বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৪০) – পাকিস্তান
বেনজির
ভুট্টো – (খন্ড ১০ এর ১)
বেনজির ভুট্টো |
বেনজির
ভুট্টো (২১ জুন ১৯৫৩ - ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭): ছিলেন একজন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং মহিলা
রাস্ট্রপ্রধান যিনি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ এবং পূনরায় ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পাকিস্তানের
১১ তম এবং ১৩ তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তিনি ছিলেন একটি মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নির্বাচিত প্রথম মহিলা সরকার প্রধান। আদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন একজন
উদারপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। তিনি ১৯৮০এর দশকের প্রথম থেকে ২০০৭ সালে তার হত্যার
আগ পর্যন্ত পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সভাপতি ও সহ-সভাপতি ছিলেন।
মিশ্র
সিন্ধি এবং কুর্দি বংশের বেনজির ভুট্টো করাচিতে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধনী অভিজাত
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়াশোনা করেছেন। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তার পিতা পিপিপি নেতা জুলফিকার
ভুট্টো ১৯৭৩ সালে একটি সমাজতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
বেনজির
১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। তার বাবাকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা
হয় এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বেনজির এবং তার মা নুসরাত পিপিপির নিয়ন্ত্রণ
নেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দেশের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বেনজির বারবার জিয়া-উল-হকের
সামরিক সরকার দ্বারা বন্দী হন। পরে ১৯৮৪ সালে ব্রিটেনে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যান। তিনি
১৯৮৬ সালে পাকিস্তানেফিরে আসেন এবং থ্যাচারাইট অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পিপিপি-এর
প্ল্যাটফর্মকে সমাজতান্ত্রিক ধারা থেকে একটি উদারপন্থী ধারায় রূপান্তরিত করেন এবং ১৯৮৮
সালের নির্বাচনে বিজয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি গোলাম
ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সহ রক্ষণশীল এবং ইসলামপন্থী শক্তি কর্তৃক তার
সংস্কার প্রচেষ্টা রোধ করা হয়েছিল। তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির
অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান তাকে বরখাস্ত করেন।
গোয়েন্দা সংস্থা, রক্ষণশীল ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স এর বিজয় নিশ্চিত করতে
সেই বছরের নির্বাচনে কারচুপি করেছিল। বেনজির ভুট্টো বিরোধী দলের নেতা হন।
প্রধানমন্ত্রী
নওয়াজ শরিফের সরকারকেও দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করার পর বেনজির ভুট্টো নেতৃত্বে
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে পিপিপিকে বিজয়ী করেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি অর্থনৈতিক বেসরকারীকরণের
তদারকি করেন এবং নারীর অধিকারকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তার সরকার তার ভাই মুর্তজার
হত্যা, ১৯৯৫ সালের একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং তাকে এবং তার স্বামী আসিফ আলী জারদারির
সাথে জড়িত আরও একটি ঘুষ কেলেঙ্কারি সহ বেশ কিছু বিতর্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এসব প্রতিক্রিয়ার ফলে রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি তার সরকারকে বরখাস্ত করেন।
পিপিপি
১৯৯৭ সালের নির্বাচনে হেরে যায় এবং ১৯৯৮ সালে তিনি পূনরায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে
যান। পরবর্তী দশক ধরে দুবাই এবং লন্ডনে বসবাস করেন। একটি সাজানো দুর্নীতির তদন্ত কমিটি
২০০৩ সালে একটি সুইস আদালতে বেনজির দোষী সাব্যস্ত হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল
পারভেজ মোশাররফের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-দালালি আলোচনার পর তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ২০০৭ সালে পূনরায় পাকিস্তানে ফিরে আসেন। তার প্ল্যাটফর্মটি
সামরিক বাহিনীর বেসামরিক তদারকি এবং ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী সহিংসতার বিরোধিতার উপর
জোর দেয়। রাওয়ালপিন্ডিতে একটি রাজনৈতিক সমাবেশ শেষে গাড়িতে ওঠার পর তাকে গুলি করে
হত্যা করা হয়। সালাফি জিহাদি গ্রুপ আল-কায়েদা এ হত্যার দায় স্বীকার করে। যদিও পাকিস্তানি
তালেবান এবং গোয়েন্দা সংস্থার দুর্বৃত্তদের জড়িত থাকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সন্দেহ
করা হয়েছিল। তাকে তার পারিবারিক সমাধি ‘গাড়ি খুদা বক্সেদ’ দাফন করা হয়।
বেনজির
ভুট্টো একজন বিভাজনশীল নেতা হিসেবে বিতর্কিত ছিলেন। প্রায়শই তিনি রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ
বলে সমালোচিত হন। তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযুক্ত করা হয়। তিনি তার কর্মজীবনের প্রথম
দিকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং আধুনিকীকরণের এজেন্ডার জন্য পাকিস্তানের ইসলামপন্থী লবি
থেকে অনেক বিরোধিতার সম্মুখীন হন। তবুও তিনি
অভ্যন্তরীণভাবে জনপ্রিয় ছিলেন এবং গণতন্ত্রের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসাবে আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের সমর্থনও আকর্ষণ করেছিলেন। মরণোত্তর তিনি পুরুষ শাসিত সমাজে তার রাজনৈতিক
সাফল্যের কারণে তিনি নারী অধিকারের আইকন হিসেবে বিবেচিত হন।
শৈশবকাল: (১৯৫৩-১৯৬৮)
বেনজির
ভুট্টো ২১ জুন ১৯৫৩ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের করাচি পিন্টোর নার্সিং হোমে জন্মগ্রহণ
করেন। তার পিতা ছিলেন রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মা ছিলেন বেগম নুসরাত
ইস্পাহানি। তার মায়ের জন্ম ইস্ফাহান পারস্যের (বর্তমানে ইরান) আংশিক কুর্দি বংশোদ্ভূত
একটি ধনী পারস্য বণিক পরিবারে। জুলফিকার ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং তৎকালিন জুনাগড়
রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী শাহ নওয়াজ ভুট্টোর পুত্র। ভুট্টোরা ছিলেন সম্ভ্রান্ত সিন্ধুর
ধনী জমিদার। তারা ছিল শিয়া মুসলমান।
বেনজির
তার আত্মজীবনী "প্রাচ্যের কন্যা" তে বলেছেন, "পরিবারের বিবরণ দিয়ে
আমাদের পূর্বপুরুষদের একজনের ডায়েরি অনুযায়ী আমার প্রপিতামহের সময়ে এক মহা বন্যায়
ভেসে গিয়েছিল। অবশ্য শিশুকালে আমাদের বলা হয়েছিল যে, আমরা ছিলাম হয় রাজপুতদের বংশধর...অথবা
আরবদের বংশধর যারা আমাদের নিজ প্রদেশ সিন্ধু দিয়ে ৭১২ খৃষ্টাব্দে ভারতে প্রবেশ করেছিলো।"
কেউ
কেউ বলেন যে বেনজির ভুট্টো পাঞ্জাবের একটি মুসলিম উপজাতি আরাইন্স থেকে এসেছেন, যেখানে
ভুট্টা নামে একটি উপগোষ্ঠী রয়েছে এবং তারাও দাবি করে যে তারা আরবদের বংশধর এবং ৭১২
খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রবেশ করেছিল।
জুলফিকার-নুসরাত
দম্পতি সেপ্টেম্বর ১৯৫১ সালে বিয়ে করেছিলেন এবং বেনজির ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান।
তাকে তার একজন খালার নামে নাম রাখা হয়েছিল যিনি অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। জুলফিকার
ভুট্টোর তিনটি সন্তান ছিল; মুর্তজা (জন্ম ১৯৫৪), সানাম (১৯৫৭) এবং শাহনওয়াজ (১৯৫৮)।
জুলফিকার ভুট্টোর পিতা শাহ নওয়াজ ১৯৫৭ সালে মারা যান। জুলফিকার উত্তরাধিকার সূত্রে
পরিবারের জমির মালিক হন যা তাকে অত্যন্ত ধনী করে তোলে।
বেনজিরের প্রথম ভাষা ছিল ইংরেজি। শৈশবে তিনি অতি অল্পই উর্দু বলতে
পারতেন। স্থানীয় সিন্ধি ভাষাও খুব কমই বলতেন। ছোটবেলায় তার মা তাকে কিছু ফার্সি
শিখিয়েছিলেন। বেনজির প্রাথমিকভাবে করাচির লেডি জেনিংস নার্সারি স্কুলে পড়াশোনা
করেন। এরপর তাকে করাচির কনভেন্ট অব জেসাস অ্যান্ড মেরি এবং সেখান থেকে মুরির একটি
বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। মুরি ভারতের সীমান্তের কাছে এবং ১৯৬৫ সালের
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বেনজির ভুট্টো এবং অন্যান্য ছাত্ররা বিমান হামলার হলে
কি করতে হবে তার অনুশীলন করেছিল। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তার পরীক্ষায় উচ্চ গ্রেড
নিয়ে ও-লেভেল পাস করেন।
বেনজির তার পুরো যৌবন জুড়ে বাবাকে আইডল হিসেবে অনুসরণ করতেন।
তিনি, পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানে বিস্তৃত মহিলাদের প্রতি প্রচলিত পদ্ধতি লঙ্ঘন করে তাদের
শিক্ষার বিকাশকে উত্সাহিত করেছিলেন। যদিও তার শৈশবকালে তার বাবা-মায়ের মধ্যে
সম্পর্ক ভালো ছিলো না। জুলফিকার আলী ভুট্টো অন্য মহিলাদের সাথে বিবাহ বহির্ভূত
সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। নুসরাত এতে আপত্তি করলে জুলফিকার তাকে বাড়ি থেকে বের করে
দেন। নুসরাত ইরানে চলে যান। কিন্তু জুলফিকার তার সন্তানদের সেখানে যেতে বাধা দিলে
তিনি ছয়মাস পর পাকিস্তান ফিরে এসে করাচিতে বসতি স্থাপন করেন। বেনজির তার সারা জীবন
কখনোই প্রকাশ্যে এই অভ্যন্তরীণ পারিবারিক বিরোধের কথা স্বীকার করেননি।
বেনজির ভুট্টোর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবা জুলফিকার দেশের
জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী হন এবং তার নয় বছর বয়সের সময়ে তার বাবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী
হন। শৈশবকাল থেকেই বেনজির বিদেশী কূটনীতিক এবং ব্যক্তিত্ব যারা তার বাবার সাথে
দেখা করতে আসতেন তাদের সাথে পরিচিত হন। তাদের মধ্্তেন। চীনের চৌএন-লাই, যুক্তরাষ্ট্রের
হেনরি কিসিঞ্জার এবং হুবার্ট হামফ্রে। যখন তার বয়স তেরো তখন তার বাবা সরকার থেকে
পদত্যাগ করেন এবং এক বছর পরে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল “পাকিস্তান পিপলস পার্টি
(পিপিপি)” প্রতিষ্ঠা করেন। পিপিপি নীতিবাক্য ব্যবহার করেছিল "ইসলাম আমাদের
বিশ্বাস, গণতন্ত্র আমাদের নীতি, সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি, জনগণ ক্ষমতার মালিক”।
প্রত্যেক পাকিস্তানীর জন্য বস্ত্র ও বাসস্থান এবং কাশ্মীরের বিতর্কিত অঞ্চল ভারতের
কাছ থেকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করা হবে। বেনজির তার পিতার সঙ্গে বিভিন্ন
সভা সমাবেশে যোগদান করতেন। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকারের বিরুদ্ধে
দাঙ্গার কারণে জুলফিকারকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিন মাসের জন্য কারারুদ্ধ রাখা
হয়। এই সময় তিনি বেনজিরকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করার জন্য চিঠি লিখেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন: ১৯৬৯-১৯৭৭
বেনজির ভুট্টো হার্ভার্ডের র্যাডক্লিফ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন |
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভুট্টো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাডক্লিফ
কলেজে স্নাতক ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন করেন। তিনি ষোল বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হন যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম বয়স ছিল। কিন্তু তার অকাল ভর্তির অনুমতি পাওয়ার জন্য
জুলফিকার ভুট্টো সুপারিশ করেছিলো। জুলফিকার তার বন্ধু হার্ভার্ডের অর্থনীতির
অধ্যাপক জন কেনেথ গালব্রেথ যিনি পূর্বে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাকে তার স্থানীয় অভিভাবক হতে বলেন। তার
মাধ্যমে বেনজির ভুট্টো তার পুত্র পিটার গালব্রেথের সাথে দেখা করেন। পিটার গালব্রেথ
বনজিরের আজীবন বন্ধু ছিলেন। তার এক বছর পর হার্ভার্ডে মুর্তজা ভুট্টো যোগ দেন। বেনজির
ভুট্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনের সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন বলে মনে করেছিলেন।
একজন সহ-ছাত্রী বলেছিলেন যে, তিনি "তার প্রথম সেমিস্টারের
বেশিরভাগ সময় কেঁদেছিলেন"। যদিও বেনজির ভুট্টো পরে হার্ভার্ডে তার সময়কে
"আমার জীবনের সবচেয়ে সুখী বছরগুলির মধ্যে চারটি" বলে অভিহিত করেছিলেন।
তিনি ক্রিমসন কী সোসাইটি এবং তার ছাত্রাবাস এলিয়ট হাউসের সামাজিক সেক্রেটারি হয়ে
ক্যাম্পাস ট্যুর গাইড হয়েছিলেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান সম্পৃক্ততার
বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। বোস্টন কমন-এ একটি যুদ্ধ স্থগিত
দিবসের প্রতিবাদে যোগদান করেন। তিনি দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদের সাথে জড়িত
কর্মীদের মুখোমুখি হন, যদিও তিনি আন্দোলনে প্রকাশিত কিছু মতামত নিয়ে সন্দিহান
ছিলেন। হার্ভার্ডে বেনজির ভুট্টো ১৯৭৩ সালে আর্টস স্নাতক সহ গ্রাজুয়েট হন।
১৯৭১ সালে বেনজির যখন হার্ভার্ডে ছিলেন, জুলফিকার তাকে নিউ ইয়র্ক
সিটিতে তার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি সেই বছরের বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।
ইস্কান্দার মির্জা, আইউব খান এবং ইয়াহিয়া খানের ১৩ বছরের সামরিক শাসনের পর ১৯৭১
সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর জুলফিকার পাকিস্তানের
রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য ১৯৭০-এ পাকিস্তানের নির্বাচনে জুলফিকার
ভুট্টোর পিপিপি তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিলো।
বেনজির তার বাবার সাথে সিমলায় ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ সম্মেলনে তার
মায়ের অসুস্থতার কারণ তার প্রতিস্থাপন হিসাবে যান। সেখানে তিনি ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে পরিচিত হন। সিমলায় থাকাকালীন তিনি স্থানীয়
এবং জাতীয় উভয় ভারতীয় সংবাদপত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। প্রথমবার তিনি এই ধরনের প্রচার পান। ১৯৭৪ সালে তিনি
তার বাবার সাথে লাহোর অনুষ্ঠিত “ওয়াইসি” শীর্ষ সম্মেলনে যান। সেখানে তিনি সমবেত
মুসলিম বিশ্বের অনেক সিনিয়র নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন- যাদের মধ্যে লিবিয়ার
মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিশরের আনোয়ার সাদাত, সিরিয়ার হাফেজ আল-আসাদ, সৌদি আরবের
ফয়সাল এবং জর্ডানের হুসেন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
১৯৭৩ সালের বেনজির ভুট্টো যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
লেডি মার্গারেট হলে দর্শন রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রির জন্য
অধ্যয়ন শুরু করেন। তিন বছর পর তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিতার
পীড়াপীড়িতে তিনি এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে থেকে যান। তাতে
তিনি আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনীতি বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এই সময়ে তিনি অক্সফোর্ডের
সেন্ট ক্যাথরিন কলেজে ভর্তি হন। অক্সফোর্ড-এ তার সহকর্মী ছাত্রদের একজন বলেন যে,
সেখানে তিনি “তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সর্বোত্তম নষ্ট ধনী মেয়ের প্রতীক"
হিসেবে পরিচিতি পান। তবুও তিনি তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন এবং পরে তারা তাকে একজন হাস্যকর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহলী
ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
১৯৭৭ সালে তিনি “অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবেটিং সোসাইটির” সভাপতি
নির্বাচিত হন। তিনিই এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম এশিয়ান মহিলা। তার তিন মাসের মেয়াদ
শেষ হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড। বেনজির
ভুট্টো স্থানীয় কনজারভেটিভ অ্যাসোসিয়েশনেও সক্রিয় ছিলেন। পাকিস্তান এবং ভারতের
মধ্যে চলমান উত্তেজনা সত্ত্বেও তিনি ভারতীয় ছাত্রদের সাথে সামাজিকভাবে যোগাযোগ রেখেছিলেন
এবং অক্সফোর্ডে থাকাকালীন দুই পাকিস্তান সহ-ছাত্রকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন,
কিন্তু উভয়ই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। ভুট্টোর জীবনীকার ব্রুক অ্যালেন মনে করতেন
যে, অক্সফোর্ডে তার সময় ছিল "প্রায় অবশ্যই তার জীবনের সবচেয়ে সুখী,
সবচেয়ে উদ্বিগ্ন সময়"।
বেনজির ভুট্টো অক্সফোর্ডে তিনি তার বাবাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়ার জন্য
বিশ্ববিদ্যালয়কে আহ্বান জানিয়ে একটি প্রচারণার নেতৃত্ব দেন। তিনি তার বাবার
পুরানো শিক্ষক ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর রোপারের সমর্থন অর্জন করেছিলেন। বেনজির
ভুট্টোর প্রচারণা পাল্টা-বিক্ষোভের মাধ্যমে বিরোধিতা করা হয়েছিল। তারা বিশ্বাস
করেছিল যে, "বাংলাদেশের স্থপতি 'শেখ মুজিবুর রহমানকে নিপীড়ন এবং
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতার সাথে তার পিতার সংশ্লিষ্টতা থাকার
কারণে তাকে অনুপযুক্ত করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সম্মানসূচক ডিগ্রী প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়"। পরবর্তীতে বেনজির ভুট্টো
স্বীকার করেছিলেন যে, তার পিতা বাংলাদেশে নৃশংসতার সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি অজ্ঞ ছিলেন;- যদিও সবসময় একথা বলতেন যে, তার বাবা
এই বিষয়ে নির্দোষ ছিলেন।
অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি ১৯৭৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানে ফিরে
আসেন। গ্রীষ্মের সময়গুলিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং
"আন্তঃপ্রাদেশিক সাধারণ স্বার্থ পরিষদ" এ কাজ করার জন্য নিয়োজিত ছিলেন।
পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে কর্মজীবন শুরু করার অভিপ্রায়ে বছরের শেষের দিকে তার সিভিল
সার্ভিসের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথ ছিলো।