রূপ নয় - সুন্দর ব্যাবহারই মানুষের আসল সৌন্দর্য্য



এক সাধুবাবা এক সভায় প্রবচন (নীতিবাক্য) দিচ্ছিলেন। সেখানে প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়েছে। তো হঠাৎ কী মনে হলো, সাধু এক ভদ্রলোককে বলে উঠলেন;-

সাধুবাবাঃ  আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো?

ভদ্রলোকঃ  হ্যাঁ, হ্যাঁ, করুন (খুব খুশি)।

সাধুবাবাঃ  ভেবেচিন্তে উত্তর দেবেন কিন্তু।

ভদ্রলোকঃ  আচ্ছা, কি প্রশ্ন?

তো সাধুবাবা জিজ্ঞেস করলেনঃ

সাধুবাবাঃ  আচ্ছা বলুন তো, ধরুন আপনি রাস্তায় বেরিয়েছেন, রাস্তায় আপনি খুব সুন্দরী একজন মহিলা দেখলেন। তো আপনি কী করবেন?

ভদ্রলোকঃ  কী করবো মানে?

সাধুবাবাঃ  বলছি আপনি কি তাঁর দিকে আবার ফিরে তাকাবেন নাকি একবার দেখলেন আর চলে গেলেন?

ভদ্রলোকঃ  যদি সঙ্গে স্ত্রী না থাকে তাহলে আমি তার দিকে আবার তাকাবো, বেশ কয়েকবার তাকাবো।

সাধুবাবাঃ  আচ্ছা, এই যে সুন্দরী মহিলাকে আপনি দেখলেন, কতোক্ষণ পর্যন্ত তার কথা আপনার মনে থাকবে?

ভদ্রলোকঃ  যতোক্ষণ না তার থেকেও কোনও সুন্দরী মহিলাকে আমি দেখতে পাই।

সে কথা শুনে বাকি ভক্তরা ভীষণ হাসতে শুরু করলো।

সাধুবাবাঃ  আচ্ছা, খুব ভাল কথা। তার মানে আরো যদি কেউ সুন্দর আসে তখন তাহলে আপনি সেদিকে ধাবিত হবেন?

ভদ্রলোকঃ  হ্যাঁ, অবশ্যই সুন্দরের কি কোনও শেষ আছে গুরুজি? যতো সুন্দর হবে, আমি সে দিকেই তাকাবো।

সাধুবাবাঃ বাহ্, খুব ভাল কথা।

এর পরে গুরুজী বললেন, এটা তো গেলো ১ প্রশ্ন। আপনাকে আরেকটি প্রশ্ন করি?

ভদ্রলোকঃ  আজ্ঞে করুন গুরুজী।

সাধুবাবাঃ  এবার আমি যদি বলি, ধরুন আপনাকে আমি কো্নো জিনিষ দিয়ে বললাম, আপনি অমুক ঠিকানায় গিয়ে সেই বাড়ির মালিক ভদ্রলোককে জিনিষটা দিয়ে আসুন। আপনি কি যাবেন?

ভদ্রলোকঃ  হ্যাঁ, নিশ্চই যাবো। আপনি আদেশ করবেন, আমি যাবো না!

সাধুবাবাঃ  আচ্ছা ঠিক আছে।

সাধুবাবাঃ  ধরুন, এবার আমি আপনাকে পার্সেলটা দিয়েছি। আপনি সেই ঠিকানা পর্যন্ত পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, সেটা কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষের বাড়ি নয়। বিশাল বড়লোকের বাড়ি। চারদিকে গার্ড, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। মানে একেবারে ঝাঁ চকচকে এক বিশাল বড় বাড়ি। বাড়ি দেখতে দেখতে আপনার বেশ সময় চলে গেলো। আপনি গার্ডকে বললেন, ‘আমি একদম মালিকের হাতে পার্সেলটা দেবো। গুরুজির কাছ থেকে এসেছি’। তো গার্ড বললো, ঠিক আছে, ভেতরে খবর দিচ্ছি৷ আমি তো গার্ড খবর দিই। গার্ড গেলো খবর দিতে। আপনি বাড়ি্র এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছেন। তো বাড়ির মালিক এলেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে এবং আপনাকে বললেন, দিন পার্সেল টা দিন। আপনি তাঁকে পার্সেলটা দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই তিনি বললেন,- না না, আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন প্রথম। আপনাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়বো না। আপনি খুব অবাক হলেন যে, বাবা, এতো বড় একজন ব্যবসায়ী। এতো বড় একজন মানুষ। সে আমার মতো একজন মানুষকে এরকম ভেতরে নিজে এসে নিয়ে যাচ্ছে। আপনার তখন কেমন লাগবে?

ভদ্রলোকঃ  আমার ভালো লাগবে, আমার অবাক লাগবে।

সাধুবাবাঃ  আচ্ছা, তারপরে তিনি আপনাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে যথাযথ মর্যাদার সাথে আপ্যায়ন  করলেন। বিশাল বড় ডাইনিং টেবিল। সেখানে আপনাকে বসালেন এবং তিনি সহ দুজনেই খাবার খেলেন। যখন আপনি চলে আসবেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কিসে এসেছেন’? বললেন, ‘আমি বাসে করে এসেছি’। তিনি আবার বললেন, ‘কষ্ট করে যাবেন এভাবে! আপনি এক কাজ করুন। আপনার ফোন নাম্বারটা দিন আমাকে প্রয়োজন আছে। আর আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, আমার ড্রাইভার আপনাকে আমার গাড়িতে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

তাই হলো এবং আপনি যখন বাড়িতে পৌঁছলেন, তখন সেই ব্যক্তি আপনাকে ফোন করে বললো, আপনি আমার নম্বরটা রেখে দিন। পরবর্তীকালে কো্নও সময় যদি কোনও সমস্যায় পড়েন বা কোনও দরকার হয় নিশ্চয়ই ফোন করবেন আমাকে।

 

সাধুবাবাঃ  এই যে পুরো কাহিনীটা হলো, আপনার সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে যাওয়া থেকে শুরু করে আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত এই যে ঘটনাটা; সেই অভিজ্ঞতাটা আপনার কাছে কেমন লাগবে?

ভদ্রলোকঃ  অবশ্যই খুব ভালো লাগবে।

সাধুবাবাঃ  তো আপনি এই ঘটনাটা কতোদিন মনে রাখবেন?

ভদ্রলোকঃ  এটা তো আমি আজীবন মনে রাখবো গুরুজী। উনি আমাকে চেনেন না, কখনও দেখেননি। অথচ উনি আমাকে নিজে থেকে আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন। খাওয়ালেন, গল্প করলেন, কতো কথা জানতে চাইলেন - এমনকি তাতেও ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি তার গাড়ি করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ফোন করলেন, আমি ঠিক মতো পৌঁছেছি কিনা এবং এটাও বললেন, পরবর্তীকালে দরকার হলে যেনো ফোন করি। এরকম একজন মানুষ, যার সান্নিধ্য আমি পাবো – তাকে তো আমি সারা জীবন মনে রাখবো। তার তো আমার সঙ্গে এ রকম ভদ্র ব্যবহার করার কোনও দায় ছিলো না। তিনি তো পার্সেল নিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। আমাকে বাড়িতে পৌছে দেয়ারও তো প্রয়োজন ছিলো না।

সাধুবাবাঃ  হ্যাঁ, তাহলে কী হলো?

ভদ্রলোকঃ  আমি তাঁর ব্যবহারটা মনে রাখবো। তার এই পুরো জিনিসটা আমার মনে থাকবে। আমি তাঁকে সম্মান তো অবশ্যই করবো। সে আমার চোখে অনেক বড় মানুষ হয়ে গেলো।

সাধুবাবাঃ  হ্যাঁ, তাহলে এটা আপনি সারা জীবন মনে রাখবেন, তাই তো?

ভদ্রলোকঃ  হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মনে রাখবো।

সাধুবাবাঃ  এবার এই দুটো জিনিস আপনি ভালো করে বুঝুন। আপনারই কথায় আপনি যেটা বোঝালেন সেটা কী?

যে, সুন্দর মুখ বা সুন্দর দেখতে হলেও তাকে আপনি ক্ষণকালের জন্য মনে রাখবেন। আবার তার থেকে ভাল সুন্দর কেউ আসবে - তাকে আপনি কিছুক্ষণ দেখলেন, ভাল লাগলো। এরকম আবার তার চেয়ে ভালো কেউ এলো, আরও ভালো---। তাতে আপনি প্রথম যাকে দেখেছিলেন তার মুখটা কিন্তু আর মনে থাকবে না, তাই তো?

ভদ্রলোকঃ  না, মনে থাকবে না।


সারমর্মঃ

আপনি যতো সন্দরী বা সন্দর জিনিসই দেখেন, আপনার কিন্তু মনে থাকবে না। একে একে ভুলে যাবেন। অথচ আপনার ব্যবহার, যেটা খুব সুন্দর, সেটা সারাজীবন মনে থাকবে। এটা হচ্ছে দুটি সৌন্দর্যের মধ্যে পার্থক্য। একটা ক্ষণস্থায়ী আর আরেকটা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী।

কী বুঝলেন বলুন তো?

হ্যাঁ, প্রচুর পরিমাণ সাজার জিনিস আছে,- ফেস প্যাক আছে, ক্রিম আছে। নিশ্চয়ই নিজের বাহ্যিক দিকটা চমকাবেন - এটা অবশ্যই উচিৎ। সাজার জিনিসপত্রগুলো পাওয়া যায় কেনো? সুন্দর করে সাজার জন্যই তো। এবং সাজলে মন ভাল হয়। সব ঠিক আছে। কিন্তু সেটা বাইরের চমক৷ মনকে চমকাবেন কি করে? আপনার ভেতরটা চমকাবেন কী করে? তার জন্য একটাই উপায় - আপনার ব্যবহার।

চেনা মানুষ হোক বা অচেনা মানুষ হোক; আপনার কথা, আপনার অভিব্যাক্তি, আপনার ভাবপ্রকাশ - সবটাতেই বোঝা যাবে, আপনি মানুষটা কেমন।

আপনার কারো সাথে মতের অমিল হচ্ছে, সেটাও প্রকাশ করার জন্য কিন্তু একটু শালীনতার ভাব প্রয়োজন। সেগুলি যদি বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে আপনাকে দেখতে সুন্দর হলেও, অসাধারণ ‘ডানা কাটা পরী’ হলেও - কিচ্ছু ম্যাটার করবে না। কারণ আপনার ভেতরটা বড্ড কালিমালিপ্ত। সেটাই প্রকাশ পাবে।

সুতরাং বাইরে চমকাচ্ছেন; অবশ্যই চমকান, তারও প্রয়োজন আছে৷ আবার ভেতরটাও চমকানোর ব্যবস্থা করুন। সেটা কী করে করা যায় সেটা ভাবুন। তাহলে দেখবেন। অনেক সমস্যার সমাধান নিজেই করতে পারছেন।  ভাল থাকুন।

 

ডাঃ সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য, কলকাতা


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url