এক সময়ের জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাস্ত জংশন রেলষ্টেশন আজ অবহেলিত

 

কালুখালি জং

 

ছবিঃ আমার সংবাদ-এর সৌজন্যে

১ নভেম্বর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বানিজ্যিকভাবে চলাচল করবে ট্রেন। এরই মধ্যে যমুনা সেতু হয়ে চলাচল করা খুলনা ও বেনাপোল রুটের দুটি ট্রেন রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে চলা্র নির্দেশনা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

 

নির্দেশনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে চলাচলকারী সুন্দরবন এক্সপ্রেস (৭২৫/৭২৬) ও বেনাপোল-ঢাকা-বেনাপোল রুটে চলাচলকারী বেনাপোল এক্সপ্রেস (৭৯৫/৭৯৬) ট্রেন দুটি রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে।

 

১ নভেম্বর থেকে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি খুলনা থেকে ছাড়বে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে এবং ঢাকা পৌঁছবে ভোর ৫টা ১০ মিনিটে। অন্যদিকে ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছাড়বে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে এবং খুলনা পৌঁছবে বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে।

 

সুন্দরবন এক্সপ্রেস খুলনা থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথেঃ

দৌলতপুর – নওয়াপাড়া – যশোর – মোবারকগঞ্জ – কোটচাঁদপুর – চুয়াডাঙ্গা – আলমডাঙ্গা - পোড়াদহ জংশন - কুষ্টিয়া কোর্ট – রাজবাড়ী - ফরিদপুর এবং ভাঙ্গা জংশন স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।

ফিরতি পথে ভাঙ্গা জংশন – ফরিদপুর – রাজবাড়ী - কুষ্টিয়া কোর্ট - পোড়াদহ জংশন – আলমডাঙ্গা – চুয়াডাঙ্গা - দর্শনা হল্ট – কোটচাঁদপুর – মোবারকগঞ্জ – যশোর - নওয়াপাড়া এবং দৌলতপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।

 

অন্যদিকে আগামী ২ নভেম্বর থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস (৭৯৫) নতুন রুটে যাত্রা শুরু করবে। ওইদিন ট্রেনটি বেনাপোল থেকে ছাড়বে দুপুর ১টায় এবং ঢাকা পৌঁছবে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে। ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছাড়বে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে এবং বেনাপোল পৌঁছবে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে।

 

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি উভয় পথে ঝিকরগাছা – যশোর – মোবারকগঞ্জ – কোটচাঁদপুর - দর্শনা হল্ট – চুয়াডাঙ্গা - পোড়াদহ জংশন - কুষ্টিয়া কোর্ট – রাজবাড়ী - ফরিদপুর এবং ভাঙ্গা জংশন স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।

 

এক্ষণে সামান্য নিজস্ব অভিব্যাক্তির প্রকাশ

কোনো পূর্ব ইতিহাস না কপচিয়ে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারির ০৪ তারিখে তৎকালিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আমি তখন সবে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছি। সবে ক্লাস সিক্সে উঠলেও বয়স ১৩-১৪। আমাদের রাজবাড়িতে ফাতেমা জিন্নাহ এবং আওয়ামীলীগের জাঁদরেল নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের যাওয়ার কথা। ফাতেমা জিন্নাহ ওই নির্বাচনে প্রার্থী এবং আওয়ামীলীগ তথা পূর্ববাংলার জনগণ ফাতেমা জিন্নাহ’র সমর্থক। তো সিদ্ধান্ত নিলাম, ফাতেমা জিন্নাহ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে বাড়ির কাউকে না জানিয়েই রাজবাড়ী যাবো। পরে অবশ্য যে কোনো কারণে ফাতেমা জিন্নাহ, বঙ্গবন্ধু কেউ যাননি সেদিন।

 

শৈশবকাল, জ্ঞানবুদ্ধি ততোটা হয়নি। এই জাতীয় রাজনৈতিক বক্তব্যও খুব একটা শোনা হয়নি। বিভিন্ন বক্তার ভাষণ শুনতে শুনতে মোহবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। কখন ট্রেন ছাড়বে, কিভাবে বাড়ি যাবো সে চিন্তা নাই। অবশেষে জনসভা শেষে ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটায় নিজ ষ্টেশন “কালুখালি জংশন” ষ্টেশনে গিয়ে নামলাম।

 

ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা কাক-পক্ষীও সেদিকে যাচ্ছে না। একা যাওয়ারও সাহস হলো না। না খেয়ে ক্ষুদা পেটে শীতের রাতে ষ্টেশনে অনিল’দার চায়ের ষ্টলের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। অনিল’দার তখন ষ্টল বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার পালা। সবকিছু শুনে সে তার চারপাশে কাঠের টেবিল-কাম-সেলফ দিয়ে ঘেরা ষ্টলে রাত যাপনের অনুমতি দিলেন।

 

পরনে শুধু একটি হাফপ্যান্ট ও হাফশার্ট। শীতে কোঁকাচ্ছি। অনিল’দা তখনও যায়নি। আমার কোঁকানো দেখে সে বিচলিত হয়ে পড়লো। তার ষ্টলের পাশেই একলোক একা একটি সিঙ্গেল লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলো। তাকে অনুররোধ করে আমাকে একটু তার লেপের নিচে শোয়ার ব্যবস্থা করে অনিল’দা বাড়ি চলে গেলো। রাতে আমি লেপ টান দিলে সে আলগা হয়ে শীতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে টান দিলে আমি আলগা হয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গে যায়। এভাবে আর কতোক্ষণ! কিছুক্ষণ পর উঠে কিছু বসা লোকের জটলায় গিয়ে শরীক হলাম।

 

জংশন ষ্টেশন। প্রতিটা ট্রেন থামতো। ষ্টেশনে রাতযাপন করতো অসংখ্য লোক। রাতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকতো না। নানাদিক থেকে নানামুখি লোকজন এসে ষ্টেশনে রাত যাপন করতো। কেউ ভাটিয়াপাড়া ট্রেনে এসে রাত যাপন করে পরেরদিন ‘ঢাকা মেইল’ ধরে কলকাতা বা পশ্চিম বাংলার কোথায়ও যেতো কেউ দূর-দূরান্ত থেকে এসে সকালে ‘ঢাকা মেইল’ ধরে রাজবাড়ী, গোয়ালন্দ বা ঢাকা যেতো।

 

একই নামের দুটি ট্রেন দু’দিক থেকে ছেড়ে আসতো। কলকাতা-গোয়ালন্দ এবং গোয়ালন্দ-কলকাতা। একই টিকেটে গোয়ালন্দ থেকে রেল কোম্পানির ষ্টীমারে ঢাকা যাওয়া যেতো আবার ঢাকা থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে ষ্টিমারে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে কলকাতা বা বিভিন্ন জায়গা। যোগাযোগের জন্য ওই সময় ট্রেন, ষ্টীমার, লঞ্চ ছাড়া সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো না বললেই চলে। 

 

স্বাধীনতার পরে যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে সড়কপথে রাজবাড়ী যেতে হলে ৪ বার যানবাহন পাল্টাতে হতো। সদরঘাট থেকে মিরপুর(গাবতলী), মিরপুর থেকে নয়ারহাট, নয়ারহাট থেকে তরা, তরা থেকে আরিচাঘাট (তখন পাটুরিয়া ঘাট তৈরি হয়নি)।

 

সরাসরি গেলেও ৩টি ফেরি পার হতে হতো। সে ফেরিও ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে নয়ারহাট ও তরাঘাটের ফেরি। কাঠের দুটি বড় নৌকা জোড়া দিয়ে তৈরি ফেরি। আমি নিজে ১৯৭২ সালে একবার নিউ মার্কেট থেকে ট্যক্সিতে সরাসরি আরিচাঘাটে যযাওয়ার পথে সেই ফেরিতে পার হওয়ার সময় অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭৪ সালে নয়ারহাট এবং তরায় ব্রীজ চালু হলে ঢাকা-আরিচা সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

 

পদ্মা সেতু হওয়ার পরে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অভুতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে। আমরা রাজবাড়ী অঞ্চলের লোকজন আগে আশায় থাকতাম, পদ্মা সেতু হবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া। সবদিক বিবেচনায় পদ্মা সেতুর উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়া হয় মাওয়া-কাওড়াকান্দি। তাতেও আমরা খুশি। অতীব খুশি। আজকাল পদ্মা সেতু হয়ে পথ বেশি হলেও পাটুরিয়া হয়ে যাওয়ার চিন্তা করি না। কারণ, আগে ফেরির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো। এখন গাড়ি স্বল্পতার কারণে ফেরি ছাড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।

 

এখন আসি মূল কথায়

আজ থেকে চালু হলো পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাজবাড়ীর কালুখালি, পাংশা অঞ্চলের লোক আশায় ছিলো, ট্রেনে সরাসরি ঢাকায় যাতায়াত করবে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লোকজন এ সুবিধা ভোগ করলেও রাজবাড়ি, ফরিদপুর অঞ্চলের লোক তা থেকে বঞ্চিত ছিলো। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো, খুলনা-ঢাকা এবং বেনাপোল-ঢাকাগামী উপরে বর্ণিত ট্রেন দুটি জংশন ষ্টেশন হওয়া সত্বেও “কালুখালি” ষ্টেশনে কোনো স্টপেজ নাই।

 

ট্রেন দুটির সময়সূচী এবং যাত্রাবিরতির স্থান পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ট্রেন দুটি মুলতঃ আন্তঃজেলা ট্রেন হিসেবে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তাহলে ঝিনাইদহ জেলায় দুটি ষ্টপেজ কেনো? ঝিনাইদহ জেলার কোর্টচাঁদপুর ও মোবারকগঞ্জ জংশন ষ্টেশন না হওয়া সত্বেও সেখানে ষ্টপেজ রাখা হয়েছে। অথচ কালুখালি গুরুত্বপূর্ণ একটি জংশন ষ্টেশন। এই ষ্টেশনের সাথে ভাটিয়াপাড়া নামক একটি লাইনের সাথে সংযুক্ত যে লাইন সেটি রাজবাড়ির পার্শবর্তী জেলা ফরিদপুর, নড়াইল এবং গোপাল্গঞ্জ ছুঁয়ে গেছে।

 

উল্লেখ্য, ভাটিয়াপাড়া লাইনটি বিএনপি সরকারের আমলে লোকশান দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলে লাইনটি সংস্কার করে আগের চেয়ে আরো উন্নত করে “ভাটিয়াপাড়া এক্সপ্রেস” নামে নতুন ট্রেন চালু করে। ২০১৩ সালের ২রা নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবরূপে সজ্জিত “কালুখালী জংশন-ভাটিয়াপাড়া” সেকশনের রেলপথটি উদ্বোধন করেন।

আরো উল্লেখ্য, রাজবাড়ির পার্শবর্তী জেলা মাগুরায় কোনো ট্রেন লাইন নাই। কালুখালি ষ্টোপেজ দিলে মাগুরার কিছু অংশের লোক ট্রেনে ঢাকা যাতায়াতের সুযোগ ভোগ করতে পারতো।

 

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-খুলনা রুটের সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী জংশন দিয়ে খুলনা ও বেনাপোল নিয়মিতভাবে যাতায়াত করবে। কাশিয়ানী- খুলনা রুটের রেলপথের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় স্বল্প সময়ের জন্য ভাঙ্গা-রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া হয়ে এ ট্রেন দুটি চলাচল করবে। এ কারণেই নাকি খুব বেশি স্টপেজ রাখা হয়নি, যা পুরাপুরি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না।

 

তবে এই সেকশনে রাজশাহী-পদ্মাসেতু-ঢাকা রুটে মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি নিয়মিত চলাচল করবে এবং শুধুমাত্র ওই ট্রেনটির স্টপেজ রাখা হয়েছে কালুখালিতে।

 

পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-খুলনা রুটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও ঢাকা-বেনাপোল রুটে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর খবরে রাজবাড়ী জেলার কালুখালী ও পাংশা উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিলো। কিন্তু শিডিউল প্রকাশ হওয়ার পর কালুখালী জংশনে স্টপেজ না থাকায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা বিরাজ করছে। পুরাতন জংশন ষ্টেশন হিসাবে কালুখালিতে স্টপেজ দেয়ার দাবি তাদের। এ ব্যাপারে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ কামনা করছে সবাই।

 

 

 

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url