বিশ্বের মুসলিম নারী নেতৃবৃন্দ (পর্ব-৪)-আজারবাইজান
অধ্যাপক ড. লালা শেভকেত
অধ্যাপক ড. লালা শেভতেক |
পিতা মাতার পরিচয়ঃ
লালা শেভকেতের বাবা ‘শেভকেত বেই মুসলিম বেই ওকলু
খলিফাবেলি-হাজিয়েভ’ ১৯১২ সালে আজারবাইজানের কিউবা প্রদেশে এক সম্ভ্রান্ত
জমিদার এবং জনহীতাকাঙ্খী মুসলিম বেই খলিফাবেলির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শেবকেত
বেইয়ের মা ‘তুঘিয়া খানম’ ছিলেন ইমাম শামিলের বংশধর এবং তিনি ছিলেন তাবাসারানের
দাগেস্তানি খানের (রাজপুত্র) কন্যা। শেভকেত বেই বাকু'র স্টেট পেডাগজিক্যাল
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্ব এবং ইতিহাসে স্নাতক লাভ করেন। আজারবাইজান পিপলস
ফ্রীডম পার্টির (১৯৪০ সালে
কিউবা শহরে সৃষ্টি হয়) একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সাল
থেকে এই পার্টি তাদের কার্যক্রম চলিয়েছে ''মার্স'' (স্বাধীন আজারবাইজান
প্রজাতন্ত্র পার্টি) নামে। এর মূল লক্ষ্য ছিল আজারবাইজানকে কমিউনিস্ট ঔপনিবেশিকতা,
স্ট্যালিনিস্ট দাসত্ব থেকে মুক্ত করা এবং সর্বপরি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
শেভকেত বেই ১৯৮৩ সালের ২রা মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
মা সিদ্দীকা খানুম শিহালি বেই কিজি উসেয়োনোভা ১৯২০
সালে বাকু শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে (শিহালি বেই এবং হাজিখানুম উসেয়োনোভার
পরিবার) জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আজারবাইজান স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি
থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি এমএসসি ডিগ্রী নেন এবং বাকুর মেডিকেল
কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার চাচা ইউসুফ বেই, ইউনুস বেই এবং
রাহমান বেই উসেয়োনোভ রাসিয়ান সম্রাজ্যের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের
স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৩৭ সালে জাতীয় মুসাভাত পার্টির সদস্য হওয়ার পর তাদের
সবইকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি প্রদানের উদ্দ্যেশ্যে সাইবেরিয়া পাঠানো হয়।
এই ঘটনার পূর্বেই ১৯৩৩ সালে সিদ্দীকা খানম এর বাবা শিহালি বেই মারা যান। সিদ্দীকা
খানম ১৯৮৮ সালের ৮ই মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
লালা শেভকেত ১৯৬৮ সালে বাকুর ১৮৯তম মাধ্যমিক
বিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষে এন. নারিমানভ আজারবাইজান স্টেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হন এবং পেশাগত ফিজিশিয়ান হিসেবে যোগ্যতা লাভ করেন। সে সময়ই তাঁর প্রথম
বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা শুরু হয়। স্নাতক লাভের পর তিনি মস্কোতে যান এবং সেখানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন সেইসাথে
প্যাট্রিস লুমাম্ব আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত একাডেমিসিয়ান প্রফেসর
ভি.ভি. ভিনোগ্রাদোভ এর তত্ত্বাবধানে সার্জারির উপর মাস্টারস ডিগ্রী লাভ করেন।
২৫ বছর বয়সে তিনি এমএসসি
ডিগ্রী লাভ করেন এবং সে সময়কার ইউএসএসআর এর সবচেয়ে তরুণ এমএসসি ডিগ্রীধারী
হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৭৮ সাল থেকে লালা শেভকেত প্রাথমিক প্রতিবিধানের এন.ভি. স্ক্লিফোসোভস্কি
মস্কো সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর
হয়ে কাজ করছেন। লালা শেভকেত জুনিয়র রিসার্চ অফিসার থেকে প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক
এবং উক্ত বিভাগের প্রধান হতে বহু পথ অতিক্রম করেছেন।
৩৭ বছর বয়সে তিনি সফলভাবে
গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং ইউএসএসআর এর স্বাস্থ্য সেবার সংগঠন এবং নির্বাহী
পরিষদে সবচেয়ে তরুণ ডক্টর অব মেডিসিন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি রাশিয়ান
ফেডারেশনের স্বাস্থ্য সেবা মন্ত্রণালয়ের সায়েন্টিফিক সেন্টারের সংগঠন ও
ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তার গবেষণা ইউএসএসআর স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নে ব্যাপক
ভূমিকা রাখে এবং বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
তিনি একশটিরও বেশি বৈজ্ঞানিক
প্রকাশনা সম্পন্ন করেন। তিনি প্রফেসর উপাধি লাভ করেন। ১৯৯১ সালে লালা শেভকেত
আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ান প্রধানমন্ত্রী এন. সিলায়েভ কর্তৃক রাষ্ট্রের সামাজিক
প্রগতি এবং নীতি নিয়ে কাজ করার জন্য তালিকাভুক্ত হন।
লালা শেভকেত রাশিয়ান
ফেডারেশন সুপ্রীম সোভিয়েতের সেবা আইন কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও
তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক সামাজিক-স্বাস্থ্য সংগঠন এবং স্বাস্থ্য সেবা সংগঠনের
সহ-সভাপতি এবং প্রসিডিয়াম অব ইন্টারন্যাশনাল ইকো-ফিলোসোফিক ফান্ডের সদস্য। তাকে
সম্মানসূচক পিএইচডি প্রদান করা হয়।
লালা শেভকেতের একজন ছেলে
আছে।
১৯৮০ এর শেষ দিকে কোরাবাগের বাজে
পরিস্থিতি এবং ''পেরেস্ত্রোইকা'' ইপক (নবযুগের সূচনা) তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে
ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে তাকে। এর ভিত্তি ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক
আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতাদের সহযোগিতা লাভ করে।
১৯৯০ সালের "রক্তাক্ত
জানুয়ারি"র ঘটনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং একে তাঁর
রাজনৈতিক জীবনের ‘ডিটোনেটর’ (গ্রেনেড বা বো্মার যে অংশটি বিস্ফোরণের নিয়ন্ত্রক বা
চাবি বলা হয়) বলা যায়। সমগ্র পৃথিবী বাকুর শান্তিপ্রিয় জনতার বিরুদ্ধে সোভিয়েত
আর্মির বর্বরীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে পেয়েছিল। এর কারণ ছিল ২০ এবং ২১
জানুয়ারি মস্কোতে লালা শেভকেত কর্তৃক আহ্বায়িত এক প্রেস-কনফারেন্স। সেই সময়ই
প্রজাতন্ত্র ইনফরমেশন ব্লকেডের ঘূর্নিপাকে পড়ে গিয়েছিল। আমেরিকান ইনফরমেশন
এজেন্সি এনবিসি এই প্রেস কনফারেন্সকে "আজারবাইজানের মানুষের আত্ম-সচেতনতা
বৃদ্ধির ঐতিহাসিক মুহূর্ত" বলে আখ্যায়িত করে।
১৯৯১ সালে এডোয়ার্ড
শেভার্দনাজ, আলেক্সান্ডার ইয়াকোভ্লেভ, সবচাক, পপভ, ব্রাযোস্কাস এবং অন্যান্য
সাম্যবাদী নেতাদের সাথে লালা শেভকেত ইউএসএসআর-এ গণতন্ত্র
পুনঃপ্রতিষ্ঠা আন্দোলন শুরু করেন। একই বছরে তিনি আজারবাইজানের গনতন্ত্র
পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক
সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন যা সোভিয়েত সরকার দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে
স্বীকৃত হয় এবং এটি প্রথম জাতীয় প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এই সংগঠনটি আজারবাইজান, সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এবং
পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৯৩ সালের জুন মাসে, লালা
শেভকেত বাকুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হেইদার আলিয়েভ দ্বারা আমন্ত্রিত হন এবং ৭ই জুন
তারিখে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে লালা
শেভকেত সরকারের দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে রাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে
পদত্যাগ করেন। নৈতিকতার কারণে এরকম একটি উচ্চ পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার
ঘটনা আজারবাইজানে এক অনন্য নজির হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে লালা
শেভকেত পূর্ণ ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রদূত পদ লাভ করেন এবং তিনিই আজারবাইজানের ইতিহাসে
প্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত। জাতিসংঘের দূত হিসেবে নিযুক্ত হয়ে ৮ মাসের নিউইয়র্ক সফরে যাওয়ার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান
করেন। কারণ সেখানকার নীতি তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলোনা এবং এভাবে তিনি আরেকটি নজির
স্থাপন করেন।
১৯৯৫ সালে লালা শেভকেত
আজারবাইজান লিবারেল পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৫ সালের ৩রা জুন নির্বাচকমন্ডলীর
সদস্য সভার নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। এভাবেই তিনি আধুনিক আজারবাইজানে উদারপন্থী
ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আজারবাইজানি
ভাষায় উদারপন্থী তত্ত্বের উপর প্রথম বই
প্রকাশিত হয়।
এএলপি (আজারবাইজান লিবারেল
পার্টি)'র নেত্রী তার সঙ্গীদেরকে ডাকলো উক্ত স্লোগান সামর্থনের জন্য "সভ্য
আজারবাইজানের আইন এবং মানুষের পরিশ্রম দ্বারা সভ্য সমাজ, দেশ এবং সার্বভৌমত্ব
প্রতিষ্ঠা।"
১৯৯৮ সালে লালা শেভকেত
পাঁচজন সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের একজন ছিলেন যারা উক্ত নির্বাচন বয়কট
করেছিলেন।
২০০৩ সালের ৭ই জানুয়ারিতে,
লিবারেল পার্টির বৈঠকে লালা শেভকেত উক্ত পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ তিনি
স্বাধীন রাষ্ট্রপতি পদপার্থী প্রচারণা করতে চেয়েছিলেন। এভাবে তিনি আজারবাইজানের
রাজনৈতিক ঐতিহ্যে আরেকটি নজির তৈরি করেন।
আজারবাইজান জাতীয়তাবাদ
আন্দোলন এবং লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে লালা শেভকেত ২০০৫ সালে সংসদীয় নির্বাচনে
লিবারেল পার্টির ৭০ জন পদপার্থীর প্রধান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। লালা শেভকেত তাঁর
নির্বাচকমন্ডলী দ্বারা সফলভাবে জয়লাভ করেন যা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন দ্বারা
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন বিকৃত বিবৃতির কারণে বা যেভাবেই হোক, ১১ জন লিবারেল
পার্টির পদপ্রার্থী আনুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃত হয়নি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এবং
আদালত এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি এবং তাদেরকে অকারণে প্রত্যাখ্যানও করেনি। একই
সময়ে উক্ত কর্তৃপক্ষ লিবারেল পার্টির প্রায় ৫০ জন পদপার্থীর বিজয়কে প্রত্যাখ্যান
করেছিল।
লালা শেভকেত তার নির্বাচনী
প্রচারণা শুরুর সময় বলেছিলেন: "আমি কোনো সংসদের আসনের জন্য লড়ছি না বরং আমি
আমার জাতির জন্য লড়ছি”। নির্বাচনের পর তিনি তাদেরকে মানুষের ইচ্ছা বিরোধী চরম
অবিচারী এবং আক্রমণকরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জনতা এবং তাঁর মিত্রদের কাছে
দেয়া কথা অনুযায়ী তিনি আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংসদ থেকে
আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন।
২০০৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে
"আজাদলিক" রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত গোষ্ঠী তিনটি প্রধান
বিরোধী দলের সমন্বয়ে গড়ে উঠে- আজারবাইজান লিবারেল পার্টি, পপুলার ফ্রন্ট পার্টি
এবং সিটিজেন ও ডেভলপমেন্ট পার্টি। এর অস্তিত্বকালীন সময় এই গোষ্ঠীটি নিজেকে
গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর সংগ্রাম করে।
২০০৮ সালে লালা শেভকেত
অন্যান্য বিরোধী নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং স্বাধীন
মত প্রকাশের অভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বয়কট করেন। নির্বাচনের সুষ্ঠুতা এবং
স্বাধীনতার জন্য নূন্যতম দাবির
অভাব ছিল।
২০১০ সালে জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের আগে "আজাদলিক" রাজনৈতিক গোষ্ঠী, পপুলার ফ্রন্ট পার্টি
মুসাভাত পার্টির সাথে যোগদানের দরুণ বিযুক্ত হয়ে যায়। আজারবাইজান লিবারেল পার্টি
বিযুক্ত "আজাদলিক" গোষ্ঠীর অন্যান্য দলসমূহ যেমন সিটিজেন ও ডেভ্লপমেন্ট
পার্টি, গ্রীন পার্টি এবং ইন্টেলিজেনশিয়ার আন্দোলন নিয়ে সংসদীয় নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করে। যেভাবেই হোক, পুরো নির্বাচনই ছিল নামেমাত্র নির্বাচন এবং বিরোধী
দলের একজন সদস্যও সংসদে প্রবেশ করতে পারেনি।
বর্তমানে অধ্যাপক ড. লালা
আজারবাইজান লিবারেল পার্টির রাষ্ট্রপতি পদপার্থীদের নেতা।