গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৯)
দার্জিলিং যেতে বুড়িমারী-চেংরাবান্ধা বর্ডার হয়েই যেতে হবে এমন কথা নেই। কেউ ইচ্ছে করলে কোলকাতা বেড়াতে গিয়েও দার্জিলিং ঘুরে আসতে পারেন। কোলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে শিলিগুড়ি যাওয়া যায়। তবে কোলকাতা-শিলিগুড়ি এবং ঢাকা-শিলিগুড়ি দূরত্ব প্রায় সমান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজনীয় বর্ডার
নির্দিষ্ট করে ভিসা নিয়ে গেলে সুবিধা হয়। বেনাপোল, দর্শনা বা অন্য বর্ডার দিয়ে কোলকাতা গিয়ে, কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং বেড়িয়ে বুড়িমারী হয়ে বাংলাদেশে আসতে সুবিধা হবে।
শিলিগুড়ি থেকে কেউ ইচ্ছে করলে শখ করে ‘টয় ট্রেনে’ দার্জিলিং যেতে পারেন। তাতে সময় লাগবে ছয় সাত ঘন্টা, যেখানে জীপে লাগে মাত্র দেড় দুই ঘন্টা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ‘ন্যারো গেজ’ রেল লাইন পাহাড় বেয়ে সাত হাজার ফুট (২২০০ মিটার) উপরে উঠে গেছে। শুধু সৌখিন যাত্রীদের নিয়ে দিনে একটি ট্রেন ‘নিউ জলপাইগুড়ি’ থেকে ছেড়ে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং পৌঁছে এবং অন্যটি দার্জিলিং থেকে ছেড়ে নিউ জলপাইগুড়ি আসে।
দার্জিলিং পশ্চিম বাংলার একটি জেলা। এর আয়ের প্রধান উৎস চা এবং পর্যটনশিল্প। জেলার অধিকাংশ অধিবাসী নেপালী ভাষাভাষী। বাঙ্গালি অধ্যুসিত শিলিগুড়ির অধিবাসীরাও নেপালী ভাষা জানে। ১৯৮০ সালে সুভাষ ঘিসিং-এর নেতৃত্বে ‘গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ)’ নেপালী ভাষাভাষী অধ্যুসিত এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন ‘গোরখাল্যন্ড’ প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দাবীতে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশেষে ১৯৮৮ সালে সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল’ গঠন করে শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে দারজিলিং-এর অন্য তিনটি পাহাড়ী মহকুমাকে আধা স্বায়ত্ত শাসন দেয়া হয়। বর্তমানে দার্জিলিং মুলতঃ উক্ত কাউন্সিলের কর্তৃত্বাধীনে চলে।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরাট একটি সেনানিবাস আছে। সেখান থেকে সম্ভবতঃ পাহাড়ী এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। সেনানিবাসের আগে ও পরে পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের আগে সুশোভিত চা বাগানের দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠে সামনের আরো উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় পাহাড়গুলি আকাশ ছুয়ে আছে। নিচ থেকে তাকালে মনে হবে ওইতো কাছেই দার্জিলিং শহর। কিন্তু আসলে অনেক দূরে।
পাহাড়ের উচু-নিচু এলাকা বিস্তৃত দার্জিলিং শহরটি অসমতল। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় শহরের বিল্ডিংগুলো যেনো থরে থরে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে।
শহরে অনেক বাঙ্গালি হোটেল ব্যাবসায়ী আছে, তবে নেপালীই বেশি। খাবারের হোটেলেও তেমনি। দুয়েকটি বাঙ্গালি বা বিহারী হোটেল বাদে বাকি সবই নেপালী।
দারজিলিং-এ ‘মোমো’ নামে পিঠার মতো এক প্রকার খাবার আইটেম খুবই প্রচলিত এবং স্থানীয়দের কাছে খুব জনপ্রিয়।
শহরের উঁচু এলাকায় চৌরাস্তা নামক জায়গাটিই শহরের মূল কেন্দ্র। সেখানে পর্যটকদের জন্যে বিলাসবহুল সব হোটেল আছে। তবে সমমানের একটু নিচু এলাকার হোটেলের ভাড়া তুলনামূলক কম।
‘রাতে বেশি ঘোরাঘুরি না করে আপাততঃ একটি হোটেলে উঠে গেলাম। কিন্তু হোটেলের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ভালো না লাগায় পরেরদিন সকালেই অন্য হোটেলে চলে যাই’।
‘নেপালী মহিলা মালিক ও তাদের মেয়দের
দ্বারা পরিচালিত হোটেলটি মোটামুটি মানের হলেও, ব্যবস্থাপনা ও আতীথেয়তা খুব ভালো লেগেছিলো। নতুন হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন শহরের কাছাকাছি এলাকা ঘুরে সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলাম, পরেরদিন ভোরে টাইগারহিলে সূর্যোদয় দেখাসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখতে যাবো’।
বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করাতে নিয়ে যায় এমন একটা জীপ গাড়ির ড্রাইভারকে আগেরদিন রাতেই বলে রাখা হয়েছিলো। জীপ ড্রাইভার বলে রাখা সব যাত্রীদের বিভিন্ন হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যায়। হোটেল কর্তৃপক্ষকে বললে তারাই ব্যবস্থা করে দেয়।
দার্জিলিং শহর থেকে টাইগারহিলের দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। উচ্চতা দার্জিলিং থেকে আরো এক হাজার ফুট বেশি অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫৯০ মিটার (৮৪৮২ ফুট) উপরে। এটাই দার্জিলিং এর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। দূরত্ব কম হলেও টাইগারহিল, ঘুম মনাস্ট্রী, জাপানিজ টেম্পল, গোর্খা সৈনিকদের স্মৃতিমূর্তি ইত্যাদি স্থানগুলো ঘুরে আসতে জীপভাড়া আসনপ্রতি ১২০-১৫০ রূপী লেগেছিলো।
সূর্যোদয় দেখতে অনেক ভোরে যেতে হয়। ভোর ৩.৪৫ টায় জীপের ড্রাইভার এসে হাজির। আমাদেরকে তুলে নিয়ে আরো দুই তিন হোটেল থেকে যাত্রী তুলে ভোর ৪.৩০ টায় টাইগারহিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
টাইগারহিলের চূড়ায় তিনতলা ভিউ টাওয়ার আছে। টিকেট বা কুপন সংগ্রহ করে টাওয়ারে প্রবেশ করতে হয়। ওই কূপনের বিনিময়েই টাওয়ারের ভিতরে চা-নাস্তারও ব্যবস্থা আছে। সেখানে বসে বা সাইডে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। টাওয়ারে লোকসংখ্যার আধিক্য হলে বাইরে দাড়িয়ে দেখার জন্যেও এলাকা নির্ধারিত আছে।
সূর্যোদয় শুরু হলে ভাসমান মেঘ কিংবা তুষারাচ্ছন্ন পাহাড়ের গায়ে যখন সূর্যের আলোকরশ্মি পড়ে তখন বিভিন্ন রকম রঙ্গের খেলা শুরু হয়ে যায়, যা না দেখলে অনুমান করা যায় না। এটাই এখানকার আকর্ষণ বলে মনে হলো। কারণ, সূর্যোদয় তো অনেক
যায়গা থেকেই দেখা যায়। প্রতিদিন শতশত দর্শক এখানে ‘সানরাইজ’ দেখতে আসে। টাইগারহিলের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা যায়। কিন্তু সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় দেখা যায়নি।
দার্জিলিং এর আবহাওয়া যে কোনো মুহূর্তে পরিবর্তণ হয়ে যেতে পারে। আকাশ ক্ষণে পরিস্কার, ক্ষণে মেঘ বা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়। কখনও মাথার উপর দিয়্ কখনও যেখানে অবস্থান করছেন তার নিচ দিয়ে মেঘেদের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার মতো।
সূর্যোদয় যখন দেখছিলাম, কিছুক্ষণের জন্যে আকাশ পরিস্কার দেখা গেলেও পর মুহূর্তে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সূর্যোদয় মুহূর্তের কয়েকটি ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে অতঃপর শেষ হলো দার্জিলিং টাইগারহিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় অবলোকন।
টাইগারহিল থেকে ফেরত আসার পথে জাপানিজ টেম্পল এবং গোর্খা সেনাদের স্মৃতিমূর্তি দেখতে গেলাম। মূর্তির কিছু ছবিও ধারণ করলাম ক্যামেরায়। জাপানিজ টেম্পলে দেখলাম যুবা-বৃদ্ধ বৌদ্ধভিক্ষুতে ঠাসা। দেখে মনে হলো সেখানে ভিক্ষু বা ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার একটি আশ্রম।
সকালের অভিযান শেষে বেলা দশটার মধ্যে দার্জিলিং শহ্ররে ফেরত চলে এলাম। ১০ সেপ্টেম্বর নেপাল থেকে ভারতে প্রবেশ করেছি। ট্র্যানজিট ভিসার মেয়াদ মাত্র ৭২ ঘন্টা। সে হিসেবে সেদিন ১২ তারিখেই ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। টাইগার হিল থেকে দার্জিলিং পৌঁছেই বুড়িমারী এসআর ট্র্যাভেলসের কাউন্টারে ফোন দিলাম। তারা বললো, ‘আজ সব টিকেট বুক হয়ে গেছে, আগামীকাল যেতে পারবেন’। তেমন ঘুরে দেখাও হলোনা। বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। বাসেরও টিকেট নেই। যা হয় হবে, আরেকদিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
নিলাম। অগত্যা ১৩ তারিখের বাসের টিকেট কনফার্ম করে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম।
দার্জিলিং চৌরাস্তায় অবস্থিত ভিউ পয়েন্ট থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। ভাগ্যক্রমে আকাশ যদি একটু পরিস্কার হয় এ আশা নিয়ে সেদিকে পা বাড়ালাম। শহরে ক্ষণে ক্ষণে তুষের মতো বৃষ্টি হচ্ছিলো। হেঁটে চৌরাস্তার দিকে যেতে হঠাৎ সেই কোরিয়ান মেয়েটির সাথে দেখা। আমাদের দেখে খুশিতে এগিয়ে এলো। বেলা তখন এগারোটা। সাজুগুজু করে ইন্ডিয়ান পোশাকে বেরিয়েছে। পাশের রেস্তোরাঁয় নাস্তা করে সাইটসিইং বা ঘুরতে বেরোবে। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে আমাদের গন্তব্যের দিকে এগুলাম। তবে কাকতালীয়ভাবে ওইদিন আরো দুইবার মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যায়। ………….........(চলব।।