গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১০)
‘হংকং
এয়ারপোর্টে ৩-৪ ঘন্টা অবস্থানকালীন কয়েকটা বিষয় নজরে এসেছিলো। কতো দেশ থেকে কতো মানুষ
যে ওই রুটে যাতায়াত করে তার শেষ নেই। তবে আমাদের দেশে মানব পাচারে নিয়োজিত গাইডনাম্নী
দালালদের দৌড়াত্য দেখে অবাক লাগলো’।
এক গাইড
১১ জন ‘মফিজ’ নিয়ে যাচ্ছে গ্রিসে। ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগ থেকেই তাদেরকে দেখছিলাম
একসাথে জটলা পাকিয়ে কথাবার্তা বলতে। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম যখন হংকং
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর সময় গেটে দায়িত্বরত অফিসারদের সাথে সেই গাইড তুমুল ঝগড়া করছে
তখন।
বাঙ্গালি
এয়ারপোর্টে ঝগড়া করছে দেখে এগিয়ে গেলাম। ১১ জন লোক নিয়ে গাইড যখন হংকং-এ ইন করতে চাচ্ছে,
হংকং ইমিগ্রেশন তাদেরকে ছাড়ছে না। বাঙ্গালি গাইড নাছোড়বান্দা। তার কথা হলো, তোমার দেশের
নিয়ম হচ্ছে পোর্ট এন্ট্রি ভিসা দেয়ার, তুমি দেবে না কেনো?
আমার
আবার নেশা হলো কোনকিছুর রহস্য ভেদ করে তা জানার। আস্তে আস্তে গাইডের সাথে আলাপ জমালাম
বিষয়টি জানার জন্য। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম তারা কোথায় কিভাবে যাবে।
‘তাদের
সিস্টেম হলো; প্রথমে হংকং ঢুকবে। হংকং থেকে চীনে ঢোকাও সহজ, পোর্ট এন্ট্রি সিস্টেম।
এভাবে দুদিন চীনে, দুদিন হংকং থাকবে। পূনরায় পোর্ট এন্ট্রি ভিসা সিস্টেমের অন্য কোনো
দেশে যাবে। সেখান থেকে আবার হংকং এসে এভাবে টুরিষ্ট হিসেবে পাসপোর্টের ভ্যালিডিটি বাড়িয়ে
তারপর কাঙ্ক্ষিত দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে’।
‘বাংলাদেশের
দালাল বা গাইডরা এসব বিষয়ে পারদর্শী। এভাবেই তারা মানব পাচারে নিয়োজিত আছে। যারা নতুন
তারা সিস্টেমটি জানেনা বিধায় যেতে পারেনা। অনেকে একবার যাওয়ার পর পরবর্তীতে নিজ অভিজ্ঞতাবলে
যেতে পারে’।
‘অনেক
লাগেজ ব্যাবসায়ীর সাথেও দেখা হলো। তারাও এভাবে ব্যাংকক, হংকং, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশে
এভাবে আসা-যাওয়া করে এবং সেইসাথে কিছু মালামাল আনা-নেয়া করে। অনেকে আবার হংকং-এ ৩ মাসের
পোর্ট এন্ট্রি ভিসা নিয়ে সেখানে কাজকর্ম করে। ৩ মাস পর সেখান থেকে ১/২ দিনের জন্যে
চীনে ঢুকে আবার হংকং-এ প্রবেশ করার সময় ৩ মাসের ভিসা নিয়ে পূনরায় অবস্থান করে কাজকর্ম
করে’।
ভোর
৩টা ৫৫ মিনিটের বিমান এবং তারও ২ ঘন্টা আগে বোর্ডিং পাশ নিতে হবে সেজন্যে নারায়ণগঞ্জ
থেকে অনেক আগেই বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়েছিলো। ফলে সারারাত ঘুমানোর সুযোগ
হয়নি।
ঢাকা
থেকে বিমানে হংকং যেতে ৩ ঘন্টা সময় লাগে। সে হিসেবে সকাল ৭টায় হংকং পৌঁছার কথা। হংকং
এর সময় ঢাকা থেকে দুইঘণ্টা যোগ করে সকাল ৯টায় হংকং পৌঁছার পরে এয়ারপোর্টের ওয়য়েটিং
স্পেসের একটি সোফায় একা বসে ঝিমুচ্ছি। ঘুমটা ভালোই লেগে এসেছিলো। এরমধ্যে কখন যে হংকং
ইমিগ্রেশন পুলিশের কালো ড্রেসের হাফপ্যান্ট পরিহিত সাদা চামড়ার এক যুবতি পুলিশ অফিসার
এসে আমার পাশে বসে আছে টেরও পাইনি। পাশে বসে এমন আলতোভাবে ডেকে আমাকে জাগালো, চোখ মেলতেই
মনে হলো স্বপ্ন দেখছিনাতো!
আসলে
আমাকে ওভাবে একা ঘুমিয়ে থাকতে দেখে পুলিশ অফিসার এসেছিলো আমি কোথায় যাবো, ফ্লাইট মিস
করি কিনা সেসব বিষয়ে আমাকে সাহায্য করতে। সে আমার পাসপোর্ট টিকেট চেক করে কোন গেট দিয়ে
যেতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
বাংলাদেশ
থেকে অন্য কোন যাত্রী ওইদিন ওই রুটে কোরিয়া গিয়েছে এমন কারো সাথে আমার দেখা হয়নি। পুলিশ
অফিসারটি আমাকে সাহায্য না করলে ঘুমিয়ে থেকে ফ্লাইট মিসও হয়ে যেতে পারতো।
হংকং
থেকে শিউল ৩ ঘন্টার বিমান জার্নি। পথে চীনের একটা প্রাদেশিক বড় এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিং
থাকায় সময় লাগে ৪ ঘন্টা। সেখানে অনেক সময় অবস্থান করে। হংকং থেকে শিউলের সময় আরো ১
ঘন্টা যোগ করে স্থনীয় সময় সন্ধ্যে ৬ টায় শিউল বিমানবন্দরে অবতরণ করি। সবাই ইমিগ্রেশন
ক্রস করছে। কিন্তু বিপত্তি বাধলো আমার সবুজ পাসপোর্ট। পরে জেনেছি বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট
দেখলে নাকি সব দেশেই অমন বিরম্বনার স্বীকার হতে হয় বাংলাদেশীদের।
শিউলে
যেহেতু পোর্ট এন্ট্রি ভিসা সিস্টেম, আমাকেও স্পটে ভিসা দিতে হবে ভেবে তারা পাসপোর্ট
খুলে না দেখেই শুধু সবুজ পাসপোর্টের কারণে আমাকে দাঁড় করিয়ে অন্যান্য যাত্রীদের প্রবেশ
করাচ্ছে। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভয় থাকলেও কৃত্তিম সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমাকে কেনো দাঁড় করিয়ে রেখেছো? আমারতো ভিসা আছে’। তখন পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে ভিসা আছে
দেখে নিজেরা নিজেরা বলাবলি করে জেরা করতে শুরু করলো, ‘কোথায় এসেছো, কেনো এসেছো ইত্যাদি।
ব্যাবসায়ীক প্রয়োজনে কোরিয়ার এক কোম্পানিতে গেছি জেনে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে রিসিভ
করতে কেউ এসেছে’?
কোরিয়ান
দূতাবাস থেকে ৩০ দিনের ভিসা দিয়েছিলো। ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় আমার বন্ধুসহ পরিচিত অনেকেই
অবস্থান করছিলো। তাই আমার প্লানই ছিলো আগে কয়েকদিন বন্ধুদের সাথে বেড়াবো তারপর কোম্পানিতে
দেখা করবো। তাই ইচ্ছে করেই কোরিয়ান কোম্পানির কাউকে আমার রিসিপসনের জন্যে আসতে বলিনি।
তারপরও আমি একটু বোকা সেজে বললাম, আমার কোম্পানি থেকে কোরিয়ান কোম্পানিকে জানিয়েছে
কিনা, কেউ রিসিভ করতে এসছে কিনা বলতে পারবোনা। প্রবেশ করলে বুঝতে পারবো। কিন্তু তাতেও
ফল হলোনা।
আমার
সাথে করে নেয়া ফাইলে কোরিয়ান কোম্পানি থেকে পাঠানো ইনভাইটেশন লেটার ছিলো এবং তাতে কোরিয়ান
চেম্বার অব কমার্সের অনুমোদন ছিলো। শেষ পর্যন্ত সেটা দেখালে তারা কোম্পানিতে ফোন করে
নিশ্চিত হয়ে অতঃপর আমার সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। ‘পরে বন্ধুদের কাছে জেনেছি, মাসখানেক
আগেই নাকি এক পাকিস্তানি নাগরিক স্বয়ং এয়ারপোর্টের মধ্যেই একজনকে “মার্ডার” করেছে এবং
সেকারণেও পোর্টে খুব কড়াকড়ি চলছে’। কোরিয়াতে অনেক পাকিস্তানি ছিলো তখন। শুনেছি,
ওরা যেখানেই যায় সেখানেই গোল পাকায়।
১৯৯২
সালে দক্ষিণ কোরিয়া্র শিউলে যাওয়ার আগে ১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলার কোলকাতা ছাড়া বিদেশী
কোনো বড় বা রাজধানী শহরে যাইনি। পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের লোকজন দেখতে একই রকম এবং
ভাষা, সংস্কৃতিও এক। ঢাকা থেকে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার দূরের শহর শিউলে পৌঁছে বুঝতে পারলাম
সত্যি বিদেশে এসেছি।
বাংলাদেশের
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তাদের দালালরা এয়ারপোর্ট
থেকে বেরোনো যাত্রীদের উপর যেভাবে হামলে পরে, পারলে জোর করে হাত থেকে লাগেজ ব্যাগ কেড়ে
নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এদের মধ্যে আবার দুশ্চরিত্র ট্যাক্সি ড্রাইভারও আছে যারা পথে
গিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেয় কিংবা গাড়ি থেকে ফেলে দেয় বা মেরেও ফেলে(এখন
অবশ্য তা কদাচিৎ)। কিন্তু শিউলের পরিবেশ দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন।
'এয়ারপোর্টের
বাইরে ট্যাক্সিক্যাবগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরাও একে একে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে।
যার সিরিয়ালে যে গাড়ি আসছে টপাটপ মালপত্র নিয়ে ওঠামাত্র মুহূর্তের মধ্যে ছেড়ে গিয়ে
আরেক গাড়ির জায়গা করে দিচ্ছে। গাড়িগুলো একটার পর একটা চলমান অবস্থায়ই থাকছে। কোনো ভাড়া
মিটানো বা অন্য কোনো বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ ভাড়া তো মিটারে'।
(২০১৪
সালের লেখা ..........(চলবে)