বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-২৭)-মিশর
পঞ্চম সর্বাধিক জনবহুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিশরের পার্লামেন্টে
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ- নারীদের নিয়ে গঠিত।
রাওয়া আতেয়া
রাওয়া আতেয়া |
রাওয়া আতেয়া (১৯ এপ্রিল ১৯২৬ - ৯ মে ১৯৯৭): একজন মিশরীয় মহিলা যিনি ১৯৫৭ সালে আরব
বিশ্বের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
রাওয়া আতেয়া ১৯
এপ্রিল ১৯২৬ সালে গিজা গভর্নরেটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় একটি পরিবারে
বেড়ে ওঠেন। তার বাবা ছিলেন ঘারবিয়ার লিবারেল ওয়াফড পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল,
যার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিলো।
আতেয়া নিজে খুব ছোটবেলা থেকেই বিক্ষোভে অংশ নিতেন
এবং ১৯৩৯ সালের ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভের সময় আহত হয়েছিলেন।
আতেয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৭সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে ‘লাইসেন্স ফ্রম লেটার’, ‘শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা’, ‘সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর
ডিগ্রি’ এবং ‘ইসলামিক স্টাডিজে ডিপ্লোমা’ অর্জন করেন। তিনি ১৫ বছর শিক্ষকতা করেন এবং
সংক্ষিপ্ত ছয় মাস সময়ের জন্য সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
আতেয়া ১৯৫৬ সালে লিবারেল
আর্মিতে একজন অফিসার হিসাবে কমিশনপ্রাপ্ত প্রথম মহিলা। তিনি সুয়েজ যুদ্ধে সক্রিয়
ভূমিকা পালন করেন, যে সময় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল দ্বারা মিশর আক্রান্ত
হয়েছিলো। তিনি যুদ্ধের মধ্যে ৪,০০০ নারীকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও নার্সিং প্রশিক্ষণে
সাহায্য করেছিলেন।
আতেয়া একটি মহিলা কমান্ডো ইউনিটে ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধের সময় তিনি ‘সোসাইটি অফ ফ্যামিলি অফ মার্টির্স অ্যান্ড সোলজারের’ সভাপতিত্ব করেছিলেন, যাতে তিনি "শহীদ যোদ্ধাদের মা" ডাকনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ‘তৃতীয় সেনা ব্যাজ’, ‘৬ অক্টোবর মেডেলিয়ন’ এবং ‘সশস্ত্র বাহিনীর পদক’ লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে মিশরের
নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের মিশরীয় মহিলাদের
ভোটাধিকার এবং নির্বাচিত পদের যোগ্যতা প্রসারিত করেছিলেন। তার পরের বছর ৩ জুলাই
১৯৫৭ নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ২০০০-এরও বেশি
প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১৬ জন মহিলা ছিলেন। সেই সময়ে পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা
গেছে যে ৭০% মিশরীয় পুরুষ সংসদে মহিলাদের আসন গ্রহণের ধারণার বিরোধী ছিলেন। তা
সত্ত্বেও আতেয়া প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তার নির্বাচনী এলাকায় ১১১,৮০৭ ভোট পান।
দ্বিতীয় রাউন্ডে কায়রো থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনি যে প্রবল পক্ষপাতের মুখোমুখি
হয়েছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে:
"একজন
মহিলা হওয়ার জন্য আমি বিরক্তির মুখোমুখি হয়েছিলাম। তবুও আমি তাদের সাথে কথা
বলেছিলাম এবং তাদের নবীর স্ত্রী এবং পরিবারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, যতক্ষণ
না তারা তাদের পরিবর্তন করে”।
এই ধরনের ধর্মীয়
যুক্তি ছাড়াও তিনি তার সামরিক অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
আতেয়ার বিজয় ছিলো
আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কমিউনিস্টপন্থী আইনজীবী
এবং ব্যাংকার আহমেদ ফুয়াদ যিনি প্রেসিডেন্ট নাসেরের ব্যক্তিগত বন্ধু এবং অভিভাবক
ছিলেন।
আতেয়া ১৪ জুলাই ১৯৫৭
সালে জাতীয় পরিষদে তার আসন গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে অন্য একজন মহিলাও
(আমিনা শুকরি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বিজয় ২২ জুলাই ঘোষণা করা হয়েছিল।
এভাবে আতেয়া মিশর
এবং সমগ্র আরব বিশ্বের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
পার্লামেন্টে থাকাকালীন আতেয়া নারী অধিকারের পক্ষে ছিলেন। যদিও কায়রো এবং
আলেকজান্দ্রিয়ার মতো শহুরে জেলাগুলির বেশিরভাগ এমপিদের দ্বারা সমর্থিত এই আইনগুলি
গ্রামীণ জেলার প্রতিনিধিত্বকারী এমপিরা তীব্রভাবে বিরোধিতা করায় পাস হয়নি।
ভারত, সোভিয়েত
ইউনিয়ন এবং চেকোস্লোভাকিয়া সফরের শেষে দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন:
"আমি
রাশিয়াকে দেখেছি, কিন্তু আমি সত্যিই মনে করি যে আমি মিশরকে আরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
মতো দেখতে চাই”।
তিনি প্রকাশ্যে
বলেছিলেন যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেন এবং এর প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার।
এই অবস্থানের জন্য তাকে আক্রমণ করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট নাসেরের
প্রতি তার দৃঢ় সমর্থনের কারণে সমালোচনা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হন। প্রেসিডেন্ট
নাসেরকে তিনি "সুন্দর" বলে বর্ণনা করেছিলেন।
১৯৫৭ সালে আতেয়ার
বিজয় স্বল্পস্থায়ী ছিলো। দুই বছর পর তিনি পুনঃনির্বাচনের জন্য তার জামানত হারান।
যাইহোক, তিনি সক্রিয় ছিলেন এবং উল্লেখযোগ্যভাবে রেড ক্রিসেন্ট বোর্ডে কাজ করেছেন।
আতেয়া তার নির্বাচনী
পরাজয়ের পঁচিশ বছর পর পূনরায় তার সংসদীয় কর্মজীবন পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হন।
একজন সামাজিক গণতন্ত্রী হিসেবে তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির ব্যানারে ১৯৮৪
সালে পিপলস অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালে গিজার জন্য জনসংখ্যা এবং
পরিবার কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। আতেয়া ১৯৯৭ সালে ৭১ বছর বয়সে মারা যান।
রাউয়া আতেয়াকে মিশরীয় এবং আরব নারীবাদের ইতিহাসে একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে আতেয়ার নির্বাচনী বিজয়ের ৫০ তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য মিশরীয় সংসদে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিদের মধ্যে বাহরাইনের ‘লতিফা আল গাউদ’ উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার এক বছর আগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম মহিলা এমপি হয়েছিলেন।
লাতিফা গাউদ |
সেইসাথে আরো উপস্থিত ছিলেন বাহরাইনের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী ‘নাদা হাফফাদ’।
নাদা হাফফাদ |
সূত্রঃ ইন্টারনেট