গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৬)

 



দক্ষিণ কোরিয়ায় মহিলা মালিকের নীটিং ফাক্টরিতে ভালোই কাটছিলো। ফ্যাক্টরিতে কর্মরত মহিলা পুরুষ সবাই আমাকে খুব আন্তরিকতার সাথেই সমাদর করতো। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই এক বিপত্তি শুরু হলো। কম বেতনে মহিলা ওপারেটর দিয়ে দিনে কাজ করাতো আর আমাকে দিয়ে কন্টিনিউ রাতে কাজ করাতে শুরু করলো। অজুহাত দিতো, ‘তোমার পারমিট নেই, দিনে পুলিশ এসে উতপাৎ করবে’- এইসব। অন্যান্য কোম্পানি থেকে বেতনও তুলনামূলক কম। তাছাড়া ২৪ ঘন্টা রানিং প্রতিষ্ঠানে ঘুরেফিরে রাতে কাজ করতেই হয়। তাই আয়েসী স্বভাবের লোক হিসেবে শুধু দিনে কাজ হয় এমন প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করছিলাম। এসব কারণে এক পর্যায়ে দেশীয় পরিচিতদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম।

 

‘টেলিফোন ওই দেশে খুব সহজলভ্য। মোবাইল ছাড়াও প্রতিটা বাড়িতেই ল্যান্ড টেলিফোন আছে। সঠিক কিনা জানিনে, তবে টেলিফোন নম্বরই সেদেশের বাড়িগুলোর হোল্ডিং নম্বর হিসেবে ধরা হয় বলে আমার কাছে মনে হয়েছে । আমাদের দেশে তখনও মোবাইল চালু হয়নি। ল্যন্ডফোনেও লাইন পেতে অপেক্ষা করতে করতে হাত-পায়ে ঝিঝি লেগে যেতো। এনডব্লিউডি, আইএসডি কলের জন্যেতো চিড়ামুড়ি পোটলায় বেঁধে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিফোন অফিসে গিয়ে বসে থাকতে হতো। অনেক সময় লাইন না পেয়ে ফিরেও আসতে হতো। অন্য জেলা থেকে নারায়ণগঞ্জে তো লাইনই পাওয়া যেতোনা’।

 

দেশীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো। অন্যান্য দেশের লোকজনদের, বিশেষ করে নেপালীদের যেমন একে অন্যের সহযোগীতা করতে দেখেছি, বাঙ্গালিদের দেখেছি একটু পরামর্শ দিয়েও কিভাবে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজন একটু টাকা কামাতে পারে সেই ধান্দা করতো। কারো প্রতি কারো কোনো সহযোগীতা বা সহমর্মিতা দেখানোর মনোভাব লক্ষ্য করিনি।

 

কোরিয়াতে তখন শ্রমিক সংকট। লোক খুঁজে এনে চাকরি দেয়। প্রয়োজন শুধু যোগাযোগের। অথচ আমি চাকরি বদলাতে এক বন্ধুর পরামর্শে আমার জেলা শহরের এক লোককে ফোন দিলে চক্ষুলজ্জা গিলে খেয়ে সে আমার কাছে উৎকোচ দাবী করে বসে। অতঃপর বাংলা ‘ঝাড়ি’। দেশে এসেও ঝেড়েছিলাম। কিন্তু তার লজ্জার স্নায়ু ততোটা মোলায়েম না, একটু কর্কশ বলে মনে হয়েছিলো। ওসব গায়েই মাখতো না।

 

অবশেষে যোগাযোগ হয় পূরান ঢাকার বাবুল নামে হ্যান্ডসাম এক যুবকের সাথে। কোরিয়াতে গিয়েই তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো। তার সাথে চাকরি করতে গিয়ে তার কীর্তি দেখে আমার মাথা ৪৫ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরে গিয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানের মালিকের সুন্দরী স্ত্রী’র প্রেমে পড়ে তার মোহে একজন মুসলমান হয়েও যে শুকরের মাংশ খেতে পারে তা একমাত্র তাকেই দেখেছিলাম। আগে মুখে বললেও তার কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু চাক্ষুস প্রমান পেলাম মালিক-শ্রমিক একসাথে সাপ্তাহিক ডিনার পার্টিতে যোগ দিয়ে।

 

‘বেশী আরাম খুজতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলাম। নতুন কর্মস্থলে দিনে আটঘন্টা কাজ, বেতনও আগের চেয়ে বেশি। কিন্তু কাজের ধরণটা আমার কাছে ভালো লাগছিলো না। আগের প্রতিষ্ঠানে ১২-১৩ ঘন্টা কাজ করলেও করতাম স্বাধীনভাবে। কাজের ফাঁকে ইচ্ছে করলেই কফি, ধুমপান করা বা ইচ্ছেমত দু’দন্ড বিশ্রাম নেয়া যেতো। কিন্তু এখানে পিরিয়ডিক্যাল বিরতি ছাড়া নিজের কোন সময় নেই। ফলে মাসখানেকের মধ্যেই নতুন কর্ম তল্লাশিতে বেরিয়ে পুলিশের জালে পরে দেশে ফেরত চলে আসতে হয়’।

 

‘সিউল শহরের প্রানকেন্দ্রে ছোট একটি প্রিন্টিং কারখানা। মালিকরা স্বামী-স্ত্রীসহ মোট ৮/১০ জন কর্মী। তারমধ্যে পুরান ঢাকার বাবু এবং আমি এ দু’জন মাত্র বিদেশী। ‘কোরিয়াতে অনেক মালিকই নিজহাতে কাজ করে। আগের কোম্পানিতেও মালিকের হাসব্যান্ড কিছু না কিছু কাজ করতো সেটা আগেই বলেছি’।

 

‘বাবু ছেলেটা দেখতে খুবই সুন্দর, কিন্তু খুব ধুর্ত ছিলো। মালিকের স্ত্রীও খুব সুন্দরী। চেহারায় আমাদের অঞ্চলের মেয়েদের চেহারার ছাপ। এমনিতেই সাদা চামড়ার কর্মঠ ও স্বাস্থ্য সচেতন কোরিয়ান মেয়েরা দেহের গঠনে প্রায় সবাই স্লিম। তারপর যদি চেহারায় থাকে দক্ষিণের অর্থাৎ এই উপমহাদেশের মেয়েদের চেহারার গড়ন তাহলে এই অঞ্চলের মানুষদের একটু বেশিই আকৃষ্ট করে’। দুয়েকদিনের মধ্যেই আঁচ করতে পারলাম বাবু এবং মালিকের স্ত্রীর মধ্যে একটা গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে’।

 

‘বাংলাদেশের ডলি সায়ন্তনীর ‘রঙ চটা জিনসের প্যান্ট পরা’ গানের ক্যাসেটটি তখন সবার সংগ্রহে। বাবুর কাছেও তার একটা ক্যাসেট ছিলো। কিন্তু ক্যাসেটের গায়ে মোড়ক ছিলো প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী ফাতেমাতুজ্জোহরার। বাবু সেই ক্যাসেটের গান শুনিয়ে, ক্যাসেটের কভারে ফাতেমাতুজ্জোহরার ছবি দেখিয়ে মালিকের স্ত্রীকে বলতো,, ‘এই শিল্পী আমার ‘গার্ল ফ্রেন্ড’।

 

‘বাবুর কাছ থেকেই শোনা; প্রতি রবিবারে গীর্জায় যাওয়ার নাম করে দু’জন বেরিয়ে পরতো অভিসারে। তার সাথে সম্পর্ক ভাল করতেই বাবুকে খেতে হয় শুকরের মাংস। দ্রুত শিখতে হয় কোরিয়ান ভাষা। ব্যাপারটা  ধরা পরে উইকএন্ড পার্টিতে বসে’।

 

প্রিন্টিং কারখানার মালিক সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ শনিবারে সবাইকে নিয়ে একসাথে হোটেলে ডিনার করতো। প্রথম দুই সপ্তাহ বিষয়টা বাবু আমাকে জানায়নি একারণে যে, আমি গেলে তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। মালিককে বুঝাতো আমি ডিনারে যেতে অনুৎসাহী’।

 

‘নতুন কর্মস্থলে একটা সমস্যা ছিল, কেউ ইংরেজী জানতো না। ওদিকে বাবু কোরিয়ান ভাষা শিখে নিয়েছে। ফলে মালিককে আমার সম্বন্ধে যা বুঝাতো এবং আমাকেও মালিকদের সম্বন্ধে যা বুঝাতো বাধ্য হয়ে তাই বুঝতে হতো’।

 

‘তার চালাকিটা ধরা পড়ে তৃতীয় সপ্তাহে। বাবু বলেছিলো এখানকার মালিক নিজেই দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। একদিন মালিকের মাধ্যমে কিছু টাকা পাঠাতে আমার হিসাব নম্বর লিখে দেই। মালিক ব্যাঙ্কে গেলে কিছুক্ষণ পর বাবুও দৌড়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে চালাকি করে ঠিকানা ভুল হয়েছে বলে আমার অগোচরে মালিককে বাবুর নিজের নাম ও হিসাব নম্বর লিখে দেয়’।

 

বাবু ভেবেছিল মালিক ইংরেজি জানেনা অতএব বুঝতে পারবেনা। কিন্তু বিষয়টা মালিকের সন্দেহ হলে সে ব্যাংকের লোক দিয়ে দু’টি ঠিকানা যাচাই করে চালাকিটা বুঝতে পেরে অফিসে ফেরত এসে আমাকে দেখিয়ে নিশ্চিত হয়, বাবু ঠিকই জালিয়াতি করেছে। তারপর থেকে মালিক তাকে আর বিশ্বাস করতোনা। উঠতে বসতে গালাগাল করতো। সেকারণেই তৃতীয় সপ্তাহে ডিনারে যাওয়ার জন্যে মালিক সরাসরি আমাকে আহবান জানায়।

 

পার্টিতে বসে বাবুকে সত্যি সত্যি শুকরের মাংস খেতে দেখে তার উপর থেকে আমার নিজের বিশ্বাস একেবারেই  উঠে যায়। (২০১৪ সালের লেখা)  …..........(চলবে)

(ডিনারে বসে যে অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটেছিলো তার বর্ণনা পরের পর্বে)

 

 (১৯৯২ সালের ঘটনা : ২০১৪ সালের লেখা)

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url