গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৪)

 



১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় পর্যন্ত আমাদের দেশে মোটা ইরি চাউলের দাম ছিলো প্রতি কেজি ০৬ টাকা। আমি যখন কোরিয়া যাই অর্থাৎ ১৯৯২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তা বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রতি কেজি ১২ টাকায় পৌঁছে। কোরিয়াতে গিয়ে দেখলাম সে দেশে সর্বনিম্ন চাউলের দাম ৪৫ টাকা প্রতি কেজি। ভাবলাম যে দেশে আয় রোজগার বেশি সে দেশে কি সব জিনিষেরই দাম বেশি! তবে মুরগির ডিমের দাম বাংলাদেশের মতোই ছিলো। প্রতিটি বাংলাদশী টাকায় ৫ টাকা।

 

কোরিয়াতে গিয়েই প্রথম ব্রয়লার মুরগির সাথে পরিচয় ঘটে। এর আগে কখনও ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া দূরের কথা, দেখেছি বলেও মনে পড়ে না।

 

কোরিয়ান এবং চাইনিজরা বাঁশের বা স্টীলের তৈরি দু’টি কাঠি দিয়ে এক অভিনব কায়দায় কাঠি দু’টি ধরে সবকিছু খাওয়াদাওয়া করে। ভাতও কাঠি দিয়ে তুলে খায় যা আমাদের কাছে একেবারেই অসম্ভব। হাত দিয়ে কিছু খাওয়া দেখলে ঘৃণা করে। ওরা ভাতের চেয়ে তরিতরকারি, শাক-সবজি খায় বেশি। দেখতে ‘কুঁচে’র ম্তো লম্বা এক প্রকার সামুদ্রিক মাছ খেতে দেখতাম। কিন্তু মাছগুলো এতো নরম যে কাঁচা থাকতেই গন্ধ লাগতো। রান্না করলে গন্ধে তার কাছেই যাওয়া যেতোনা।

 

এমনিতেই কোরিয়ায় গিয়ে খাওয়া দাওয়ায় অরুচি হয়। ওসব দেখে মাছের উপর থেকে রুচি একদম উঠে যায়। তবে চাঁপলে মাছের মতো দেখতে বড় একপ্রকার মাছ পাওয়া যেতো। মাঝেমধ্যে সেটা এনে খেতাম। প্রায় ইলিশের মতো স্বাদ লাগতো। তবে প্রতিদিন এ বেলা ও বেলা মুরগির মাংশ ও ডিমই ছিলো বিশেষ ও প্রধান আইটেম এবং বেশি ভরসার খাবার। যাতে তেমন কোনো ভেজাল ছিলোনা বলে ধরে নিতাম।

 

কোরিয়ানরা খাওয়ার সময় খুব আপ্যায়ন করতো। না খেলে খুব অসন্তোষ প্রকাশ করতো। আমি কোনোমতে কাটিয়ে নিজেকে রক্ষা করতাম। একদিন পড়ে গেলাম বিপাকে। দিনটি ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কোরিয়ানরা সাধারণতঃ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজেদের মধ্যে এক প্রকার পার্টির আয়োজন করতো এবং তা বেশিরভাগই ডিনার টাইমে। কারণ তারা মালিক কর্তৃক নির্ধারিত একটি রেষ্টুরেন্টে আহারাদী সম্পাদন করতো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে রেষ্টূরেন্টও বন্ধ থাকতো। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের আহার যে যার মতো সেরে নিতো। কারণ, দিনে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতো তারা। রাতের আহারটা প্রতিষ্ঠানের কিচেনে নিজেরাই রান্না করে সবাই মিলে একত্রে খেতো এবং তা বেশিরভাগ সময়ই থাকতো সহজ প্রক্রিয়ায় রন্ধনযোগ্য খাদ্যসামগ্রী। মাঝেমধ্যে স্পেশাল কিছু করতো।

 

সেদিন কিচেনে ঢুকেছি। দেখি, পিঠার মতো দেখতে ওরা সবাই মিলে কি যেনো খাচ্ছে। যেহেতু ওদের ডিনার পার্টি, তাই আমাকেও আমন্ত্রণ জানালো তাদের সাথে যোগ দিতে। কয়েকবার না বলাতে একটু রেগে গেলো। অবশেষে চাউলের পিঠার মতো সাদা দেখে অনিচ্ছাস্বত্বেও হাতে নিয়ে খেতে গিয়ে দেখি সেটা অন্যকিছু। স্বাদও অন্যরকম এবং আমার অচেনা। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। না খেলেও বিপদ! না জানি মাইরই দিয়ে বসে!

 

‘কোরিয়াতে বাংলাদেশিদের জন্য বেশি সমস্যা ছিলো দুটি। আগেই বলেছি, কোরিয়ানরা ইংরেজিতে খুব কাঁচা। এমন অনেকে আছে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত শব্দ বা যন্ত্র ‘টেলিফোন’ যার আমাদের দেশে ভালো কোনো শ্রুতিমধুর বাংলা প্রতিশব্দ প্রচলিত নেই, সেই টেলিফোনকে তাদের দেশীয় ভাষায় ‘চনা’ না বললে তারা চিনতো না। কথা না বোঝার কারণে এবং ওদের খাদ্যদ্রব্য ঘৃণা করে খাচ্ছেনা এটা বুঝতে পারলে অনেক সময় অনেককে মাইর পর্যন্ত দিতো। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো ছিলো। আমার মালিক, মালিকের হাসব্যান্ড এবং অন্য দু’জন কর্মী যারা কন্টেইনার হাউজে থাকতো, উভয়েরই যে কোন কারণেই হোক শ্রেণীপাঠের বাইরে আলাদাভাবে ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষণ নেয়া ছিলো। সে কারণে তাদের সাথে চলতে আমার তেমন অসুবিধায় পড়তে হয়নি’।

 

পিঠার মতো দেখতে বস্তুটি এক কামড় খেয়ে যখন দেখলাম সেটা পিঠা না, তখন আমার সাথে যে লোকটির ভালো বোঝাপড়া ছিলো তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? বললো মাছ। কিন্তু তাতেও আমার সন্দেহ যাচ্ছেনা, বারবার জিজ্ঞেস করছি। সেও বোঝাতে পারছে না। অবশেষে একটা প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিলো। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে দেখি তার উপরে লেখা আছে ‘Crab’s Claw Muscle’। দুঃখের বিষয় ওই সময় কাঁকড়ার ইংরেজি জানতাম না। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে কাঁকড়ার ছবি দেখে বুঝলাম। পরে ইংলিশ টু ইংলিশ ডিকশনারী দেখে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ওগুলো কাকড়ারই পেশী ছিলো।

 

কাঁকড়া যদিও আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমান অনেকেই খায়। এটা খেতে মুসলমানদের ধর্মীয় কোনো বিধিনিষেধও নেই। কিন্তু আমি কোনোদিন খাইনি। তাছাড়া তেমন স্বাদও লাগছিলোনা তাই সাথে সাথে খাওয়া বন্ধ করে মুখের গুলোও ফেলে দিলাম। কোরিয়ানরা দেখে একটু বিব্রত এবং কিছুটা রাগান্বিত হলো এবং বললো, ওটাতো মাছ তুমি খেলে না কেনো? 'সব মাছ আমি খাইনা' বলে কোনোমতে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলাম। এরপর অবশ্য তারা আমাকে আর খেতে আপ্যায়ন করতো না।

 

কোরিয়াতে নিজে রান্না করে খেতেও অনেক সমস্যা পোহাতে হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত প্যাকেট করা দারুচিনির গুঁড়া ছাড়া কোনো মশলা এমনকি জিরাও পাওয়া যেতোনা। শুধু দারুচিনির গুঁড়া দিয়েই মুরগি রান্না করে খেতে হতো। হলুদ’তো সে দেশের মানুষের কাছে ‘অষ্টম আশ্চর্য’!

 

একদিন বাজারে গেছি। বাজারের প্রবেশমুখে রাস্তায় ভিড় দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম এক লোক কিছু আস্ত হলুদ একটা পলিথিনের উপর রেখে সেটা কিভাবে ছেঁচে তরকারিতে খেতে হয় তা আমাদের দেশের ক্যানভাসারদের মতো মহিলাদেরকে বোঝাচ্ছে। ‘ও দেশে মহিলারাই বাজার করে’। মহিলারা তন্ময় হয়ে শুনছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে ভা্লো করে বুঝে নিচ্ছে। আমিও তার কাছ থেকে কিছু হলুদ কিনবো বলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার লেকচার শুনছিলাম। লেকচার শেষ হলে অনেকেই কিনে নিচ্ছে। ভিড় কিছুটা কমলে আমিও কেনার আগ্রহে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, মাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম পরিমানের আস্ত হলুদ এনভেলপে ভরে 5000won অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ২৫০ টাকা করে বিক্রি করছে। অথচ আমাদের দেশে তখন ২০ টাকা কেজি হলুদ। সেটা দেখে আমার হলুদের স্বাদ মজে গেলো।

 

বাংলাদেশিরা নিরুপায় হয়ে দেশ থেকে পার্সেল করে মশলা নিয়ে যেতো। একদিন এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে গিয়ে সেটা জানতে পারলাম এবং সেই বন্ধু আমাকে কিছু হলুদের গুঁড়া, জিরা, এলাচি, লবঙ্গ, তেজপাতা ইত্যাদি দিয়ে দিলো। সেগুলো এনে কিচেনের শোকেস/আলমারিতে রেখেছি। একদিন দেখি তেজপাতাগুলো উধাও! সবার কাছে জিজ্ঞেস করি, কেউ বলতে পারেনা। দু’য়েকদিন পরে জানা গেলো, এক বৃদ্ধ নিরাপত্তারক্ষী-কাম-ক্লিনার কিচেন রুম পরিস্কার করার সময় আবর্জনা(!) মনে করে সেগুলো ফেলে দিয়েছে।

 

আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত মিল/গার্মেন্টস মালিকরা সরকারি ‘ইনসেন্টিভ’ তো দূরের কথা বিদেশি ক্রেতাদের অনুদানের টাকা থেকেও দু’পয়সা শ্রমিকদের দেয়না। ওয়েস্টেজ কার্টুন বিক্রির টাকাও কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে বুঝে নেয়। অথচ কোরিয়াতে ছোট্ট একটি নীটিং ফ্যাক্টরির কার্টুন বিক্রির টাকা শ্রমিকদের ভোগ করতে দেখেছি।

 

বিষয়টা আমি জানতাম না। বাথরুমের সাবান, পেষ্ট, ওয়াসিং পাউডার ইত্যাদি নিজে কিনে ব্যাবহার করতাম এবং ব্যবহার শেষে নিজের রুমে এনে রাখতাম। একদিন এক কোরিয়ান সহকর্মী বললো, ‘তুমি ওগুলো নিজের পয়সায় কিনে ব্যবহার করো কেনো? ওগুলোসহ কফি, সফট ড্রিঙ্কস সব আমরা কার্টুন বিক্রির টাকা দিয়ে কিনি। তুমিও সেটাই ব্যবহার করবে।

 

‘টিনশেড ফ্যাক্টরির পাশে একতলা বিল্ডিং’এর নিচে গোডাউন। তার ছাদে জাহাজের মালটানা কন্টেইনারের মতো দেখতে একপ্রকার কৃত্রিম ঘরে আমরা থাকতাম। সে দেশে সেটাকে বলেও ‘কন্টেইনার হাউজ’। আমি বিদেশি হিসেবে পৃথক রুমে একাই থাকতাম’।  

 

রুমের ফ্লোর শক্ত ফোম দিয়ে তৈরি। শীত নিবারণের জন্যে কোরিয়ার তৈরি উন্নতমানের কম্বল ছাড়াও বিছানায় ছিলো ইলেকট্রিক ম্যাট্রেস। রাতে বেশি শীত লাগলে ম্যাট্রেসের সুইচ অন করে ঘুমিয়ে থাকতাম। মাঝরাতে শরীরসহ শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত শুকিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। পরে সুইচ অফ করে ঘুমাতাম। শীত লাগলে আবার সুইচ অন করতাম। রাতে দুই তিনবার এ কাজটি করতে হতো।

 

শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় একদিন দেখতে পেলাম ফ্লোরের ফোম কেটে বিছানার নিচে হিটারের কয়েলের মতো পেঁচিয়ে পানির পাইপ বসানো হচ্ছে। কিচেনে রাখা ইলেক্ট্রিক বয়লার থেকে সেই পাইপে গরম পানি সরবরাহ করা হতো বিছানা গরম রাখার জন্যে। তারপর থেকে আর ইলেক্ট্রিক ম্যাট্রেসের হিটার চালানোর প্রয়োজন হতোনা। গলা বুকও শুকিয়ে যেতোনা। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম।.........(চলবে)

(২০১৪ সালের লেখা)

 

 

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url