গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৭)

 



কোরিয়াতে যেখানে সেখানে চা পাওয়া যায় না। ফুটপাতের উপর বিভিন্ন স্থানে ইগলু আইসক্রিমের বক্সের মতো দেখতে একপ্রকার বক্স বসানো থাকে। কোনো ব্রিক্রেতা নেই। বক্সে কয়েন ড্রপ করে যার যেমন খুশি ঠান্ডা বা গরম চা, কফি, কোল্ড ড্রিংকস পান করতে হয়। চা পিয়াসী বাঙালি হিসেবে একদিন এক বক্সে এক পেয়ালা গড়ম চায়ের জন্যে কয়েন ড্রপ করলাম। বেড়িয়ে এলো নারকেল মিশ্রিত চা যা আমাদের মুখে রোচে না। তাই অতিথি আপ্যায়নে সেদেশে বিয়ারের খুব প্রচলন।

 

অতএব, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে আমাদের দেশের ছেলেরাও অতিথি আপ্যায়নে পটেটো চিপস বা বিস্কুট এবং চায়ের স্থলে বিয়ারে অভ্যাস্ত হয়ে ওঠে। কোরিয়ানরা অবশ্য অতিথির ইচ্ছানুযায়ী হট ড্রিংকস-এরও ব্যবস্থা করে থাকে। পার্টি হলে তো কথাই নেই। এমনিতেও কোরিয়ানরা প্রায় সবাই কমবেশি মদ্যপানে অভ্যস্ত।

 

‘আমার আগের কোম্পানির সহকর্মীদের হার্ড ড্রিংকস আশক্তি তেমন নজরে পরেনি। এক সহকর্মীকে প্রায়ই দেখতাম তাদের জন্যে নির্ধারিত রেফ্রিজারেটর থেকে (আমার জন্যে আলাদা রেফ্রিজারেটর ছিল)। আমাদের দেশের ’শালসা’র মতো দেখতে একটা কাঁচের বোতল থেকে কি যেনো বের করে তার সাথে পানি মিশিয়ে অল্প অল্প করে ঠিক শালসার মতোই পান করতে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ওগুলো কি পান করো’? বললো, ‘আমি আর সবারইর মতো মদ্যপান করিনা। আঙুর ফলের রস থেকে তৈরী এটাও একপ্রকার মদ, নাম ’গ্রেপস ওয়াইন’। তবে এটার মধ্যে এলকোহলের পরিমান খুব কম তাই পানি মিশিয়ে অল্প অল্প করে ওষুধ হিসেবে সেবন করি’।

 

‘আমার একটু ইচ্ছে করেছিল চেখে দেখতে কিন্তু বলতে পারিনি। তবে সে মনেহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তাই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় সে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে আমার জন্যে রেস্তোরায় চিকেন(ফ্রায়েড) পার্টির আয়োজন করেছিল’।

 

প্রিন্টিং কারখানার মালিক, মালিকের স্ত্রী, কারখানার ম্যানেজার এবং বাবু ও আমি এই পাঁচজন মিলে এক রেঁস্তোরায় গেছি উইকএন্ড পার্টিতে। আসলে ওটা কি রেঁস্তোরা ছিলো না পানশালা ছি্লো তখন তা বুঝতে পারিনি। আমাদের দেশের চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোর মতো নিয়ন আলোর একটি হলরুমে জায়গায় জায়গায় চৌকি বসনো। কোনো টেবিল চেয়ার নেই। তারই এক চৌকিতে আমরা পাঁচজন গিয়ে গোল হয়ে বসলাম।

হোষ্ট (মালিক) খাবারের অর্ডার দেয়ার পর মোটা স্টীলের তৈরী ঝাঁঝড়া গোল আকারের ষ্টোভের মতো পাত্রের ভেতরে নিচে গ্যাস বা বিদ্যুত চালিত হিটারের একপ্রকার চুলার দু'টি চুলা এনে আমাদের মাঝখানে রাখা হলো। তারপর মশলা মেশানো থেতলানো মাংশ সরবরাহ করা হলো। সে মাংশ হিটারের চুলার উপরে আঁচিয়ে সেদ্ধ বা খাওয়ার উপযুক্ত হলে সেখান থেকে প্রত্যেকে যার যার ফর্ক বা কাঁটা চামচ দিয়ে (কোরিয়ানরা দু’টি কাঠি) খাবারের জন্যে সরবরাহকৃত অন্য আইটেমের (রুটির মতো কি যেন, এখন মনে নেই) সাথে খেতে হবে।

 

মাংস আঁচানোর সময় বাবু বলছিলো, ‘খান ভাই, এটা কিন্তু শুকরের মাংস। আপনার যদি অভ্যেস না থাকে তাহলে খাবেন না’। এমনিতেই টাকা পাঠানোর ঘটনার জন্যে ওর সাথে একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া ধুর্ত প্রকৃতির লোক, কি মনে করে বলছে, নাকি ঠাট্টা করছে এসব ভাবছিলাম। মনে মনে। এও ভাবছিলাম, সেওতো মুসলমান, শুকরের মাংশ হলে সেওতো খাবেনা। অতএব, ‘নো চিন্তা’। ও খেলে আমি খাবো, ও না খেলে আমিও খাবো না।

 

কোরিয়ান ভাষা আমার কাছে শ্রুতিমধুর মনে হতো না তাই ইচ্ছে করেই শেখার প্রতি আগ্রহী হইনি। তাছাড়া আগের কোম্পানির প্রায় সবাই চলার মতো ইংরেজি জানতো সে কারণে তেমন সমস্যায়ও পড়তে হয়নি। তবে ওদের সাথে থেকে অধিক প্রচলিত দু’য়েকটি শব্দ শিখেছিলাম। কিন্তু নতুন কর্মস্থলের কেউই ইংরেজির কোনো বাক্য তো দূরের কথা, ইয়েস নো-ও বোঝে না। ডিনারে বসে বাবু যখন বারবার বলছিলো ‘এটা শুকরের মাংশ’, উপস্থিত অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করলে ভাষা না বোঝার কারণেই হোক বা অন্য কারণে হোক কেউ মুখ খোলে না। শুধু ম্যানেজার একবার বুঝতে পেরে অনুষ্ঠান যাতে পন্ড না হয় সে জন্যে কথা লুকিয়ে বললো, ‘ছাখুগি’ অর্থাৎ গরুর মাংশ।

 

খাওয়া শুরু হলে বাবু খাচ্ছে দেখে আমিও খাওয়া শুরু করলাম। খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে বাবু পূনরায় আমাকে সতর্ক করায় আমি কোরিয়ানদেরকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ক্যানছেনা, মগো মগো’ অর্থাৎ ‘সমস্যা নাই, খাও খাও’। বাবু বললো, ওরা যতোই বলুক আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন, নইলে পরে কিন্তু আমাকে দুষতে পারবেন না। বললাম, তাহলে তুমি খাচ্ছো কেনো? বাংলা ভাষা কেউ বুঝবেনা তাই সে মালিকের স্ত্রীকে ইঙ্গিত করে অকপটে বললো, ‘আমি ওর (মালিকের) বউকে ভালবাসি, একসাথে একদিন খেতে বসে না খেতে চাইলে অসুন্তষ্ট হওয়ায় বাধ্য হয়ে খেয়েছিলাম, তারপর থেকে নিয়মিত খাই। তবুও আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। একজন মুসলমান হয়ে সে কিভাবে শুকরের মাংস খায়! অবশেষে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে হোটেল কর্তৃপক্ষের সাহায্য নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 

কোরিয়ানদের নিয়ম হলো কাকা, মামা, খালু যাইই হোক বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষদেরকে ডাকে ‘আজোসি’। তেমনি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদেরকে ডাকে ‘আজুম্মা’ এবং বৃদ্ধ মহিলা অর্থাৎ দাদীর বয়সীদেরকে ডাকে হারমনি,- সে খালা, ফুপু, দাদী, নানী যাই হোক। আমাদের খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো ৪০-৪৫ বছর বয়সের এক আজুম্মা। ডাকলাম তাকে। যতোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি সে আমার কথা বোঝেনা। অবশেষে বাবুই সাহায্য করলো বোঝাতে যে, ‘এটা কিসের মাংশ তাই জিজ্ঞেস করছে’। আজুম্মা ঝটপট জবাব দিলো, ‘ইয়াখুগি’(শুকরের মাংশ)। শুনে আমার মাথা ৪৯। বেঈমান বলে কি! একজনের বউএর ভালবাসায় মুসলমান হয়ে সে শুকরের মাংশ খায়! এর মতো বিশ্ব হারামী কি দুনিয়ায় আর দু’একজন আছে?

 

সাথে সাথে খাওয়া বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম। মালিকরা যতোই বলছে, ‘ক্যানছেনা, মগো’ তাই কি আর সম্ভব! ডিনার পার্টির হোষ্ট অর্থাৎ কোম্পানির মালিক ও উপস্থিত অন্যান্য কোরিয়ানরা বিব্রত। মালিকের স্ত্রী বিশেষভাবে বিচলিত, যে জিনিষ বাবু খায় আমি খাইনা এটার গূঢ় তত্ব যদি তার হাসব্যান্ড বুঝে ফেলে এই আশংকায়। কারণ, তারা দুজন এমনিতেই একটু সন্দেহের নজরে ছিলো। অবশেষে ৪টি মুরগির ডিম মামলেট করে এনে আমার সামনে রাখা হলো। খেতে অরুচি হলেও সবার পীড়াপীড়িতে খেতে হয়েছিলো।

 

এমনিতেই কোম্পানির কাজের ধরণ, পরিবেশ ইত্যাদি ভালো লাগছিলো না। ভাষা সমস্যা তো ছিলোই। তারপর বাবুর কার্যকলাপ দেখে মনটা একেবারে বিষিয়ে উঠলো। কোরিয়াতে শ্রমিকদের বেতন যাইই নির্ধারণ হোক থাকার ব্যাবস্থা মালিকের এবং খাওয়া বাবদ প্রতিমাসে বাংলাদেশি মূদ্রামানে ৫০০০ টাকা আলাদা দিতো। সে টাকা থেকেও খরচের অবশিষ্ট টাকা বাবু মেরে দিতো। ওই সময় (১৯৯২) আমাদের দেশের ছেলেদের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ সাধারণভাবে জীবন নির্বাহ করতে ৩০০০ টাকার বেশি লাগতোনা।

 

একটা মজার বিষয় ইতোপূর্বে উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। আমি যখন একা থাকতাম, সপ্তাহে মাত্র একবার একটা বড় মুরগি রান্না করে সারা সপ্তাহ খেতাম। তিনবেলাই ভাত খেতাম। প্রতিদিন সকালে দুটো ডিম ভেজে নাস্তা করতাম। তরকারি যাতে কম না পড়ে সেজন্যে মাঝেমধ্যে রাতেও দুটো ডিম ভেজে ভাত খেয়ে নিতাম। কোনো সপ্তাহে পূর্বে উল্লেখিত মাছ এনে রান্না করতাম, তবে কদাচিৎ।.........(চলবে)।

 

 (১৯৯২ সালের ঘটনা : ২০১৪ সালের লেখা)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url