গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৭)

 


নেপালের পোখরা শহরের যে এলাকায় উঠেছিলাম সে এলাকায় শুধুই আবাসিক হোটেল। জায়গায় জায়গায় মেসেজ পার্লার, ক্যাসিনো ইত্যাদি। শুনেছি ক্যাসিনোতে আগন্তক খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের জন্যে নাচ-গান হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, ভারতের কোলকাতা ও দার্জিলিং এবং নেপালের কাঠমুণ্ড ও পোখরাতে সবখানেই মেসেজ পার্লার নজরে পড়েছে। শুনেছি সেখানে নাকি মেয়ে কর্মচারী দ্বারা পুরুষ খদ্দেরদের বডি মেসেজের নামে হালকা যৌন সুরসুরি দিয়ে পকেট খসিয়ে নেয় এবং সুযোগ বুঝে জোর করে পকেট হাতিয়েও নেয়। তবে এ ব্যাপারে নিজের কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই।

 

গিয়েছিলাম অসময়ে অর্থাৎ ‘অফ সিজনে’ সেপ্টেম্বর মাসে। নেপালের আকাশ তখন মেঘাচ্ছন্ন। ক্ষণেক্ষণে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। হিমালয় দেখতে হলে শুস্ক মৌসুমে যেতে হয়।

 

পোখরা থেকে বাসে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে একটু কাছাকাছি গিয়ে হিমালয় দেখার ব্যবস্থা আছে। আর আছে এক প্রকার ইলেক্ট্রিক রাইড, যাতে ৪ বা ৮ জন করে গিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ঘুরে আসতে পারে। এ ছাড়াও ছোট ছোট বিমান বা হেলিকপ্টার আছে। তাতে গিয়েও কাছ থেকে হিমালয় দেখে আসার সুযোগ আছে। তবে শহর ভ্রমণ করার সময় দেখলাম বিমানগুলো ঘাটিতেই পরে থাকে। কেউ খুব একটা চড়েনা। লক্করঝক্কর বিমান, মাঝেমধ্যেই নাকি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ওঠা ও নামার ইলেক্ট্রিক রাইডের লাইন দুটি পাশাপাশি থাকায় সেটাও নাকি দোল খেয়ে আপ-ডাউন দুটি একসাথে সংঘর্ষ হয়ে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে।

 

মোট কথা, বিমান ও ইলেক্ট্রিক রাইড কোনোটারই সার্ভিস ভালো না বলেই জেনেছি। সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো বাসে গিয়ে দেখে আসা। কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্যে এবং আকাশ ভালো না হলে কিছু না দেখে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হবে, এসব ভেবে সেদিকে পা বাড়াইনি। হোটেল এটেন্ডেন্ট বললো, আকাশ পরিস্কার হলে এখান থেকেই হিমালয়ের চূড়া দেখতে পাবেন। সকালে যখনই আকাশ পরিস্কার হবে তখনই আপনাদেরকে ডেকে দেখাবো।

 

হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পোখরা শহর দেখতে বেরোলাম। সাদামাটা ছিমছাম শহর। তবে শহরের বিল্ডিংগুলো খুব মজবুত করে নির্মাণ করা। ভূমিকম্প থেকে রেহাই পেতেই নাকি এ ব্যাবস্থা। আমাদের হোটেলের পাশেই একটা লেক। লেকের পার দিয়ে পার্কের মতো। সেখানে দর্শনার্থীদের বসার বেঞ্চ আছে। লেকপার দিয়ে দেখলাম ফল, ফুচকা ইত্যাদি বিক্রেতাদের অধিকাংশ টঙ দোকানীই ভারতের বিহার প্রদেশের বাসিন্দা। কোলকাতাতেও দেখেছি নগরের অধিকাংশ ফুতপাত ব্যবসায়ী বিহার প্রদেশের বাসিন্দা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, বিহার প্রদেশ আগাগোড়াই দুর্ভিক্ষপ্রবন এলাকা।

 

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি, ১৯৪৭ সালে কোলকাতা থেকে বঙ্গবন্ধু বিহার প্রদেশে ত্রানকার্য পরিচালনা করতে গিয়েছিলেন। অথচ ৪৭ এ দেশ ভাগের সময় এদেশে কর্মরত যেসব বিহারী ‘অপশন’ দিয়ে এ দেশে থেকে গিয়েছিলো, উর্দুভাষী হওয়ার সুবাদে তারাই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলিয়ে বাংগালিদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পগুলোতে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের মধ্যে একটা বিরাট অংশই বিহার প্রদেশ থেকে আগত বিহারী।

 

যুগের পর যুগ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করা তাদের বেঈমানীর প্রতিফল স্বরূপ এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ কিনা তা একমাত্র প্রতিপালকই জানেন। যারা একটু সৎ এবং কষ্টার্জিত টাকা পয়সার মালিক ছিলো তাদের অনেকেই এ দেশে ব্যাবসা বানিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংগালিদের সাথে মিশে গেছে। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু নির্দোষ বিহারীদের প্রতি এমন আহ্বানই জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “তোমরা যারা এদেশে থাকতে চাও, বাঙ্গালি হয়েই থাকতে হবে”। পরে অবশ্য ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারাও কিছু কিছু অপকর্ম যে করেনি তা নয়।

 

লেকপারে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে বাসে উঠে মূল শহরে গিয়ে ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে রাত সাড়ে আটটা নয়টা বেজে গেলো। পোখরা শহরে আটটার পরপরই লোক সমাগম কমে যায়, সেটা আগে বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে পড়লাম এক মুশকিলে। হোটেল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেছি, ভুলবশতঃ হোটেলের ভিজিটিং কার্ড বা ফোন নম্বর নেইনি। হোটেল এলাকার জায়গার নামও জানিনে। একেবারে বোকা বনে গেলাম। অবশেষে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকের একটি বাসে উঠে বসলাম। বাসটি কিছুদূর গিয়ে এক পেট্রোল পাম্পে ঢুকে আর যাবেনা বলে জানিয়ে দিলো।

 

রাত ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, পথঘাটও চিনি না। অপরিচিত জায়গা, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছি। কিইবা জিজ্ঞেস করবো? কোথায় যাবো তাইতো জানিনে! এমনকি হোটেলের নাম পর্যন্ত মনে রাখিনি। অবশেষে এক ওষুধের দোকানে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। তাদের কাছে জানতে চাইছিলাম, টুরিষ্টরা যে এলাকায় থাকে সে এলাকার নাম কি? তারাও পড়লো মহা মুশকিলে। কারণ, টুরিষ্টতো শহরের বিভিন্ন এলাকায়ই থাকতে পারে।

 

এদের মধ্যে একজন ‘লেকপার’ কি না জিজ্ঞেস করলে ভাবলাম হয়তো হতে পারে। কারণ লেক যখন আছে, ওই এলাকার নামই হয়তো লেকপার। কিন্তু লেকপারতো অনেক বিস্তৃত এলাকা। হোটেলের নাম বলতে না পারায় তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছিলো না। শেষে বললাম, লেকপারে গেলেই আমি চিনে নিতে পারবো।

 

শহর নীরব হয়ে গেছে, এমন সময় ওষুধের দোকানের একটা লোক আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো। আমাদেরকে সাথে নিয়ে অদূরে রাস্তার অপরপাশে দাঁড়ানো একটি ট্যক্সির কাছে গেলো সে। মনে মনে ভাবছিলাম, লোকটা ইচ্ছে করে কোনো দুশ্চরিত্র ড্রাইভারের সাথে দিয়ে বিপদে ফেলতে চাইছেনাতো? ট্যক্সিওয়ালাও ট্যক্সির চাকার কাছে কি যেনো ঘুটঘাট করছিলো।

 

আমাদের ইতস্ত করা দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা লোকটি অভয় দিয়ে বললো, এই শহরে তোমার কোনো বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই। তার অভয় পেয়ে উঠলাম ট্যক্সিতে। কিন্তু বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ঘুরে ঘুরে ট্যাক্সি যখন যাচ্ছিলো মনে সন্দেহ দানা বাঁধছিলো। নিরুপায় হয়ে ট্যক্সিওয়ালার চরিত্র উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা হিসেবে তার সাথে আলাপ শুরু করে দিলাম।

 

ট্যক্সিওয়ালা নেপালী ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দী এমনকি বাংলা ভাষাও কিছু কিছু জানে। ভারতের মুম্বাই শহরে নাকি ছিলো। কোলকাতাতেও গিয়েছে। অনেকদিন ধরেই পোখরা শহরে ট্যাক্সি চালায়। এখানে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আসে। পর্যটকদের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে সব ভাষাই অল্প অল্প শিখে নিয়েছে বলে জানালো।

 

কৌশলে শহরের নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বুঝালো; এখানে যদি পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটে, বিদেশীরা যদি অনিরাপদ মনে করে, তাহলে লোকজন এদেশে কম আসবে এবং নেপালের পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেশের উপার্জন কমে যাবে। তাই নেপাল বিদেশীদের জন্যে একটি নিরাপদ দেশ। শুনে মনে মনে আশ্বস্ত বোধ করছিলাম।

 

গল্প করতে করতে এক সময় লেকপারে ঠিক আমাদের হোটেল এলাকায় এসে জায়গা চিনতে পারলাম। ট্যক্সিতে কোনো ভাড়া মিটিয়ে উঠিনি। ভেবেছিলাম বিপদগ্রস্থ হিসেবে গলাকেটেই ভাড়া দাবী করবে। যেটুকু পথ অতিক্রম করেছি তখনকার হিসেবে ২০০ টাকার বেশি ভাড়া হওয়ার কথা না। মনে মনে ভাবছিলাম, কম করে হলেও ৫০০ টাকা দাবী করতে পারে এবং সেটা দেয়ার জন্যেই প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু ড্রাইভারের সততা দেখে অবাক হতে হলো। বললো; দিন হলে কখনও ১৫০ টাকাও নেই। এখন রাত বিধায় তুমি ২০০ টাকা দাও। আমি খুশি হয়ে ৩০০ টাকা দিয়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে পাশের রেস্তোঁরা থেকে রাতের আহার সেরে হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

 

হোটেল পরিচারকের কথা অনুযায়ী আগেই তাকে অনুরোধ করে রেখেছিলাম, সকালে আকাশ পরিস্কার হলে যেনো আমাদেরকে ডেকে হিমালয় দেখায়।……………….........(চলবে)

 

 (২০১১ সালের ঘটনা। লেখা ২০৪ সালের)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url