বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৫)-আজারবাইজান
লায়লা ইসলাম কিজি ইউনুসোভা
লায়লা ইউনুস |
লায়লা ইসলাম কিজি ইউনুসোভাঃ (জন্ম ২১ ডিসেম্বর
১৯৫৫) যিনি লেইলা ইউনুস নামে বেশি পরিচিত, একজন আজারবাইজানীয় মানবাধিকার কর্মী
এবং সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী।
লায়লা "ইনস্টিটিউট অফ পিস
অ্যান্ড ডেমোক্রেসি" নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তিনি
বিশেষভাবে বাকুতে জোরপূর্বক উচ্ছেদ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের সাহায্য করার
জন্য পরিচিত। কাজটির স্বপক্ষে তিনি বেশ কয়েকটি ছোট বিক্ষোভের আয়োজন করেছিলেন।
জুলাই ২০১৪ সালে আজারবাইজানীয় কর্তৃপক্ষ জালিয়াতি এবং কর ফাঁকির অভিযোগে লায়লাকে
কারাগারে পাঠায়, যা ব্যাপকভাবে সন্দেহজনক বলে বিবেচিত হয়। ১৩ আগস্ট ২০১৫-এ সাড়ে
৮ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে লায়লাকে তার
স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে মুক্তি দেয়া হয়। আদালত তার সাজা স্থগিত করে।
লায়লা ইউনূস প্রশিক্ষণের
মাধ্যমে একজন ইতিহাসবিদ এবং “১৮ শতকের প্রথম ভাগে ক্যাস্পিয়ান সাগর এবং
আজারবাইজানে ইংরেজি-রাশিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতা" বিষয়ে তার গবেষণামূলক
প্রবন্ধ লিখেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ
বছরগুলিতে লায়লা সংস্কারপন্থী চক্রগুলিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি মধ্যপন্থী
বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট গ্রুপের সাথে "পেরেস্ত্রেইকার সমর্থনে আজারবাইজানের
জনপ্রিয় ফ্রন্ট" প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে, আজারবাইজানের এই পপুলার
ফ্রন্টকে ইচ্ছাকৃতভাবে এস্তোনিয়ার পপুলার ফ্রন্টের উদাহরণের আদলে তৈরি করা
হয়েছিল।
১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে লায়লা
ইউনুস জারদুশত আলীজাদেহের সাথে একত্রে একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি” গঠন করেন। এপ্রিল ১৯৯০ সালে ইউনূস
"একজন রাজনীতিকের দায়িত্ব" নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তাতে একটি
গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থা এবং চরম জাতীয়তাবাদ এবং সোভিয়েত শাসনের সহিংস দমন-পীড়ন
উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৯২-১৯৯৩ সালে
নাগর্নো-কারাবাখ সংঘাতের সময় লায়লা প্রতিরক্ষা উপ-মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেন।
পরবর্তীকালে লায়লা ইউনুস
আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া উভয় দেশের নাগরিক সমাজের কর্মীদের সাথে শান্তির আহ্বান
জানান। তিনি এবং তার স্বামী ইতিহাসবিদ আরিফ সক্রিয়ভাবে আর্মেনিয়ার সাথে
পুনর্মিলনের জন্য পরিচিত। ১৯৯৮ সালে তিনি সক্রিয় অহিংসার বিষয়ে আর্মেনিয়ান
প্রতিপক্ষের সাথে মিলিত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশিপ অফ রিকনসিলিয়েশনস উইমেন
পিসমেকারস প্রোগ্রাম (WPP) এর ইউরোপীয় পরামর্শ বিষয়ক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি “ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসির” পরিচালক হন।
২০০৯ সালে লায়লা ইউনূসের
বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা হয়। তিনি বলেছিলেন যে, “দুটি তরুণীকে অপহরণ ও
পাচারের সাথে পুলিশ জড়িত ছিলো”। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রামিল উসুবভ তার বিরুদ্ধে এ
মামলা করেন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এই বিচারের প্রতিবাদ করে। তারা বলে,
"ইউনুসের বিরুদ্ধে একটি রায় আজারবাইজানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি
ভয়ানক নজির স্থাপন করবে”। অন্যান্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এই মামলাটিকে
"স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর আজারবাইজানি সরকারের ক্র্যাক ডাউন করার আরও একটি
উদাহরণ" হিসাবে বর্ণনা করে।
২০১১ সালে তার অফিস উচ্ছেদের
সময় পুলিশের আচরণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যর্থ আপিলের পর লায়লা
ইউনূস উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে আপিল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
‘১১ আগস্ট ২০১১ তারিখে কর্তৃপক্ষ ইউনূসের বাকু অফিসকে মাত্র কয়েক মিনিটের
সতর্কবার্তা দিয়ে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়’। সে দিনই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ একটি
নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো যাতে তিনি জোরপূর্বক উচ্ছেদের সমালোচনা করেছিলেন।
তার অফিস ধ্বংসের দিন তিনি
নরওয়েতে ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা এই ধ্বংসযজ্ঞের
"নিন্দা" করেন এবং তার সংস্থাকে "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়মিত
অংশীদার" বলে অভিহিত করেন। আজারবাইজানীয় সংসদ সদস্য খাদি মুসা রেদজাবলি
অস্বীকার করেন যে, বুলডোজিং লায়লা ইউনূসের মানবাধিকার কাজের সাথে যুক্ত ছিল না।
সেন্সরশিপের সূচক এবং রাফটো ফাউন্ডেশন সহ ১৪টি দেশের ৫২টি মানবাধিকার সংস্থা
আজারবাইজানি কর্তৃপক্ষকে ধ্বংসের নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি যৌথ চিঠি
পাঠায়।
২০১৪ সালে রাসুল জাফরভের
সাথে লায়লা ইউনুস একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের নেতৃত্ব দেন, যা আজারবাইজানে রাজনৈতিক
বন্দীদের একটি তালিকা তৈরিতে কাজ করেছিলো। ২০১৪ সালের আগস্টের প্রথম দিকে তাদের
দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হয় এবং সর্বশেষে ওই তালিকায় তদের নামও যুক্ত হয়। তাদের
কাজের চূড়ান্ত ফলাফল নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটি দ্বারা প্রকাশিত হয়।
২৮ এপ্রিল ২০১৪-এ ইউনুস এবং
তার স্বামী আরিফকে কাতারের দোহা যাওয়ার পথে হায়দার আলিয়েভ আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও কর ফাঁকির অভিযোগ আনা
হয়। তিনি এবং তার স্বামী আরিফ জেলে যান। লায়লা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায
সত্বেও আজারবাইজানি কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। এমন
অবস্থায় জেলে তার স্বাস্থ্য অনিশ্চিত হিসেবে বর্ণনা করা হয। জালে তার স্বামীর সাথে
সরাসরি যোগাযোগ করা নিষেধ করা হয়। তিনি একটি খোলা চিঠি লেখেন যা বিভিন্ন
ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। চিঠিতে তিনি বলেন যে "আমরা কখনই ভাবতে পারিনি যে
একুশ শতকে ফিরে আসবে ১৯৩০ এর মতো দমন।"
লায়লা ও আরিফ ইউনুস,
সেইসাথে রাসুল জাফরভকে আটক করাকে মূলত আজারবাইজানের নাগরিক সমাজের ওপর রাষ্ট্রীয়
দমন-পীড়নের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কর্তৃপক্ষের এই কর্মকাণ্ডকে
অনেক বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কঠোরভাবে নিন্দা করে। তাদের মধ্যে
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউনূসকে "বিবেকের বন্দী" বলে অভিহিত করে এবং
অবিলম্বে তাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানায়। সংসদীয় পরিষদ কাউন্সিল অব ইউরোপ,
ওএসসিই-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন, মানবাধিকার রক্ষাকারীদের সুরক্ষার জন্য
অবজারভেটরি, নোবেল ওমেন ইনিশিয়েটিভ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, হিউম্যান রাইটস
ওয়াচ এবং অন্যান্য এ ঘটনার নিন্দা জানায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
"মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে আজারবাইজান সরকারের
আক্রমণ" এর কারণে এক্সট্র্যাক্টিভ ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভ
(EITI) থেকে আজারবাইজানের সদস্যপদ স্থগিত করার আহ্বান জানায়।
১৩ আগস্ট ২০১৫ লায়লা
ইউনুসকে সাড়ে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার স্বামী আরিফকে জালিয়াতি এবং কর
ফাঁকির অভিযোগে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই দম্পতি একটি পৃথক মামলায়
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের (আর্মেনিয়ার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে) মুখোমুখি
হয়েছিল, যা কখনও শোনা যায়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি
তাদের বিচারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের মামলাকে “শো
ট্রায়াল” হিসেবে নিন্দা করে এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই দম্পতিকে বিবেকের
বন্দী হিসেবে বর্ণনা করে।
লায়লা ইউনুসকে ৯ ডিসেম্বর
২০১৫-এ স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি দেওয়া হয়। তার স্বামী আরিফ ইউনুসকেও তার আগে
২০১৫ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি দেয়া হয়। তা্দের সাজা স্থগিত করা
হয়, অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হয়নি।
লায়লা এবং আরিফ ইউনুসকে
আজারবাইজানীয় সরকার এপ্রিল ২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য নেদারল্যান্ডে যাওয়ার অনুমতি
দেয় এবং সেখানেই তারা বসবাস করতে থাকে।
অক্টোবর ২০১৪ সালে লায়লা ইউনূস
‘সাখারভ’ পুরস্কারের জন্য তিনজন ফাইনালিস্টের মধ্যে ছিলেন। সোভিয়েত
ভিন্নমতাবলম্বীদের শেষ প্রজন্ম এবং প্রয়াত আন্দ্রেই সাখারভের বন্ধুসহ বেশ কয়েকজন
বিশিষ্ট কর্মী এই মনোনয়নকে সমর্থন করেছিলেন। সাখারভ পুরষ্কার ঘোষণা করার সময়
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আরও বলে, "তার দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার লড়াইয়ে
লায়লা ইউনূসের সাথে দেখা করতে এবং সমর্থন করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের
প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রতিনিধি দল আজারবাইজানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত
নিয়েছে।"
অক্টোবর ২০১৪ সালে
‘নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটি’ লায়লা ইউনুসকে - রাসুল জাফারভ, আনার মাম্মাদলি
এবং ইন্তিকাম আলিয়েভের সাথে – ‘আন্দ্রেই সাখারভ ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা
হয়।
লায়লা ইউনুস মানবাধিকারের
জন্য লড়াইয়ে তার ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য অক্টোবর ২০১৪ সালে ‘সার্জিও ভিয়েরা
ডি মেলোর পোলিশ’ পুরস্কার পেয়েছেন।