বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-২২)-বাংলাদেশ
একজন বেবী মওদুদ
বেবী মওদুদ (ইংরেজীঃ Baby Moudud) (জন্ম ২৩শে জুন ১৯৪৮-মৃত্যু ২৫শে
জুলাই ২০১৪): ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক এবং
রাজনীতিবিদ। তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম
একজন নারী সংগঠক ও বিশ্লেষক এবং কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিজেএ) ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস ছিলেন। বেবী
মওদুদ ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নবম সংসদের একজন সংসদ
সদস্য।
বেবী মওদুদ রাজনৈতিক কোনো বড় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তবে তিনি
ছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন আদর্শিক কর্মী। তার লেখনীর মাধ্যমে তা অনেকাংশে
ফুটে উঠেছে।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ
বাল্যবন্ধু ও সজ্জন। এছাড়াও তার পশ্চিম
বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা
বন্দোপ্যাধ্যায়ের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ
সম্পর্ক ছিলো।
বেবী মওদুদ ছিলেন অদম্য বাঙালি ও জাতীয়তাবাদী।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক দৈনিক পত্রিকায়
সাংবাদিকতাসহ শিশু কিশোরদের নিয়েও প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাকে শিশুসাহিত্যিক
হিসেবেও অনেকে মনে করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি
প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হন।
জন্ম
ও পরিবার
বেবী মওদুদ ১৯৪৮ সালের ২৩শে জুন পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ
করেন। তার পুরো নাম ‘আফরোজা নাহার মাহফুজা খাতুন’ (সংক্ষেপে এ এন মাহফুজা খাতুন)
হলেও তাকে সবাই বেবী মওদুদ নামেই চেনেন। তার পিতা 'আবদুল মওদুদ' ছিলেন বিচারপতি
এবং পাকিস্তান সরকারের
আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। আবদুল মওদুদ পাকিস্তানের
রাওয়ালপিন্ডি শহরে থাকতেন এবং ইসলামাবাদে গিয়ে অফিস করতেন। বেবী
মওদুদের মাতা 'হেদায়েতুন্নেসা' ছিলেন গৃহবধূ। ছয় ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে বেবী
ছিলেন তৃতীয়।
জন্মের সময় আকিকা দিয়ে তার নাম রাখা হয় ‘আফরোজা নাহার মাহফুজা
খাতুন’। জন্মের পর তার মা তা্র শরীরে বেবী জনসন পাউডার মাখতেন। সেটা দেখে তার বড়
ভাই তাকে ‘বেবী’ বলে ডাকতে শুরু করেন। তাছাড়া এতোবড় নাম ভালো লাগতো না বলে বড়
হয়ে লেখালেখি করতে এসে তিনি নিজেই নিজের নাম ‘বেবী মওদুদ’ রাখেন। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক
বিচারপতি মারজি-উল হক বেবী মওদুদের বড় ভাই।
ব্যক্তিগত
জীবন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে বেবী মওদুদ ঠাকুরগাঁও জেলার সাংবাদিক হাসান আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
হন। হাসান আলী দৈনিক সংবাদের একজন অভিজ্ঞ রিপোর্টার ছিলেন। পরবর্তীতে হাসান আলী
মুখ্য রিপোর্টার, নগর সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে চারটি বাদে
সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হাসান সাংবাদিকতা ছেড়ে আইন পেশায়
মনোনিবেশ করেন। হাসান আলী বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের একজন সদস্য ছিলেন।
১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে স্বামী অ্যাডভোকেট মোঃ হাসান আলীর অকাল
মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে বেবী মওদুদ নিজেই তার দুই পুত্র রবিউল হাসান অভী ও শফিউল
হাসান দীপ্তর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন এবং নতুন করে জীবন-সংগ্রাম শুরু করেন। কিন্তু
নীতি ও আদর্শ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি।
১৯৬৪
সালে কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী বেবী মওদুদ
শিক্ষা
বেবী মওদুদ ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স
এবং ১৯৭১ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায়
তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হন। নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার
সংগ্রামে একনিষ্ঠ, সমাজসেবায় অগ্রণী, সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ এবং রাজনীতির
সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও বেবী মওদুদ ছিলেন মূলত পেশাদার সাংবাদিক।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার
সময়কালীন বেবী মওদুদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী
অর্জন করার পূর্বে ১৯৬৭-৬৮ সাল পর্যন্ত রোকেয়া হলের ছাত্রী সংসদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
১৯৬৭ সাল থেকে পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতায় জড়িত বেবী মওদুদ দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক ললনা, দৈনিক ইত্তেফাক ও
দৈনিক মুক্তকন্ঠে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বিবিসির বাংলা বিভাগের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সংবাদ
সংস্থার (বাসস) বাংলা বিভাগ গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন
তিনি। নতুন কলেবরে যখন সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রকাশিত হয় তখন তিনি এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের
দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর
ডটকমে সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক ছিলেন বেবী মওদুদ। এই সাময়িকীর
সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা।
প্রতিমুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ
তৈরি করার ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাবতীয় আন্দোলন সংগ্রামে
তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অতীতের সমস্ত প্রতিবন্ধকতায় বেবী মওদুদ পথভ্রান্ত না
হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অটল আস্থা রেখেছিলেন।
১৯৮০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে পাকিস্তানের করাচীতে
বেবী মওদুদ জাতিসংঘের তৎকালিন নতুন স্থায়ী প্রতিনিধি ড: এ কে আব্দুল মোমেনের
সাথে বাংলাদেশের নারী ও শিশু পাচার বিষয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরা্ধীদের শাস্তির দাবিতে “ঘাতক-দালাল
নির্মূল কমিটির” বিভিন্ন আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন বেবী মওদুদ।
২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কর্তৃক মনোনীত সংসদ সদস্য হন তিনি। বাংলাদেশ সমাজ কল্যান
মন্ত্রণালয়ে সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য
হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
লেখালেখি
সাংবাদিকতার পাশাপাশি রকমারি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখিতে লিপ্ত
ছিলেন বেবী মওদুদ। তিনি কয়েকটি শিশুতোষ ও আত্মকথন গ্রন্থ রচনা করেছেন। নারী
মুক্তির অগ্রদূত বেগম
রোকেয়া সম্পর্কে তার সম্পাদনায় ২০১১ সালের
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘রোকেয়া
চিরন্তনী প্রতিকৃতি' গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’ সম্পাদনাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বইও রয়েছে তার। বেবী মওদুদের
অর্থানুকূল্যে ২০০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে 'ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক' গ্রন্থের প্রথম
সংস্করণ, ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে দ্বিতীয় সংস্করণ এবং তৃতীয় সংস্করণ
প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্ত্ররজাতিক মাতৃভাষা দিবসে। সারা
জীবন তিনি মানবতার একনিষ্ঠ সাধনা করেছেন। প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বেবী মওদুদের।
প্রকাশিত গ্রন্থ
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত
আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি সংস্করণের ক্ষেত্রেও বেবী মওদুদের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার
সাথে স্মরণ করেন। তিনি শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সেগুলো হলোঃ
· দীপ্তর জন্য ভালবাসা
· পবিত্র রোকেয়া পাঠ
· টুনুর হারিয়ে যাওয়া
· শান্তর আনন্দ
· এক যে ছিল আনু
· আমার রোকেয়া
· মুক্তিযোদ্ধা মানিক
· কিশোর সাহিত্য সমগ্র
· আবু আর তার এবং
· জল দিয়ে লিখি
তার রচিত অন্য
পুস্তকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোঃ
· মনে মনে (ছোট গল্প)
· শেখ মুজিবের
ছেলেবেলা,
· দুঃখ-কষ্ট ভালবাসা
· পাকিস্তানে
বাংলাদেশের নারী পাচার
· গণতন্ত্রের মানসকন্যা
শেখ হাসিনা
· বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
ও তার পরিবার ইত্যাদি।
আমাজন ডট কমে তার পাঁচটি বইয়ের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হলোঃ
· আমার রোকেয়া
· বাংলাদেশের জাতীয়
সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ
· নিভৃত যত্নে, রোকেয়া :
চিরন্তনী প্রতিকৃতি
· এবং সুশি পুষি টুশি।
বেবী মওদুদের প্রকাশিত বই “আমার রোকেয়ার” প্রচ্ছদ।