নবীজির জীবদ্দশায় ভারতে নির্মিত হয় যে মসজিদ
ভারতের কেরালা রাজ্যে
অবস্থিত “চেরামন জুমা মসজিদ” ভারতবর্ষের
প্রথম মসজিদ যা মহানবী (সা:) জীবিত থাকাকালেই নির্মিত হয়।
চেরামন জুমা মসজিদ, কেরালা, ভারত
চেরামন জুম্মা মসজিদ ভারতের কেরালা রাজ্যের
ত্রিশুর জেলার কাডুঙ্গাল্লুর
মেথেলায় অবস্থিত। ৬২৯ খৃষ্টাব্দে মালিক
ইবনে দিনার মসজিদটি নির্মাণ করেন। চেরামন মসজিদকে ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ বলা হয়। আনুমানিক ১২শ
শতকে মসজিদটি সংষ্কার ও বর্ধন করা হয়। মসজিদটি এখনো চালু আছে।
২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব
সফরকালে বাদশাহ সালমানকে মসজিদটির একটি রেপ্লিকা উপহার দেন।
চেরামন মসজিদটি আধুনিক কেরালার
চেরা রাজা চেরামন পেরুমলের উত্তরসুরির নির্দেশে নির্মিত হয়েছিলো। মসজিদটি কেরালা
শৈলীতে ঝুলন্ত বাতি দিয়ে তৈরি হয়েছিলো, যা এর নির্মাণ সময়কালের ঐতিহাসিকতাকে আরো
বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
১৫০৪ সালে লোপো সোয়াব্রেস ডি
আলবার্গিয়া কাদুঙ্গারু বন্দর আক্রমণ করলে পর্তুগিজরা মসজিদটি ধংস করে দেয়। পুরনো
ভবনটি ১৬ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৭ শতকের প্রথম দিকে পূনঃনির্মাণ করা হয়। আধুনিক
করিডোর এবং হলগুলি নির্মাণ করা হয় ১৯৮৪ সালে। এ বছর মসজিদ ভবনের চারপাশে পরিবর্ধণ,
পরিমার্জনের ফলে পুরনো ভবনের প্রায় সমস্ত বাহ্যিক বৈশিষ্টগুলি আড়াল হয়ে যায়।
কিছু কিংবদন্তি অনুসারে চেরামন
পেরুমল (“চেরামন পেরুমল”- চেরা রাজাদের খেতাব) চাঁদের বিভক্তির স্বাক্ষী ছিলেন –
অর্থাৎ তিনি নাকি সেটা দেখেছিলেন। অবিশ্বাসী মক্কাবাসীদের দাবির কাছে নবীজী (সাঃ)
কর্তৃক সম্পাদিত এটি একটি অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনা ছিলো, যা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ
আছে (৫৪:১-২)।
কথিত আছে, এরপর চেরামন রাজা
নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার জ্যোতিষীদের শরনাপন্ন হন। জ্যোতিষীরাও বিষয়টি নিশ্চিত
করেন। অতঃপর রাজা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থকেন।
পরবর্তীতে কিছু আরব বণিক বাণিজ্যের
উদ্দেশ্যে মালাবার বন্দরে আসেন। শেখ সাহিরুদ্দিন বিন বাকিউদ্দিন আল মাদানির নেতৃত্বে তাদের একটি দল চেরামন রাজার
কাছে সিলন (শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণের অনুমতি চাইতে রাজধানীতে আসেন। তাদের সাথে কথোপকথনে
রাজা নবী মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে জানতে পারেন। অতঃপর রাজা তার ছেলের কাছে রাজ্য
শাসনের ভার দিয়ে বণিকদের সাথে নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে দেখা করার জন্য আরব চলে
যান।
রাজা চেরামন পেরুমল নবী মোহাম্মদ (সাঃ) ও তার সঙ্গীদের জন্য আদার আচার উপহার
নিয়ে যান এবং নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইতিহাসবিদ এম,জি,এস নারায়ণন-এর মতে “এই প্রথাকে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই
যে, শেষ চেরা রাজা মক্কায় গিয়েছিলন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, এটি কেবল
মুসলিম ইতিহাসেই নয়, কেরোলপট্টির মতো হিন্দু ব্রহ্মণ্য ইতিহাসেও এর প্রমাণ পাওয়া
যায়।“।
স্কলার মেহেরদাদ শোকেহীর মতে “এমন একটি গল্পগাঁথা আশাব্যঞ্জক নয়, যা
কোনোভাবেই বাহ্মণ্য বা হিন্দু জনগণের সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়ায় না”।
‘তবে এই লেখকের কথা হলো, ভারতীয় উপমহাদেশে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা
আগে হিন্দু অথবা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী ছিলো। ইসলাম ধর্ম আসার আগে সব মুসলমানই অন্য
কোনো ধর্মের অনুসারী ছিলো। এটা সম্মান ও প্রতিপত্তি কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়ার
কোনো বিষয় নয়’।
মসজিদটির অবস্থান
মসজিদটি ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিশুর জেলার কাডুঙ্গাল্লুর তালুকের পারাভুর-কাডুঙ্গাল্লুর
রোড, এনএইচ-৬৬-এ অবস্থিত।
পুরোহিত নিয়োগ
মন্দির ট্রাষ্টের সভাপতি চেন্নিকাত্তিল সুন্দরনের মতে ঐতিহ্যগতভাবে স্থানীয়
থিয়া পরিবার থেকে পাজয়াখথ ইলমের ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য দ্বারা মালাপ্পুরমের
তানুরের শোভাপরম্বা ভগবতী মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত হন। মসজিদটি নির্মাণের পর
বছরের পর বছর ধরে পরিবারটি ভেঙ্গে যায় এবং এর অবশিষ্ট সদস্যরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করে।
মন্দিরের হিন্দু পুরোহিতকে প্রতি ১২ বছরে একবার একটি বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার
মাধ্যমে নিযুক্ত করা হয়। পাজায়াখথ পরিবারের একজন মুসলিম সদস্যের সভাপতিত্বে
পুরোহিত নিযুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়, যা স্থানীয় চেরামন পেরুমলের সাথে
বন্ধুত্বপূর্ণ সহবস্থানের পরিচয় দেয়।
ত্রাভাঙ্কোরের মহারাজারা
“মক্কাতুপোয়া পেরুমল” বা যে রাজা মক্কা গিয়েছিলেন, তার কিংবদন্তি কেরালার
স্মৃতিতে বেঁচে আছে। ভারতের স্বাধীনতালাভের পূর্বে ত্রাভাঙ্কোরের মহারাজারা শপথ
গ্রহণের সময় স্পষ্টতই এই বলে শপথ নিতেন যে, “আমি মক্কায় যাওয়া চাচারা (Uncle) ফিরে
না আসা পর্যন্ত এই তরবারি রাখবো”।
মসজিদটি পরিদর্শনকারী বিখ্যাত
ব্যক্তিগনঃ
(১) এ, পি, জে, আব্দুল কালাম – ভারতের ১১তম রাষত্রপতি
(২) শশী থারুর, তিরুবনন্তপুরম – কেরালার সংসদ সদস্য
শেষ কথাঃ
কেরালার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক
ইতিহাসের অংশ এ মসজিদ। একইসাথে ধারণ করছে প্রাচীন ভারতে বহু সংস্কৃতি ও ধর্মের
মিলনমেলা।
এই মসজিদ যখন তৈরি হয় তখনও
জীবিত ছিলেন ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। সে সময়েই সুদূর কেরালায় এটি
কীভাবে নির্মিত হলো?- সে প্রশ্নের উদয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে দেখা
যায়, প্রাচীন বন্দর মুজিরিসের কাছেই কাডুঙ্গাল্লুর শহর। এ বন্দর ছিলো তৎকালে
বিশ্ববাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। স্থানীয় চেরা রাজ্যের ব্যবসায়ীরা এখানে
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বণিকদের সাথে হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকে গোলমরিচ, আদা,
দামি কাঠ ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। এজন্য মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মমিতে পাওয়া
গেছে ভারতের কালো গোলমরিচ। দামি ও মজবুত ভারতীয় কাঠ এ বন্দর দিয়েই পৌঁছে যেতো
প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায়। সেখানে সম্রাট নেবুচাদনেজারের প্রাসাদ এবং উর নগরীর
বিখ্যাত সুমেরীয় জিগারুট মন্দিরের স্থাপত্যে পাওয়া গেছে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা কাঠের
ব্যবহার।
ষষ্ঠ শতকে আরবরা ছিলো সুদক্ষ
সমুদ্র অভিযাত্রী ও বণিক। তারা অনেক বাণিজ্যপথ আবিষ্কার করেছিলেন। কেরালার চেরা
রাজ্যের রাজাদের সাথেও তারা ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই বণিকদের
মাধ্যমেই মক্কা নগরীর অধিবাসী নবী মোহাম্মদ (সা:) এবং ইসলামের কথা পুরো মালাবার
অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।