আদর্শ শিক্ষক বনাম আদর্শ ছাত্র
ছবি প্রতিকী |
ভারতের একটা
শহরের প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষিকা। তার অভ্যাস ছিলো, ক্লাস শুরু
হওয়ার আগে রোজ তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে "আই লাভ ইউ অল" বলতেন। কিন্তু
তিনি জানতেন, তিনি সত্য বলছেন না। তিনি জানতেন, ক্লাসের সবাইকে তিনি একরকমভাবে ভালবাসেন
না।
ক্লাসে রাজু
নামের একটা ছেলে ছিলো, যাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। রাজু ময়লা জামা-কাপড়
পরে স্কুলে আসতো। তার চুলগুলো থাকতো উস্কোখুস্কো, শার্টের কলারে ময়লা দাগ, খোলা
থাকে জুতার বকলেস। ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে থাকে খুব অন্যমনস্ক। মিস-এর বকুনি
খেয়ে চমকে তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকতো সে। কিন্তু তার শূন্য
দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেতো, শারীরিকভাবে সে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন অন্য
কোনোখানে উধাও হয়ে যেতো। রাজুর প্রতি ধীরে ধীরে মিস-এর মনে ঘৃণার উদ্রেক হতে লাগলো।
রাজু ক্লাসে
ঢুকতেই মিস-এর সমালোচনার শিকার হতো। সব রকম খারাপ কাজের উদাহরণ দিতে মিস রাজুর নাম
উল্লেখ করতে লাগলেন। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীরা তা্র দিকে তাকায় আর খিলখিল করে
হাসে। মিসও তাকে অপমান করে আনন্দ পান। রাজু এসব কথার কোনো উত্তর দিতো না। মিস-এর কাছে
তাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হতো। মনে হতো তার মধ্যে অনুভূতি বলে কিছু ছিলো না।
সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য-দৃষ্টিতে মিস-এর
দিকে তাকাতো আর মাথা নীচু করে নিতো। এভাবে রাজু মিস-এর অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে
উঠলো।
প্রথম
সেমিস্টার শেষ হয়ে রিপোর্ট বেরোনোর সময় হলে মিস রেজাল্ট কার্ডে তার সম্পর্কে সব
খারাপ কথা লিখে দিলেন। মা-বাবাকে দেখানোর আগে রিপোর্ট কার্ড হেড মিস্ট্রেসের কাছে
পাঠাতে হতো। হেড মিস্ট্রেস রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘মিস
রিপোর্ট কার্ডে কিছু তো অনুপ্রেরণার কথা লেখা উচিৎ। আপনি যা লিখেছেন তা দেখে তো
রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন’। মিস বললেন, “আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু একটা
খারাপ এবং নিষ্কর্মা ছেলে। আমার মনে হয়না আমি ওর সম্পর্কে ভালো কিছু লিখতে
পারবো”। মিস রাজুর প্রতি ঘৃণ মেশানো কথাগুলো বলে হেড মিস্ট্রেস-এর কাছ থেকে উঠে
এলেন।
হেড মিস্ট্রেস
অদ্ভুত একটা ব্যাপার করলেন, তিনি স্কুলের পিওনকে দিয়ে মিস-এর ডেস্কের ওপরে রাজুর
আগের বছরের রিপোর্ট কার্ড রেখে দিলেন। পরেরদিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন
রিপোর্টের ওপরে নজর পড়তে উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই রিপোর্ট কার্ড। ভাবলেন আগের বছরও
নিশ্চয়ই সে এরকম আচরণ করেছে। ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খোলেন।
রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে মিস-এর আশ্চার্য হলেন। রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট
কার্ডটি ভরা। তাতে লেখা আছে, “রাজুর মতো বুদ্ধিমান ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি।
অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী ও শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে।
অন্তিম সেমিস্টারেও রাজু প্রথম স্থান আধিকার করে নেয়”।
অস্থির ভাবে
মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে "রাজুর লেখাপড়ার ওপর তার
মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়েছে। পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠেছে। রাজুর মা
মারা গেছে এবং সঙ্গে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও। তাকে
বাঁচাতে হবে”।
আরো দেরী হয়ে
যাওয়ার আগে মিস-এর মাথায় যেনো অত্যন্ত ভারী বোঝা চেপে বসলো। কম্পিত হাতে তিনি
রিপোর্ট কার্ড বন্ধ করেন। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। টপ টপ করে চোখের জল ঝরতে
লাগলো।
পরের দিন যখন
ক্লাসে ঢুকলেন তার নিজের চির অভ্যস্ত বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন, "আই লাভ ইউ
অল”। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, আজও তিনি সত্যের অপলাপ করছেন। কারণ এলোমেলো চুলে এই
ক্লাসে বসে থাকা ছেলে রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছিলেন, তা ক্লাসের
অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভবই ছিলো না।
পড়া বোঝানোর
সময় তিনি প্রতিদিনের অভ্যাসমতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। রাজুও প্রতিদিনের
মতো মাথা নিচু করে রইলো। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ যখন মিস-এর ধমক বা শ্লেষাত্মক কথা
কোনোটাই শুনতে পেলো না, সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দও কানে এলো না, তখন সে আচমকা
মাথা উঁচু করে মিস-এর দিকে চেয়ে রইলো। অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথা আজ মুন্ডিত,
কেশহীন ছিলো।
মিস-এর মুখে
মৃদু হাসি। তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তা আওড়াতে বললেন।
রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো। তার জবাব দেয়ার সাথে সাথে মিস খুশি
হয়ে নিজেও তালি দিলেন, অন্য শিক্ষার্থীদেরকেও তালি দিতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর
থেকে এটা প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হলো। মিস সব উত্তর নিজে বলে দিতেন, তারপর
সস্নেহে রাজুকে বাহবা দিতেন। সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম বলতে লাগলেন।
ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার
কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে এলো। এখন আর মিসকে প্রশ্ন করে আর নিজেই উত্তর বলে দেয়ার
প্রয়োজন হয় না। সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতো এবং নতুন নতুন প্রশ্ন
করেও হয়রানী করতো। তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকে। জামাকাপড়ও যথেষ্ট
পরিষ্কার থাকে। হয়তো সে নিজেই তার কাপড়-চোপড় ধুতে শুরু করেছিলো। দেখতে দেখতে বছর
শেষ হয়ে গেল। রাজু পঞ্চম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রাথমিক স্কুলের
শিক্ষার সমাপ্তি টানলো।
প্রাথমিক স্কুল
থেকে বিদায়কালীন সমারোহে সব ছেলেরা মিস-এর জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে এলো। মিস-এর
টেবিলের ওপর একের পর এক উপহারের পাহাড় জমে গেলো। সুন্দর সুন্দ্র প্যাকেট করা
উপহারের মধ্যে পুরনো কাগজে অগোছালো ভাবে মোড়ানো একটা উপহারের প্যাকেট পড়ে ছিলো। অন্যরা
সেটা দেখে হাসতে লাগলো। কারো জানতে বা বুঝতে বাকি রইলো না, সেটা রাজুই এনেছে।
মিস উপহারের এই
ছোট পাহাড় থেকে সেটা বের করে আনলেন। খুলে দেখলেন, তার ভেতরে মহিলাদের আতরের অর্ধেক
ব্যবহার করা একটা শিশি আর এক হাতে পরার মতো বড় একটা বালা, যার বেশিরভাগ মতি ঝরে গেছে।
মিস চুপচাপ শিশি থেকে নিজের গায়ে আতর ছিটিয়ে নিলেন এবং বালাটা হাতে পরে নিলেন।
বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। রাজু নিজেও। শেষ পর্যন্ত রাজু স্থির
থাকতে না পেরে মিস-এর কাছে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আবেগজড়িত কন্ঠে থমকে থমকে মিসকে বললো, "আজ
আপনার গা থেকে আমার মায়ের মতো গন্ধ আসছে”।
সময় পাখা মেলে
উড়তে লাগলো। দিনের পরে মাস, মাসের পরে বছর। প্রত্যেক বছরের শেষে নিয়মিত রাজুর কাছ
থেকে একটা চিঠি আসতো মিস-এর কাছে। তাতে লেখা থাকতো, "এই বছর অনেক নতুন
টিচারের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু আপনার মতো কেউ ছিলো না”।
তারপর রাজুর
স্কুল জীবন শেষ হয়ে গেলো। চিঠির ধরাবাহিকতাও শেষ হলো। কয়েক বছর পর মিস-ও চাকরি
থেকে অবসরে গেলেন। হঠাৎ একদিন তার নিজের ঠিকানায় রাজুর একটি চিঠি পেলেন। তাতে লেখা
ছিলো; "এই মাসের শেষে আমার বিয়ে, আপনাকে ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারি না।
আরেকটা কথা, জীবনে আমি অনেক লোকের সাথে মিশেছি, আপনার মতো কেউ নেই। -ডক্টর রাজু।
সাথে প্লেনে যাওয়া আসার টিকিটও খামের মধ্যে দিয়েছিলো রাজু।
মিস নিজেকে
কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলেন না। তিনি স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাজুর কাছে যাওয়ার
জন্য রওনা দিলেন। বিয়ের দিন বিয়ের আসরে যখন উপস্থিত হলেন, খানিকটা দেরী হয়ে
গিয়েছিলো। মিস-এর মনে হয়েছিলো, বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ের
প্যাণ্ডেলে পৌঁছে অবাক হলো মিস! শহরের বড় বড় ডাক্তার, ব্যবসায়ী, এমনকি বিয়ের
আনুষ্ঠানিকতা সারবেন যিনি সেই পণ্ডিতজীও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, এখ্নো কার আসা
বাকি আছে, যার জন্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে মনোযোগ নাই রাজুর! বিয়ের মণ্ডপের গেটের দিকে অপলকনেত্রে
তাকিয়ে আছে তার আসার অপেক্ষায়!
তারপর সবাই
দেখলো, রাজুর ছোটবেলার সেই শিক্ষিকা। গেটের ভেতরে ঢুকতেই রাজু তার দিকে দৌড়ে গিয়ে
তার হাত ধরেছে। যে হাতে তিনি এখনও রাজুর দেয়া সেই খারাপ হয়ে যাওয়া বালাটা পরে
ছিলেন। তাকে সসম্মানে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। মাইক হাতে নিয়ে সে সবার উদ্দেশ্যে বিশেষ্করে
তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললো, "বন্ধুরা, আপনারা সব সময় আমাকে আমার মায়ের
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। আমি আপনাদেরকে কথা দিয়েছিলাম যে, খুব শিগগিরই সবাইকে আমার
মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। ইনি আমার মা"।
(সংগৃহীত)