বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক জীবন

 


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান


অনেকেই জানেন না, বাংলাদেশের মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের প্রয়োজনে এক সময় জীবনবীমায় চাকরি করেছেন। তেমনি রাজনৈতিক প্রয়োজনে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

 

বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকতা করেছেন - একথা শুনলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। অনেকেই হয়তো ভাববেন, বাল্যকাল থেকেই যিনি সমাজের কল্যাণকর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা সাজানো মামলায় জীবনের অধিকাংশ সময় পাকিস্তান সরকারের কারাগারে আটক ছিলেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সাংবাদিকতার মতো পেশায় জড়িত হওয়ার সময় ও সুযোগ হলো কিভাবে? কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সাথে সব সময়ই একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। তিনি নিজেও রাজনৈতিক জীবনে অন্য সব দায়িত্বের পাশাপাশি সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার সাথেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এবং সেটা মূলতঃ রাজনৈতিক প্রয়োজনেই।

 

রাজনৈতিকভাবে তিনি যেমন দেশের মানুষের কল্যাণে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষের সেবায় সব সময়ই ব্রত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের নানাদিক বর্তমান প্রজন্মের জানা থাকলেও তাঁর সাংবাদিকতার জীবন ও সংবাদপত্রের সঙ্গে সম্পর্কের কথা অনেকেরই জানা নেই।

 

আমরা যদি জাতির জনকের ব্যক্তিজীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করি, দেখতে পাবো সে সময়ের কবি, লেখক ও সাহিত্যিকরা যে ধরণের পোশাক পরিধান করতেন, বঙ্গবন্ধুও অনেকটা সে ধরণের পোশাক পরিধান করতে ভালোবাসতেন। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, কালো রঙের মুজিব কোটের উপর হালকা রঙের চাদর জড়ানো, মুখে টোব্যাকো পাইপ ইত্যাদি ছিলো তার প্রায় সর্বসময়ের ভূষণ। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও তিনি এ ধরণের পোশাক পরিধান করতেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত নেতা হয়েও তার চলাফেরা, পোশাক-আশাকের কোনো পরিবর্তণ লক্ষ্য করা যায়নি।

 

তিনি সরাসরি সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন। সংবাদপত্র জগতে তিনি কখনো মালিক, কখনো সাংবাদিক, কখনো পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি, কখনো পরিবেশক, কখনো উৎসাহদাতা, কখনো সাহসের বাতিঘর, কখনো উদ্যোক্তা, প্রেরণা, আদর্শ ও অভিভাবক ছিলেন।

 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ রয়েছে;

“দৈনিক আজাদই ছিলো একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান রক্ষা আন্দোলনের সমর্থন করতো। এ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বাংলা ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিমকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম শহীদ সাহেবকে সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন।

আমাদেরও ওই একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ সহজে ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠ্তো। পরে সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন এবং আরো দু-একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করতেন। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা সংবাদ ছাপাতো। দৈনিক মনিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ওই পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনের পরোপুরি সমর্থন করতো, তবু ওটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণি বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইতো না। ওই পত্রিকা হাশিমকে সমর্থন করতো, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিতো।

আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে। বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারা প্রচার করার জন্য।

হাশিমের পক্ষে কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা-পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালাতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন। ভালো ব্যারিস্টার হিসেবে কলকাতায় নাম ছিলো। কলকাতায় গরীবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালোবাসতেন, মুসলমান ধনিকশ্রেণিকেও শহীদ সাহেব যা বলতেন, শুনতেন। টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনোদিন অসুবিধা হতে দেখিনি।

হাশিম শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এই দুজনই শহীদ সাহবকে রাজি করাতে পারবো, এই ধারণা অনেকেরই ছি্লো। আমরা দু’জনই একদিন সময় ঠিক করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি; বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে অনেক ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবেন। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে।

আরো দু-একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় খালি ঘর ছিলো। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম নিজেই সম্পাদক হবেন এবং কাগজ বের করা হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসই কাগজের লেখা ছাপার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবেও তার যথেষ্ট নাম ছিলো। ব্যবহারও ছিলো অমায়িক। পুরো বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করলো। বুদ্ধিজীবী সমাজে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগলো। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।“

 

বঙ্গবন্ধু তার বইয়ে উল্লেখ করেন, “মানিক ভাই তখন কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজের সেক্রেটারি ছিলেন। আমাদের টাকা-পয়সার খুবই প্রয়োজন, কে দেবে? বাড়ি থেকে লেখাপড়ার খরচা কোনোমতে আনতে পারি, কিন্তু রাজনীতি করার টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? আমার একটু সচ্ছল অবস্থা ছিল, কারণ আমি ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলাম। মাসে প্রায় ৩০০ টাকা পেতাম। আমার কাজ ছিলো এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা, আর ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা যায়, সেটা দেখতে হতো।“

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার ২৩ বছরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, নতুন দিন, স্বদেশ ইত্যাদি পত্রিকা বা গণমাধ্যমে কাজ করেছেন; যা জাতির জনকের বর্ণালী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ অধ্যায়টি বাঙালির ইতিহাসের জন্যও বিশেষ অধ্যায়। এ অধ্যায় গণমাধ্যমের ইতিহাসের জন্য গৌরবময় ও মর্যাদার।

 

গত ০২ নভেম্বর ২০২৩ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা প্রেসক্লাবে দেয়া তার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিতা জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন।


(সূত্রঃ ইন্টারনেট)

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url