বঙ্গদেশের রাজধানী সমাচার --খোন্দকার আব্দুল হান্নান

 

মহাস্থানগড়

ইতিহাস পড়তে বা জানতে কার না ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন "স্মারণিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী"র প্রতিষ্ঠাতা, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার আব্দুল হান্নান-এর উপরোক্ত বিষয়ের উপর ২০১৬ সালের একটি লেখা তার ফেসবুক ওয়াল থেকে কপি করে পোষ্ট কোরলাম। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।

==========================================

“প্রজা পালনের জন্য রাজা অপরিহার্য। রাজা যেখানে স্থায়ীভাবে বাস করেন --তার নাম রাজধানী। এখন রাজার জায়গায় নির্বাচিত নেতা এসেছেন। এ ব্যবস্থা যেখানে চালু নেই--তাকে আপাতত আমরা আলোচনার বাইরে রাখি। প্রজাকুলের জায়গায় এসেছে নাগরিক সমাজ। সুতরাং যেটা দাঁড়ালো তা হলো -নাগরিক সমাজ জনপদে বসবাস করবে -তাদের নির্বাচিত নেতা রাজধানীতে অবস্থান করবেন এবং জনপদের মঙ্গলদীপের আলোকশিখাটিকে প্রজ্বলিত রাখবেন।

 

আমাদের এই প্রাচীন পৃথিবীতে বঙ্গ নামের জনপদটির কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করছি। হিমাচলগর্ব-চূড়ামণি এভারেস্টকে পেছনে রেখে সম্মুখে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র বঙ্গোপসাগরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে যে দেশটি দাঁড়িয়ে আছে -সেটিই আমাদের বাংলাদেশ। দেশটির শাসককুলের বারবার পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে রাজধানীরও বারবার পরিবর্তন ঘটেছে। এগুলো আমাদের ইতিহাসের অনবদ্য অংশ। আমাদের বিশ্বপরিচিতির উজ্জ্বল এই অধ্যায়টি জানতে হলে আমাদের একটু ঘুরে আসতে হবে পুরাতন এই রাজধানী-মহানগরীগুলোর রাজপথে এবং রাজপ্রাসাদের আঙিনায়। নাতিদীর্ঘ এই তালিকাটিতে আছে— কোটালীপাড়া -মহাস্থানগড় –বিক্রমপুর –সোনারগাঁ -গৌড় –মুর্শিদাবাদ -কলকাতা ও ঢাকা। আসুন, আমরা একটু দেখে নিই।

 

(১)কোটালীপাড়া:

নাম বঙ্গ। রাজা গঙ্গাহৃদয়। রাজধানী কোটালীপাড়া। গোপালগঞ্জ থেকে ১৮ কিলোমিটার আর বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান ও সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়া থেকে ১০ কিমি দূরে অবস্থিত ওই নগরীর এখনকার নাম কোটালীপাড়া। আত্মবিস্মৃত বাঙালির কাছে তার নাম-ঠিকানা- স্মৃতিচিহ্ন কোনো কিছুরই অবশেষ নাই। বিদেশী গ্ৰীক পরিব্রাজকের লেখা থেকে জানতে পারি এই রাজাধিরাজের বিরাটত্বের কাহিনী।

ম্যাসিডোনিয়ার রাজকুমার ফিলিপপুত্র আলেক্সান্ডার পিতার মৃত্যুর পর ম্যাসিডোনিয়ার রাজা হলেন। তিনি বিশ্বজয়ে বের হলেন। একে একে তিনি গ্রীস, ইতালি,  যুগোস্লাভিয়া, মিশর, সিরিয়া, পারস্য জয় করে ভারতবর্ষ অভিমুখে অগ্রসর হলেন। পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর পাড়ে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তক্ষশীলার রাজা পুরুকে পরাজিত করে তক্ষশীলায় তাঁর রাজত্ব কায়েম করলেন।

দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় ও রণশ্রমে কিঞ্চিৎ ক্লান্ত আলেক্সান্ডার, এবার কি করা যায়- এ বিষয়ে আলোচনার জন্যে তাঁর সভাসদ রণকৌশলী-পন্ডিত-পরামর্শক ও সেনাধ্যক্ষদের নিয়ে বসলেন। তাঁরা পরামর্শ দিলেন বঙ্গদেশে গঙ্গাহৃদয় নামে এক সম্রাট আছেন। তাঁর বিশাল বাহিনীতে মোতায়েন আছে ২০,০০০ অশ্বারোহী সেনা, ২০০,০০০ পদাতিক, ২,০০০ চার-ঘোড়ার চারিযট এবং ৬,০০০ হাতি। সুতরাং গ্রিক বাহিনীর শক্তি গঙ্গাহৃদয়ের সেনাবাহিনীর শক্তির কাছে একেবারে নগন্য। এমনি পরামর্শ শুনে আলেক্সান্ডার তাঁর অদম্য মনোবল হারিয়ে ফেললেন। তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

গ্রীক পরিব্রাজক মেগাস্থেনিস লিখিত 'ইন্ডিকা' বইয়ে পরিবেশিত সন্-তারিখ সম্বলিত আমাদের এই গৌরব-গাঁথা আমরা যখন পড়ি, এক অনাবিল আনন্দ-ধারায় আমরা আপ্লুত বোধ করি; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বোধও আমাদের মনের মধ্যে উঁকি দেয় --সেটা হলো, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের কাহিনী কেন নিজেরা জানি না, কেন বিদেশিদের কাছ থেকে আমাদেরকে এ সব শুনতে হয়, জানতে হয় ?

 

(২) মহাস্থানগড়:

মহাস্থানগড়। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত দীর্ঘ ইতিহাসের স্বাক্ষরবাহী একটি নগরী। প্রাচীন তিন-চার হাজার বছরের কীর্তি-কাহিনীতে ভরপুর এই নগরীর প্রমাণিত রেকর্ড-পত্রেই খ্রিস্টপূর্ব তিন শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত জ্বলজ্যান্ত সভ্যতার নিদর্শন বিদ্যমান যা যে কোনো বিদেশী পরিব্রাজক বা দেশি ভ্রমণকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। গবেষক স্যার আলেক্সান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সনে প্রমান করেছেন ইউয়ান চ্যাং বর্ণিত সপ্তম শতকের পুন্ড্র নগর আজকের মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড়। বিশাল এক রাজপুরী। ইতিহাসের যাত্রাপথে এমনি এক দীর্ঘজীবী নগরীর সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। ভারতীয় উপমহাদেশের শীর্ষ শাসককুল যেমন- মৌর্য, গুপ্ত, পাল --এ সব সম্রাটদের সাম্রাজ্যে কখনো আঞ্চলিক, কখনো বা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় অভিষিক্ত এ নগরী কখনো কখনো কেন্দ্রীয় রাজধানীর  মর্যাদাও পেয়েছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা চলে পাল বংশের শুরুর দিকে মহাস্থানগড়ই ছিল তাদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী যেখান থেকে তাঁদের সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত তাঁরা শাসন করতেন। ১২০৪ সনে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেনকে যখন পরাজিত ক'রে বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রবর্তন করেন, তিনি মহাস্থানগড়কেই রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করেন। মুসলিম সাধক শাহ সুলতান ইবরাহিম বিন আদহাম বলখী মাহি সাওয়ার পুন্ড্রবর্ধনের রাজা পরশুরামকে পরাভূত ক'রে (১৩৪৩খ্রি) মহাস্থানগড়ে তাঁর কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই তিনি তাঁর ধর্মপ্রচারের কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।

ইতিহাসের অব্যাহত গতিধারায়ও যেমন এক সময়ে ছেদ পরে, তেমনি মহাস্থানগড় নগরীরও ক্রমবর্ধমান অবয়বে ভাটার ঢেউ এসে লাগে। ধীরে ধীরে অন্যান্য নগরীরও রাজনৈতিক এবং সামরিক গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী তিন শতকের মধ্যে মহাস্থানগড় মহানগরী পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়I

 

(৩) বিক্রমপুর:

বাংলার রাজধানী-নগরীর তালিকায় বিক্রমপুর একটি নাম। প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের লীলাভূমি বিক্রমপুরের অবস্থান বর্তমান  মুন্সিগঞ্জ জিলাৰ রামপাল ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে। বঙ্গদেশের চন্দ্র-সেন প্রভৃতি রাজবংশ সমূহের রাজত্বকালে তাঁদের রাজধানী হিসাবে খ্যাত এই বিক্রমপুর।

রাজধানী-নগরী হিসাবে এর ব্যাপ্তিকাল দশম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত প্রায় তিন’শ বছর। এমন কি সেনবংশের রাজারা যখন বাংলা শাসন করেন তখন তাঁদের রাজধানী গৌড় বা মহাস্থানগড় যেখানেই থাকুক না কেন নদিয়ার নবদ্বীপে তাঁরা অস্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপন ক'রে কিছুটা প্রশাসনিক কর্মকান্ড চালাতেন। এমনি কার্যক্রম চালানো কালে লক্ষণ সেন বখতিয়ার খিলজি দ্বারা আক্রান্ত হন। তিনি পালিয়ে বাঁচেন এবং নবদ্বীপ ছেড়ে বিক্রমপুর এসে আশ্রয় নেন। এই বিক্রমপুরকে কেন্দ্র করে তিনি তাঁর নুতন প্রশানিক রাজ্য গড়ে তোলেন এবং বংশপরম্পরায় সেন রাজারা এখানে রাজত্ব চালাতে থাকেন।

সেন রাজা বল্লাল সেন স্মৃতিবাহী বল্লালবাদী ভবনের ধ্বংসাবশেষ আজও বিক্রমপুরে সেন রাজবংশের পরিচয় বহন করছে যেমন, সুবিশাল রামপাল দীঘির সাথেও জড়িয়ে আছে বল্লাল সেনের নাম। রাজধানী বিক্রমপুরের অনতিদূরেই সোনারগাঁও। দশরথদেব ওরফে ধনুজ রায় নামে এক রাজা সুবর্ণগ্রামে বা সোনারগাঁও এ তাঁর রাজধানীর পত্তন করেন। ধীরে ধীরে সোনারগাঁও এর গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিক্রমপুরের গৌরবময়  অবস্থায় ভাঁটা পড়ে।

 

(৪) সোনার গাঁ:

সোনারগাঁ। প্রাচীন নাম সুবর্ণগ্রাম। কালের বিবর্তনে সোনারগাঁ তার আধুনিক নাম। সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী। কখনো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার আবার কখনো দিল্লী সালতানাতের অধীনে প্রাদেশিক বা সুবে বাংলার রাজধানী। আমরা এই স্বল্প পরিসরে তারই একটু বিবরণ প্রকাশ করছি।

বৌদ্ধ রাজা ধনুমাধব দশরথদেব বিক্রমপুর থেকে তাঁর রাজধানী মধ্য-ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে সুবর্ণগ্রামে স্থানান্তর করেনl চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লক্ষণাবতীর সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সুবর্ণগ্রাম দখল ক'রে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। ফিরোজ শাহের পর গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৩২৪ সনে দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেন। যুদ্ধে বাহাদুর শাহ পরাজিত হন। সোনারগাঁও সহ সমগ্র বঙ্গদেশ দিল্লির অধীনে চলে যায়। এক বছর পর মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির ক্ষমতায় আসেন এবং তিনি বন্দী বাহাদুর শাহকে মুক্তি প্রদান ক'রে সুবে বাংলার গভর্নর পদে নিয়োগ দান করেন। চার বছর গভর্নর হিসাবে কাজ করার পর তিনিও বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বাহাদুর শাহ্‌’র পর বাহরাম খাঁ এবং অতঃপর ফখরুদ্দিন মোবারাক শাহ সোনারগাঁর ক্ষমতায় আসেন। এরপর লক্ষণাবতীর সুলতান ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ দখল করেন এবং তিনি সমগ্র বাংলার সম্রাট হন। তিনিই একক ভাবে সর্ব প্রথম সমগ্র বাংলার অধিপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, হন্স বাও (১৪৩২), রালফ ফিচ, নিকোলো দে কনটি প্রমুখ সুধিবর্গ তাঁদের ভ্রমণলিপিতে এসব বিবরণের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

 

(৫) গৌড়:

গৌড়। বাংলার রাজধানী হিসাবে গৌড়ের নাম অধিকতর ব্যাপকভাবে পরিচিত। গৌড়ের আরেক নাম লক্ষণাবতী। বংলাদেশ-ভারত তথা দুই বাংলার সাধারণ সীমান্ত জুড়ে বিশাল এলাকায় আজও বিদ্যমান এই রাজধানী-নগরী গৌড়। এই নামটির পশ্চাতে সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন যিনি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে নিজে পালিয়ে বাঁচেন, তাঁর নামটি জড়িত।

যাই হোক পাল সম্রাটদের শেষ ভাগে যখন তাদের শক্তির মান হ্রাস পেতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে সেনরাজারা লক্ষণাবতী অর্থাৎ গৌড়কে কেন্দ্র করে তাদের আধিপত্য বৃদ্ধি করতে থাকে। সুতরাং গৌড়ের পত্তন যদিও পাল সম্রাটদের সময়ে, তবে সেটা পালদের বিরোধী শক্তি হিসাবে সেনদের পৃষ্ঠপোষকতায়, গৌড়ের বিকাশও ঘটে সেন রাজাদের সময়ে আর  পরিশেষে চরম উৎকর্ষ লাভ মুসলিম সুলতানদের প্রত্যক্ষ অবদানে।

সপ্তম শতকে জন্ম নিয়ে হাজার বছর ধরে এই মহানগরী সভ্যতার ভাণ্ডারে শত শত স্থাপনা আর সৌধমালার অবদান রেখে গেছে যার বর্ণনা প্রদান এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়।

 

(৬) মুর্শিদাবাদ:

মুর্শিদাবাদ। নিকট অতীতের রাজধানী-নগর হিসাবে মুর্শিদাবাদের নাম উল্লেখ্য। বাংলার রাজধানী হিসাবে সময়ের মাপে এর ব্যাপ্তিটা অতো বিশাল না হলেও একটি কারণে এর গুরুত্ব অপরিসীম-আর তা হলো অর্ধেক পৃথিবীর এককালের প্রভু ইংরেজ জাতির উত্থানের শুরু মুর্শিদাবাদের পতনের মাধ্যমে।

এবারে একটু পরিষ্কার করে বলি। এই নগরীর পত্তন সম্রাট আকবরের সময়ে। তখন এর নাম ছিল মোকসুদাবাদ। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০৪ সনে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সদর দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানকে নিজ নামে এ নগরীর নামকরণেরও অনুমতি দেন। তখন থেকে মুর্শিদাবাদ বাংলা বিহার উড়িষ্যার সদর দফতর হিসেবে পরিগণিত হয়। পরবর্তীতে দিল্লির ক্ষমতায় দুর্বলতা দেখা দিলে মুর্শিদকুলি খান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন ভাবে মুর্শিদাবাদের প্রশাসন চালাতে থাকেন। এটা ১৭২৭ সন।

সময় দ্রুত পাল্টাতে থাকে। এর পর নবাব সুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খান, নবাব আলীবর্দী খান এবং পরিশেষে (১৭৫৬) নবাব সিরাজুদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। কিঞ্চিতোধিক এক বছরের মাথায় পলাশীর মাঠে বিনা রক্তপাতের এক যুদ্ধে (১৭৫৭) সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ঘটে এবং বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক হয়। বাংলার স্বাধীনতা পরবর্তী দুই শতাব্দীর জন্যে অস্তমিত হয়ে যায়। সমগ্র ভারতের পরাধীনতার যুগেরও অশুভ সূচনা রচিত হয়। যাই হোক রাজধানী হিসাবে মুর্শিদাবাদ আরো কিছুকাল টিকে থাকে। ১৭৯০ সনে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় চলে যায়।I

 

(৭) কলকাতা:

প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক বাংলার রাজধানী-নগরীর তালিকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে আছে কলকাতা মহানগরী। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে কলকাতার অবস্থান শুধু বাংলার রাজধানী হিসাবেই নয়, বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত শীর্ষখ্যাত উপনিবেশ ভারতের রাজধানী হিসাবে এর ব্যাপ্তি ও খ্যাতি কলকাতাকে যে সম্মানে ভূষিত করেছে, তা বিশ্বের আর কোনো মহানগরীর সঙ্গে তুলনীয় নয়। আধুনিক কালে নির্মিত এই মহানগরীর তেমন সুদীর্ঘ কোনো ঐতিহাসিক অবস্থান নেই, কিন্তু বিগত কিঞ্চিতোধিক চার শতক জুড়ে আছে তার ক্ষিপ্র গতিতে ধাবমান সতত পরিবর্তনের ধারা –-এক বিশাল ঐতিহাসিক দৃশ্যপট। গুরুত্ব বিবেচনায় কলকাতা মহানগরীর জীবনকালকে মোটামুটি তিনটা পর্যায়ে ভাগ করা চলেঃ-

(১) ব্রিটিশ বন্দর-উপনিবেশ হিসাবে পত্তন ও বিকাশ-পর্যায় (১৬০৪-১৭৯০);

(২) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ-রাজের অধীনস্ত অবিভক্ত ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় রাজধানী থাকাকালে ক্রমবর্ধমান পর্যায় (১৭৯০-১৯১১) এবং

(৩) কেন্দ্রীয় রাজধানীর মর্যাদা হারানো-পরবর্তী ক্রমহ্রাসমান পর্যায় (১৯১১-পরবর্তী কাল)।

কলকাতা নগরীর পত্তন ঠিক কবে হয়েছিল এ নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য ও কিংবদন্তির গল্প চালু আছে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমান নিয়ে ১৬৮২ সনে হুগলিতে ৩০০ তোপধ্বনির মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যযাত্রা শুরু হয়। দিল্লি-ঢাকা-মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি প্রশাসনের সঙ্গে ইংরেজদের বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিবাদ-বিতন্ডার পর পুনরায় বাদশাহী ফরমান নিয়ে ১৬৯০ এর ২৪শে অগাস্ট কলকাতার পুনরায় পত্তন করেন জব চার্ণক। সাম্প্রতিক কালে কলকাতা হাইকোর্ট জব চার্ণক কর্তৃক কলকাতা নগরীর পত্তন সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘প্রাচীন ভারতের যুগ থেকেই কলকাতা একটি বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে চালু ছিল’।

যাই হোক, পত্তন যখনই হোক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত দিয়েই কলকাতার বাস্তব পথযাত্রা শুরু হয় এবং বেনিয়া ইংরেজ কোম্পানির হাতের বানিজ্যদন্ড রাজদণ্ডের মর্যাদায় অভিষিক্ত হলে ইংরেজদের সকল কার্যক্রম ও কর্মকান্ড কলকাতাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। শুধু সেখানেই নয়, ধীরে ধীরে ব্রিটিশ রাজশক্তি যখন বিশ্ব পরিমণ্ডলে সবচাইতে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয় তখন এই কলকাতা নগরীই বহির্বিশ্বে তাদের সকল শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে চিহ্নিত হয়। কলকাতা মহানগরীর খ্যাতি ও যশ নিঃসন্দেহে যেমন আকাশচুম্বী হয়েছিল তেমনই কলকাতাকে ঘিরে কিছু মিশ্র কথা-বার্তাও মিডিয়াতে প্রচলিত ছিল। যেমন যে নাম বা অনানুষ্ঠানিক খেতাব কলকাতার ভাগ্যে জুটেছিল সেগুলো আমরা এখানে সন্নিবেশ করতে পারি :-

(১) The City of Palaces

(২) The Cultural Capital of India

(৩) The City of Joy

(৪) The City of Processions

(৫) The Dying City

(৬) The City of the Great (Calcutta) Killing of 1946

এসব সত্বেও কলকাতার যশস্বী ও খ্যাতিমান মনীষীদের যদি একটি স্বল্পদীর্ঘ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিই, সেই তালিকাটিও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে বাধ্য। এমনটি চেষ্টা করে দেখা যাক ---

§  জব চার্ণক

§  উইলিয়াম কেরি

§  কর্নেল ক্লাইভ

§  ওয়ারেন হেস্টিংস

§  লর্ড কর্নওয়ালিস

§  লর্ড বেন্টিঙ্ক

§  দ্বারকানাথ ঠাকুর

§  মাইকেল মধুসূদন দত্ত

§  রাজা রাম মোহন রায়

§  র্সৈয়দ আমির আলী

§  রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

§  স্বামী বিবেকানন্দ

§  নওয়াব আব্দুল লতিফ  

§  ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর

§  সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী

§  বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়

§  বিপিন চন্দ্র পাল Oরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

§  হাজি মহাম্মাদ মহসিন

§  লর্ড কার্জন

§  জন এলিয়ট বেথুন

§  স্যার আব্দুর রহিম

§  দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

§  নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু

§  শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হুক

§  আবুল হাশেম

§  মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

§  হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

§  সত্যেন বোস

§  স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু

§  আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

§  কাজী নজরুল ইসলাম

§  বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন

§  ডক্টৰ মুহাম্মদ কুদরত ই খুদা

§  তমিজউদ্দিন খান

§  সৈয়দ মুজতবা আলী

§  হুমায়ুন কবির

§  মাদার তেরেসা এবং

§  তরুণ ছাত্রনেতা (পরবর্তীতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এখন কলকাতা ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী। যদিও কলকাতা আমাদের জন্য একটি বিদেশী নগর, তবুও কলকাতার সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক যোগ রয়ে গেছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি--এর প্রায় সবটাই কোনো না কোনো ভাবে কলকাতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কলকাতার  ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় অর্জিত খেতাবসমূহের মধ্যে একটি ‘দি সিটি অফ পালাসেস’ অর্থাৎ অট্টালিকার নগরী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে শুরু করে হাজার হাজার প্রাসাদোপম ভবনের সমাহার নিয়ে এই কলকাতা। কিন্তু শত শত বছরে নির্মিত হাজার হাজার অট্টালিকার ব্যয়ভার কে বা কারা বহন করেছে?

জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই সখেদে উচ্চারণ করেছেন, “আমাদের (বাঙালিদের) টাকায় গড়ে উঠেছে কলকাতা-দিল্লি-আগ্রা-করাচী-পিন্ডি-ইসলামাবাদ”।

 

এখন ফিরে আসি আবার কলকাতায়। ভারত বিভাগের সময় বাংলাও ভাগ হলো। কলকাতা পশ্চিম বাংলার ভাগে পড়লো। পূর্ব বাংলার ভাগে কোনো রাজধানী নাই। সুতরাং রাজধানী তৈরী করে নিতে হবে। কথা হলো কলকাতার অর্ধেক মূল্য পূর্ব বাংলা পাবে। সীমানা ভাগের পন্ডিতেরা হিসাবে বসলেন। এই ব্যাপারে দুইটা নিয়মের মধ্যে ধাঁধাঁ বাধলো। একটা –-যে অর্থ ব্যয়ে কলকাতার ভবনসমূহ তৈরী, তার সঙ্গে দীর্ঘ অতিক্রান্ত সময়ের অবমূল্যায়ন প্রয়োগ করে একটা মূল্য নির্ধারণ করা। অন্যটা হলো বাজার দরে প্রতিটি ভবনের মূল্য হিসাব করা। দেখা গেলো অবমূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগে পূর্ব বাংলা তো কোন অর্থই পায় না বরং উল্টা আরো অবমূল্যায়নপ্রসূত ঘাটতিমূল্য পরিশোধ করতে হয়।

যাই হোক, ইতিমধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হলেন আর খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীকে হটিয়ে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। জিন্নাহ সাহেবের জন্যে এটা জীবনের প্রথম ক্ষমতা-প্রাপ্তি আর যদিও নাজিমুদ্দিন অতীতে বহু প্রকার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, কিন্তু নিজ শহর ঢাকার বুকে ক্ষমতার স্বাদ ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। এঁরা উভয়ই ক্ষমতার স্বাদ ভোগের জন্য অধৈর্য হয়ে পড়লেন। উপরন্তু কলকাতার মূল্য ভাগ-পদ্ধতিতে একটা নুতন মাত্রাও যুক্ত হলো। সেটা লাহোর।

বাংলার মতো পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছে। কলকাতার মতো লাহোরেরও মূল্য ভাগ হতে হবে। এটার দায় পশ্চিম পাঞ্জাব সরকারের। বিষয়টা পদ্ধতিগত কারণেই প্রাদেশিক সরকার থেকে কেন্দ্রে গড়ালো। সিদ্ধান্ত হলো কলকাতার সঙ্গে লাহোরের দেনাপাওনা কাটাকাটি হবে। সুতরাং কাউকে কোনো দেনা পরিশোধ করতে হবে না। আমরা বাঙালিরা পাঞ্জাবিদের লাহোরের দেনার মূল্যে আমাদের কলকাতার পাওনা মূল্য ছেড়ে দিলাম আর নুতন করে রাজধানী নির্মাণের ট্যাক্স গুনতে লাগলাম।

 

(৮) ঢাকা:

ঢাকা এখন আমাদের প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। ঢাকা আবার দেশের বৃহত্তম নগরীও বটে। ১৯৭১ সনে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করে ঢাকাকে রাজধানী করলেও ঢাকা নগরী এই জনপদের আগেও রাজধানী ছিল।

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবে বাংলার রাজধানী হিসাবে ঢাকার নুতন নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরনগর। পরবর্তী কালে এই নামকরণ লোপ পেয়ে যায় এবং নগরীর ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে ঢাকা নামটিই প্রতিষ্ঠা পায়। মোগল আমলের ঢাকা এক বিশাল নগরী। ২২ কিমি দীর্ঘ ১২ কিমি প্রস্থ শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গা-তুরাগ পরিবেষ্টিত প্রাচ্যের ভেনিস নাম অভিহিত এই নগরী ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছিলো। ভারতবর্ষের সাড়ে ছয়’শ বছর অব্যাহত মুসলিম শাসনের মধ্যে অর্ধেকটাই মোগল শাসন। এই মোগলদের শাসন আমলে সারা ভারতের আয়ের অর্ধেকটা আসতো এই বাংলা তথা ঢাকা থেকে। এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে ধন-সম্পদের দিক থেকে ঢাকা তখন কোন পর্যায়ে ছিল। রাজধানী হিসাবে ঢাকার অভিজ্ঞতা মোট চার বারের:-

(১) ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭০৪ পর্যন্ত সুবে বাংলার রাজধানী ।

(২) ১৯০৫ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী।

(৩) ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বংগ তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী এবং

(৪) তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের পর (২৬শে মার্চ ১৯৭১) থেকে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী।

 

শিল্পবাণিজ্যে মোগল আমলে ঢাকার ভূমিকা প্রবল শক্তিশালী ছিল। ইউরোপের বাজারগুলোতে ঢাকার মসলিন শাড়ীর চাহিদা আকাশচুম্বী ছিল। ফলে আমাদের দেশের তাঁতি সমাজের জন্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকুলের জন্য এটা নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ ছিল। এই অবস্থার ব্যত্যয় ঘটলো ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ঢেউয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ইংল্যান্ডের কলে তৈরী কাপড় এই দেশের বাজার- গুলোতে নির্বিঘ্নে চালানোর জন্যে দেশি তাঁতের কাপড়ের 'পর প্রচন্ড রকমের করের বোঝা আরোপ করলো। উপরন্তু তারা তাঁতিদের উপর অমানবিক ভাবে শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত চালাতে লাগলো। এরই ফলশ্রুতিতে ঢাকার বিশ্বনন্দিত মসলিন একেবারে লোপ পেলো এবং একটি বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি চিরকালের জন্য মুখ থুবড়ে পড়লো।

মোগল আমলে সুপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা মহানগরীর স্থাপনাগুলো নিঃসন্দেহে চমৎকারিত্বের দাবি রাখে। ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ঈদগাহ ময়দান, ছোট কাটরা বড় কাটরা, চক-মসজিদ ইত্যাদি মোগল যুগের নিদর্শন হিসাবে টিকে আছে। ইউরোপ থেকে আগত মিশনের লোকগুলো বিভিন্ন ভবনে ও এলাকায় তাদের সাক্ষর রেখে গেছে তা আজও নামের মধ্য দিয়ে তাদের এক সময়ের উপস্থিতি প্রকাশ করে। যেমন আর্মেনিয়ান-দের নামে আরমানিটোলা, পর্তুগিজদের নামে পোস্তগোলা, ফরাসিদের নামে ফরাশগঞ্জ ইত্যাদি।

যখন বাংলা ভাগ হয়ে ঢাকায় পূর্ব বাংলার রাজধানী হলো, তখন রমনা এলাকায় নগর পরিকল্পনার ভিত্তিতে এক সুরম্য নগরীর আদর্শ চিত্রপুরী তৈরী হয়--যা চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো এক সুবিন্যস্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুপম সৌন্দর্যের এই নিসর্গপুরী কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সনে ঢাকাস্থ পুর্ব বাংলার রাজধানী যখন বাতিল করলেন তখন এই পরিকল্পিত নগরীটিকে পরবর্তী কালের নির্মিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্ৰদান করা হয় এবং রমনার নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে অভিহিত হয়।

ঢাকা মহানগর। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার। সমগ্র ভারতবাসীর মুক্তি সংগ্রামের পীঠস্থান যে বাংলা তারই দুই মহানগরী--কলকাতা আর ঢাকা। কলকাতায় জন্ম অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের; এরই বিশ বছর পর ঢাকায় জন্ম অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগকে জন্ম দিয়ে বাঙালি প্রমান করলো পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার ব্রতমন্ত্রে সবচেয়ে সচেতন জাতি বাঙালি। তাই গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এই বাঙালির প্রতি সপ্রশংস দৃষ্টিতে উচ্চারণ করেছেন, “What Bengal thinks today, India thinks it to-morrow”.

ইতিপূর্বে ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিপ্লবের সময়ে বাঙালি সিপাহীদের অংশগ্রহণ এবং ব্রিটিশ শাসকের দালালদের হাতে ধরা পড়ার পর সেপাহীদের করুন মৃত্যু আজও ঢাকাবাসী গভীর বেদনাভরে স্মরণ করে। পুরানো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, যেখানে সেই সময়ে বিশাল আমবাগান ছিল, আজ সেই পার্ক সেপাহীদের আত্মত্যাগ- স্মৃতিরই স্বাক্ষর বহন করে।

১৯৪৭ সনের ১৪ই আগস্ট। অবহেলিত পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তান হলো। ১৯৪৮এর ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সদ্যনির্মিত ১৮ ফুট উঁচু মঞ্চের পর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সদম্ভে ঘোষণা দিলেন,

“Let me make it clear to you that the State Language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead (you) is merely the enemy of Pakistan.”

দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষ জিন্নাহর এই হুঙ্কারে মর্মাহত হলেন। যে স্বপ্ন এতদিন ধরে বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে ছিল জিন্নাহর এক হুঙ্কারে তা আকাশে উড়ে গেলো। শেরে বাংলার লাহোর-প্রস্তাব (২৩ মার্চ, ১৯৪০), সোহরাওয়ার্দির দিল্লী প্রস্তাব (এপ্রিল ৭-৯, ১৯৪৬) সহ যে সকল ঘটনার মাইলফলকসমূহ একটা একটা করে গত চার দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের পুব-পশ্চিমের সকল মুসলিম ভাইদেরকে এক নিবিড় বন্ধনে বেঁধেছিলো জিন্নাহর সদম্ভ কর্কশ হুঙ্কারে সে বন্ধন ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সতত সচেতন বাঙালির ভাবনায় আজীবন লালিত পাকিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে গেলো; চেতনাসমৃদ্ধ তাদের মনোজগৎ নুতন স্বপ্নের সন্ধানে পা বাড়ালো।

 

১৯৪৯ সনের ২৩ শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান আমলের পুরা সময়টা জুড়েই চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের রণক্ষেত্র এই ঢাকা। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ত্যাগ ও সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দিলেন,

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"।

তারপর প্রাণপণ যুদ্ধ এবং ন'মাস একটানা রক্তক্ষরণ। ঢাকা তখন পরিত্যক্ত এক ভয়াল মৃতনগরী; দখলদার ঘাতক পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে এক শ্মশানপুরী। আকাশ-ভরা বারুদের ধুঁয়া; বাতাসে লাশের গন্ধ। এমনি করে চলে ন'মাস, যার এক-একটি রাত যেন হাজার মাইল রাস্তার মতোই দীর্ঘ। অতঃপর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে রক্তপিপাসু ঘাতক বাহিনীর আত্মসমর্পনের মাধ্যমে সূচিত হলো বাঙালির বিজয়।

“প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,

দুঃখের পথে তোমার তুর্য বাজে,

অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে--

মৃত্যুর হোক লয়।

তোমারি হউক জয়”।।“

================

সবাইকে ধন্যবাদ।I

--খোন্দকার আব্দুল হান্নান

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url