বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-২৪)-বাংলাদেশ
জাহানারা
ইমাম
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম |
জাহানারা
ইমাম (৩ মে ১৯২৯-২৬ জুন ১৯৯৪):
ছিলেন একজন বাংলাদেশী লেখিকা,
কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। তিনি
বাংলাদেশে শহীদ জননী হিসেবে
পরিচিত। তার বিখ্যাত গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি। একাত্তরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাফী ইমাম
রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা
অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তীতে নির্যাতনের ফলে মৃত্যুবরণ করেন।
বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি শহীদ জননীর মযার্দায় ভূষিত হন।
প্রাথমিক জীবন
জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বড়ঞা থানার অন্তর্ভুক্ত সুন্দরপুর গ্রামে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জাহানারা ইমামের পিতা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
মাতা সৈয়দা হামিদা বেগম।
শিক্ষা
জাহানারা ইমাম ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। বিখ্যাত স্থপতি শরিফুল আলম ইমাম তার স্বামী।
দেশবিভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে
আসেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯৬১ সালে এমএ পড়া অবস্থায় তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ৬ মাস আমেরিকায় কাটান। ১৯৬৪ সালে
তিনিযুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশ ডিগ্রী অর্জন করেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষক হিসাবে জাহানারা ইমামের কর্মময় জীবনের প্রথম কাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে তিনি
১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত
ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার
সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন
স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত। এরপর তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত
সেখানে কর্মরত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও
খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।
রজনৈতিক জীবন
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শাফি ইমাম রুমী শহীদ হন। এছাড়া যুদ্ধের সময় তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শরীফ ইমামও মৃত্যুবরণ করেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠা
১৯৯১
সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর
ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ সালের
১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহবায়ক করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ
মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং
সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয়
কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ-আদালত-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক
গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালাতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের
চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা
করেন।
গণআদালতের
ঐতাহাসিক রায়
জাহানারা
ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। এই গণআদালতের
সদস্য ছিলেন এডভোকেট গাজিউল হক, ডঃ আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম,
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লেঃ
কর্ণেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান,
লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার শওকত আলী খান।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা
ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে।
পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর লাখো জনতার
পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১২ এপ্রিল ১৯৯২ সালে গণআদালতের রায় কার্যকর করার
দাবি সংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করেন। ১০০
জন সাংসদ গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন।
জাহানারা
ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপি গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ,
মানববন্ধন, সংসদ অভিমুখে যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি
পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সরকার ৩০ জুন ১৯৯২ সালে সংসদে ৪ দফা
চুক্তি করে। ২৮ মার্চ ১৯৯৩ সালে নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়।
পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করা হয়।
দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় নির্মূল কমিটি এবং শুরু হয় ব্যাপক
আন্দোলন। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক
পরিচিতি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।
২৬
মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে
গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন,
আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মোঃ কামরুজ্জামা্ন, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লা।
২৬
মার্চ ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের ২য় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের
চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাজপথের
বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর
করেন। গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা হচ্ছেন; শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য,
খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, শফিক
আহমেদ, আবদুল খালেক এবং সদরুদ্দিন। এই সমাবেশে আরও আটজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে
তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়।
মৃত্যু
আশির দশকের শুরুতে, ১৯৮২ সালে তার মুখের ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রতি
বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাকে। জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের
২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েট
নগরীর সাইনাই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৫ বছর।
এরপূর্বে অসুস্থার জন্য ২ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে
নেয়া হয়। ৪ জুলাই ১৯৯৪ তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শাহজালাল আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে তার মৃতদেহ গ্রহণ
করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয়। দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে
তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময়
মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক
দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬
জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে।
রচনাবলী
লেখলেখির জীবনে তিনি বিশটির অধিক বই রচনা করেন। তার নিজের জীবনের স্মৃতি
সম্বলিত “একাত্তরের দিনগুলি (১৯৮৬)”
জণগনের মধ্যে আলোড়ণ সৃষ্টি করে।