বিএনপি তথা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের ভোট কারচুপি্র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস!

 

প্রথম ঘটনা:

সাল ১৯৭৭। জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণের প্রক্রিয়া বৈধ ছিলো না। সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল থেকে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন জিয়া। তার আগে নেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ। আমরা যেটা দেখেছি, পঁচাত্তরে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি থাকতেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তিন বাহিনীর প্রধান থাকতেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু জিয়া অতি ধুর্ততার সাথে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি করতলগত করেন। পরে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন।

 

ওই সময় ক্ষমতা‍য় আরোহণের মূল মাধ্যম ছিলো বেতার কেন্দ্র। টেলিভিশন দেশব্যাপী প্রসার লাভ করে নাই। কারণ জেলা শহর ছাড়া খুব কম শহরেই বিদ্যুৎ ছিলো। মূল প্রচারযন্ত্র ছিলো রেডিও। অতএব, বেতার কেন্দ্র দখলে যার, ক্ষমতা তার। একটা ঘোষণা দিয়ে দিলেই হতো, “আজ থেকে আমি দেশের দন্ডমূন্ডের হর্তাকর্তা!”

 

যাইহোক, ক্ষমতায় বসে জিয়া আজ এটা, কাল সেটা ফরমান জারির মাধ্যমে দেশ চালাতে লাগলেন। কিন্তু মনে ভয়, একদিন হয়তো এর প্রতিফল ভোগ করতে হবে! কিভাবে এ থেকে পরিত্রাণের পথ পাওয়া যায় সে ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন গণভোট ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করার।

 

একটি ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুটি ছক বা ঘর থাকবে। কিন্তু ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’এর জন্য বাক্স থাকবে আলাদা আলাদা। সম্ভবত ভেবেছিলেন, কোন বাক্সে কতোটা ভোট পড়ে তা আগে থেকেই যাতে আন্দাজ করা যায় এবং সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেয়া যায়।

 

জেনারেল জিয়ার গণভোটের পোষ্টার ও ব্যালট পেপার

জেনারেল জিয়ার গণভোটের পোষ্টার ও ব্যালট পেপার

জিয়ার হ্যাঁ-না ভোট কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। যে কোনো কারণেই হোক, গণভোটের দুদিন আগে থেকেই মানিকগঞ্জ শহরের একটি ভোটকেন্দ্রের একদম কাছে অবস্থান করছিলাম। আগের দুইদিন শহরের রাস্তায় যেমন লোক সমাগম এবং রিকশা চলাচল দেখলাম, ভোটের দিন রাস্তা জনমানবশূন্য। রাস্তায় একটা্ রিকশাও নাই। ভোটকেন্দ্রে ভোটার নাই, ভোটবাক্স ফাঁকা। পরে জানা গেলো উপর থেকে নির্দেশ গিয়েছে হ্যা বাক্স ব্যালট পেপার দিয়ে ভর্তি করতে। কিন্তু উপরওয়ালারা জানতো না যে, ভোটের বাক্স একেবারেই শূণ্য! হ্যাঁ বাক্স ভর্তি করার পর গণনার সময় দেখা গেলো,  শতকরা ৯৯ ভাগ ভোট ‘হ্যাঁ’ বাক্সে পড়েছে। গুজব ছিলো, কোনো কো্নো কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নাকি একশো ভাগ্ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো!




দ্বিতীয় ঘটনা:

দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয় ১৯৮৮ সালে। জিয়ার মতো এরশাদও ছিলেন অবৈধভাবে দখলকৃত ক্ষমতার অধিকারী।

 

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে নিহত হন। তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ।

 

জিয়া নিহত হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতা দখলের সুযোগ খুজছিলেন এরশাদ। এ জন্য দরকার ছি্লো একটা উপলক্ষের। সেই উপলক্ষ তৈরি হয় ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসা থেকে আটক করা হয় কুখ্যাত সন্ত্রাসী যুব্দল নেতা ইমদাদুল হক ইমদুকে। তখন নতুন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। ঘটনার তিন দিন পর, ১১ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে পুরো মন্ত্রিসভা বাতিল করেন রাষ্ট্রপতি সাত্তার। তার দেড় মাসের মধ্যে ‘দেশে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে’ সেই অজুহাতে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল এরশাদ।

 

তখন ক্ষমতায় বিএনপি সরকার। কালীগঞ্জের ইমদু যুবদল করতেন। ইমদু ছিলেন খুনের আসামী। খুনের আসামী হও্য়া সত্বেও তিনি মন্ত্রীর বাড়িতে আশ্রয় লাভ করেন। মন্ত্রীর বাড়ি থেকে আটক হন ইমদু। মিন্টো রোডের মন্ত্রীর বাসা থেকে ইমদুকে আটক করা হয়েছিলো বিশাল আয়োজন করে। রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছি্লো। সেই পরিস্থিতিই এরশাদের সামরিক শাসন জারি করার অজুহাত তৈরি হয়।

 

ক্ষমতা গ্রহণ করে এরশাদ প্রায়ই বলতেন, “আমার ক্ষমতার লোভ নাই। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমরা ব্যারাকে ফিরে যাবো”! গিয়েছেও তাই! পরের ঘটনা পড়লেই জানতে পারবেন কিভাবে দিয়েছিলো।

 

এরশাদের সময়ে ১৯৮৬ সালে একটি সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামীলীগ বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে কৌশলগত কারণে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে যায়। এরশাদের  নবগঠিত দল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে বিজয়ী হয়।

 

জাতীয় পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সংবিধান সংশোধনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না। কিন্তু তার সময়ে জারিকৃত অধ্যাদেশ গুলো আইনী মোড়ক দিতে সংসদে পাস করানোর প্রয়োজন হয়। এদিকে আওয়ামীলীগ বিরোধী দলের আসনে থাকলেও এরশাদের অবৈধ কর্মকান্ডের সমালোচনা করে যাছি্লো। এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামীলীগ। বিএনপিও যুগপৎ আন্দোলনে নামে।

 

অবস্থা বেগতিক দেখে ১৯৮৮ সালে হঠাৎ সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তবর্তী নির্বাচন দেয় এরশাদ। উদ্দেশ্য আন্দোলনের দাবি মেনে নেয়া নয়। উদ্দেশ্য অবৈধভাবে ক্ষমতায় আরোহণের দোষত্রুটিগুলি বৈধতার আবরণ পরাতে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন।

 

যে কথা সেই কাজ। কিন্তু এবার আওয়ামীলীগ বিএনপি সবাই নির্বাচন বর্জন করলো। জাসদ(শাহজাহান), বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টি সহ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পাতানো নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের ব্যানারে কয়েকটি এক নেতা সর্বস্ব দলও অংশ নেয়। কারণ স্বাভাবিক নির্বাচনে তারা জীবনেও সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলো না, তাই সেবার সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগটা তারা হাতছাড়া করেনি। অতপর আসন ভাগাভাগির নির্বাচনী খেলায় সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯ টি, স্বতন্ত্র ২৫ টি, জাসদ(শাহজাহান) দুইটি, ফ্রিডম পার্টি দুইটি আসন পায়। এরশাদের নতুন দল জাতীয় পার্টি নিজেদের ভাগে ২৮১ টি আসন নেয়, যাতে সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে সহজ হয়।

 

সরকারি চাকরির সুবাদে অন্যত্র বসবাস করলেও ১৯৮৮-এর নির্বাচনের দিন ঘটনাক্রমে ছুটিতে নিজ এলাকা রাজবাড়ীতে ছিলাম। যেহেতু পাতানো নির্বাচন এবং পছন্দের রাজনৈতিক দল নির্বাচনে নাই, তাই ভোট দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও নাই। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার বাসনা জাগলো মনে।

 

প্রথমে গেলাম রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ভোটারের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো বসে আছে পোলিং এজেন্ট, প্রিজাইডিং অফিসাররা। কেউ আসে না ভোট দিতে। দিনশেষে সে আসনে এরশাদের মনোনীত প্রার্থী আক্কাছ আলী মিয়াকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিলো।


এরপর গেলাম নিজ গ্রামে। রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলায় নিজ গ্রামের বাড়ি্র পাশেই প্রাইমারি স্কুলে ভোটকেন্দ্র। এই কেন্দ্রেই ১৯৭০ সালে জীবনের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ আসে এবং যথারীতি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার স্বপক্ষে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রদান করি। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছিলাম। তারপর আর এ কেন্দ্রে ভোট দেয়া হয়নি।

 

ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি রাজবাড়ীর মতো একই অবস্থা। কেন্দ্রের ভেতরে সবাই ইতিউতি করছে। দেখলাম এক নব দম্পতি এসেছে ভোট দিতে। উৎসুক্য নিবারণের জন্য কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেউ ভোট দিতে আসেনি, তোমরা এতো সেজেগুজে ভোট দিতে এসেছো কেনো’? বললো, ‘আমরা প্রথম ভোটার হয়েছি এবং আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে, তাই সখ করে ভোট দিতে এসেছি’।


অতঃপর কেন্দ্রের ভিতরে ঢুকলাম। প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ব্যালট পেপারের প্যাড নিচ্ছে আর সিল মেরে লাঙ্গলের বাক্সে ভরছে। প্যাড শেষ হয়ে গেলে আবার নিচ্ছে। জাসদের এজেন্ট বলছে, আমার মার্কায়ও দুয়েকটা সিল দিও। নইলে ব্যালেন্স হবে না। এক পর্যায়ে আমাকে দেখে প্রিজাইডিং অফিসার ইতস্ততঃ করছিলো। পরিচিতরা সেটা স্বাভাবিক করে দেয়।

উল্লেখ্য, জিয়ার মতো এরশাদও তার ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য ১৯৮৫ সালে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন এবং রাজকোষের টাকার শ্রাদ্ধ করেছিলেন।

 

এবার আসি তৃতীয় ঘটনা নিয়ে:

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ছিলো দেশের ইতিহাসে ঘৃণিত, অগ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন। ১৯৯১ এর নির্বাচনও বিতর্কের উর্ধে ছিলো না। বিএনপি সরকারের সময়ে মাগুরা উপ নির্বাচনও তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। ফলে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ দল আওয়ামীলীগ সহ সকল রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখে মাত্র ১২ দিনের মাথায় বিএনপি সরকার সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পদদ্যাগে বাধ্য হয়।

 

১৯৯৬ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পটভূমিঃ

অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিলো। মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল মাত্র ২১%। রাজনৈতিক মহলে নির্বাচনটি “১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন” নামে পরিচিত।

 

৩০০ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি আসন পায়। ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত থাকে এবং ১টি আসনের নির্বাচন আদালতের রায়ে স্থগিত করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ২৭৮ টি আসনই বিএনপির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লাভ করে। সম্ভবতঃ তারেক রহমানও এই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ১২ দিনের জন্য এমপি ছিলো।

 

মাত্র ১টি আসন পেয়েও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ছিলো বঙ্গবন্ধুর খুনী খন্দকার আবদুর রশিদ নির্বাচিত সরকারের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিলো ১৯ মার্চ। অধিবেশন স্থায়ী ছিলো মাত্র ৪ কার্যদিবস, ২৫ মার্চ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র ১২ দিন।


এছড়া বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-২০০৬) গুলশান-১০ আসনের উপ নির্বাচনে ফালুকে জিতিয়ে আনার জন্য আছে কারচুপির নগ্ন ইতিহাস।

 

এছাড়াও দুই সামরিক সরকারের য়ামলই ছিলো রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির সরকার। কোনো আমলেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওই দুই সামরিক জান্তা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে দেয়া হয় নাই।

 

এই হলো বাংলাদেশে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলের নির্বাচনে কারচুপি তথা সাগর চুরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তারা আবার বড় বড় গলায় কথা বলে।

 

অবশ্য জাতীয় পার্টি বেশি গলা বাড়ায় না। কারণ তারা তাদের নেতার ইতিহাস জানে এবং ভেতরে একটু হলেও অপরাধবোধ কাজ করে। কারণ, জাতীয় পার্টিতে অনেক নীতিজ্ঞানসম্পন্ন নেতা আছে।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url