বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-২১)-বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধুর
নেতৃত্বে সংসদে নারী সদস্য
বেগম নূরজাহান মুর্শিদ
বেগম নুরজাহান মুরশিদ |
বেগম
নূরজাহান মুর্শিদঃ (২২ মে ১৯২৪ - ১ সেপ্টেম্বর ২০০৩) ছিলেন একজন
সাংবাদিক এবং শিক্ষক, পাশাপাশি একজন রাজনীতিবিদ। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরে
১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন।
নুরজাহান মুর্শিদ ২২ মে ১৯২৪ সালে
বৃটিশ-ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার তারানগরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তার নাম ছিলো ‘নূরজাহান
বেগ'। তার পিতার নাম আয়ুব হুসেইন বেগ ও মাতা বিবি খতিমুন্নেসা। তার পিতা ছিলেন
ব্রিটিশ পুলিশ সার্ভিসের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার পুলিশ প্রধান।
পিতা-মাতার ৭ কন্যার মধ্যে ৪র্থ কন্যা নূরজাহান পিতার কাছে
প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। নুরজাহান 'ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, কলকাতা' থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে তার মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
তিনি 'কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
নুরজাহান মুরশিদ ১৯৪৮ সালে খান সারোওয়ার মুর্শিদকে বিয়ে করেন। তাদের ৪ সন্তান ছিলোঃ অর্থনীতিবিদ খান আহমেদ সায়ীদ মুর্শিদ, ইতিহাসবিদ তাজীন মুর্শিদ, শামীম মুর্শিদ এবং কুমার মুর্শিদ।
নূরজাহান মুরশিদ 'অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে' ঘোষিকা হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা প্রথম মুসলিম মহিলা। পূর্ব পাকিস্তান গঠন হওয়ার
পর পাকিস্তান রেডিও-তেও তার এই পেশা অব্যাহত থাকে। তবে ধীরে ধীরে তিনি ঘোষক থেকে
প্রোগ্রাম প্রযোজক পদে অধিষ্ঠিত হন। এর সুবাদে তিনি শামসুল হুদা, লায়লা
আর্জুমান্দ বানু, লায়লা সামাদ এবং কামাল লোহানীদের মত ব্যক্তিত্ত্বের সংস্পর্শে
আসার সুযোগ পান।
পরবর্তীতে তিনি বরিশালের 'সাইদুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে'র
অধ্যক্ষ হন এবং তৎপরবরর্তীকালে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন,
যারমধ্যে 'কামরুন্নেসা বিদ্যালয়', 'ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল' এবং 'হলিক্রস কলেজ' উল্লেখযোগ্য।
বেগম নুরজাহান মুরশিদ 'বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’র প্রথম
সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক
ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘আজিমপুর লেডিস ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং 'অগ্রণী বালিকা
বিদ্যালয়'-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এর পাশাপাশি
তিনি 'বারডেম'-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য,
উন্মেষকালে 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র'-এর একজন
পৃষ্ঠপোষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্ত্রীদের জন্য ক্লাব 'শ্রেয়সী'-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
নূরজাহান মুর্শিদ ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট
হন। যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ১৯৫৪-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে পূর্ব বাংলার
আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আইন পরিষদ সচিব (পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি)
হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের
মনোনয়নে সরাসরি অংশ নিয়ে ২ জন নারী সদস্য জয়লাভ করেন, নুরজাহান ছিলেন তার একজন।
নুরজাহান মুরশিদ মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয়
বিধানসভার উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত
সরকারের প্রতি আহবান জানান। এর ফলে তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানের সামরিক
জান্তা তাকে নিরুদ্দেশ অবস্থাতেই ১৪ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সরকারের 'স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর' দায়িত্ব পান। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয়
সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং বাংলাদেশের চার জাতীয় নেতাঃ তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করার
পর তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন।
বেগম নুরজাহান মুরশিদ ১৯৮৫ সালে “একাল” নামে একটি বাংলা সাময়িকী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেটির সম্পাদক হন। পরবর্তীতে “এদেশ একাল” নামে প্রকাশিত এই সাময়িকীতে শুধুমাত্র নারীদের সমস্যার কথাই থাকতো না, সে সময়কার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়, যেমন; সহিংসতা, দুর্নীতি, গণতন্ত্রের অভাব ইত্যাদি বিষয়েরও উল্লেখ পাওয়া যেতো।
সাময়িকীটিতে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে একটি ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টির এ কে ফজলুল হক-এর এককালের একান্ত সহকারী 'নিরাদ চৌধুরী', 'চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান' (তিনি ওই সাময়িকটির প্রচ্ছদ চিত্রকরও ছিলেন) এবং কবি শামসুর রাহমান -এর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা।
১৯৯১ সালে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাময়িকিটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
মৃত্যুঃ ২০০২ সালে নুরজাহান মুরশিদের দেহে ক্যানসার ধরা পড়ে। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।