

১৯৮৮ সালে বেনজির ভুট্টো তার আত্মজীবনী ব্রিটিশ সংস্করণে “ডটার অফ দ্য ইস্ট” এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “ডটার অব ডেসটিনি” নামে সাব-টাইটেল প্রকাশ করেন। তার আত্মজীবনীটি একজন আমেরিকান “ঘোষ্ট রাইটার” (যিনি ভাড়ায় লেখেন) সহায়তায় লেখা হয়েছিল। বেনজিরের জীবনীকার ব্রুক অ্যালেন বলেছিলেন, “এটি ছিলো পশ্চিমা মতামত ও মতামত-নির্মাতাদের প্ররোচিত করার অভিপ্রায়ে পশ্চিমা পাঠকদের জন্য লেখা প্রাথমিকভাবে একটি রাজনৈতিক পারফরম্যান্স"।

 

বেনজির ভুট্টোর আত্মজীবনীতে তার পিতার শাসনামলকে হোয়াইটওয়াশ করার পাশাপাশি বেশ কিছু বাস্তবিক মিথ্যাচার রয়েছে। লিঙ্গ সংক্রান্ত সমস্যায় তিনি নিজেকে একজন গ্রাউন্ড ব্রেকার হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি তার মা নুসরাতকে তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি মিথ্যা দাবি করেন যে, যখন তিনি কৈশোরে পৌঁছেছিলেন নুসরাত তাকে বোরকা পরার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।

 

সূত্রঃ ইন্টারনেট

 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url