গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২৬)
‘নেপাল থেকে আজকাল অনেক
ছাত্র বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজসমূহে পড়াশুনা করতে আসে। নেপালের
পোখরা থেকে দার্জিলিং আসার পথে এবং দার্জিলিং বেড়িয়ে দেশে আসার পথে বাংলাদেশে আসছে
এমন কয়েকজন নেপালী ছাত্রের সাথে আলাপ করে ব্যাপারটা জানতে পারলাম। তাদের কেউ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কেউ ময়মনসিংহ মেডিকেল
কলেজ এবং কেউ কেউ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ না পেয়ে উত্তরা এলাকায় বেসরকারি
মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে’।
কাঠমুণ্ড শহর ঘুরে
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে সময় নষ্ট না করে হিমালয় শহর পোখরাতে চলে যাবো।
চেংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি পর্য্ন্ত একসাথে গাড়িতে যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জের
গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী বন্ধুটি বলে দিয়েছিলেন; ‘পোখরা যেতে কিন্তু ভুলবেন না।
কাঠমুণ্ড নেপালের রাজধানী হলেও পোখরা না গেলে নেপাল বেড়ানো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে’।
রাতেই পোখরা যাওয়ার গাড়ি ছাড়ার স্থান ও সময় জেনে হোটেলে ফেরত গেলাম।
‘কাকরভিটার ভলভো বাসের
মতো টুরিষ্ট বাসেরও নামের সাথে মিল দেখতে পেলাম। বাসের গায়ে যেমন লেখা ‘টুরিষ্ট
বাস’ কাজেও তাই। কাঠমুণ্ড থেকে টুরিষ্ট বহন করে পোখরা যাওয়াই তাদের কাজ। তবে
স্থানীয়রাও যে যায় না, তা নয়। সবাই যাতায়াত করে’।
‘নেপালের ট্যাক্সি
ড্রাইভারদের মধ্যে বেশ সততা লক্ষ্য করেছি। সকাল ০৬.৩০ থেকে ০৮.০০ ঘটিকার মধ্যে
প্রায় সব টুরিষ্ট বাস কাঠমুণ্ড থেকে পোখরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। হোটেল প্রাঙ্গণ
থেকেই এক ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে রেখেছিলাম টুরিষ্ট বাস যেখান থেকে ছেড়ে যায় সকালে
সেখানে পৌঁছে দিতে। সকালে তার ট্যাক্সিতে যেতে হালকা বৃষ্টির কারণে পথে সামান্য
জ্যাম থাকায় টুরিষ্টদের যেখান থেকে বাসে ওঠায় সেখানে গিয়ে দেখা গেলো কোনো বাস নেই।
ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাড়া নিয়ে আমাদের নামিয়ে দিয়েও যখন জানতে পারলো বাস ছেড়ে চলে
গেছে তখন পূনরায় আমাদেরকে ডেকে ট্যাক্সিতে তুলে বাসের মূল স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিলো।
কারণ, সে জানতো যে, বাসটি টুরিষ্ট এলাকা থেকে ছেড়ে গেলেও তার মূল স্ট্যান্ড থেকে
ছাড়তে আরো দেরি আছে। সেজন্যে সে কোনো অতিরিক্ত ভাড়া দাবী করলো না। পোখরাতেও এমন
একজন ড্রাইভারের সহযোগীতা পেয়েছিলাম, যার কথা ঘটনাক্রমে পরে আসবে’।
‘টুরিষ্ট বাস:
উন্নতমানের মিনিবাস দিয়ে টুরিষ্ট বাস হিসেবে সার্ভিস দেয়া হয়। কাকরভিটা থেকে
কাঠমুণ্ড ৫০০ কিঃমিঃ রাস্তার ভাড়া যেখানে ৭০০ টাকা সেখানে টুরিষ্টদের বহন করার
কারণেই মনেহয় কাঠমুণ্ড থেকে পোখরা ২০৩ কিঃমিঃ রাস্তার ভাড়া ৭০০ টাকা। আরেকটু
বিলাসী ভ্রমণ করতে চাইলে জীপ বা মাইক্রোবাসে। তার ভাড়া ১২০০ টাকা। অন্য আরো শীতাতপ
নিয়ন্ত্রিত বাস আছে যেগুলো সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানতে পারিনি। তবে আমরা নিরাপত্তার
কারণে অধিক যাত্রী যেটাতে যায় সেই মিনিবাসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম’।
‘ছেড়ে যাবে যাবে এমন
সময় গিয়ে বাসে ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাসটি ছেড়ে দিলো। পথে যেতে যেতে পাহাড়,
পাহাড়ী ঝরণা, পাহাড়ে কৃষি আবাদ ইত্যাদি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। পাহাড় বেয়ে গাড়ি
ওঠানামা, হিমালয় থেকে নেমে আসা পানি তীব্রবেগে নদীর স্রোতের চেয়েও অধিক বেগে ছুটে
যাওয়ার দৃশ্য দেখলে অবাক কান্ড বলে মনে হয়। দিনের বাসে পোখরা না গেলে সে দৃশ্য
দেখার সৌভাগ্য হতোনা। বাংলাদেশে অমন দৃশ্য কল্পনাও করা যায়না’।
‘কাঠমুণ্ড থেকে পোখরা যাওয়ার পথে মাঝে দুপুরের আহারের বিরতি এবং এক বা দুই জায়গায় চা বিরতি দিয়েছিলো। অনেক সকালে গাড়িতে ওঠার কারণে ভালমতো নাস্তা করতে পারিনি, তাই ক্ষুদাও লেগেছিলো বেশ। যে হোটেলে আহার করতে নামলাম সেটি মনেহয় ছিলো নিরামিষ হোটেল’।
‘দুই তিন রকমের নিরামিষ তরকারি, যে যেটা খায়। বাসমতী চালের পর্যাপ্ত ভাতসহ প্রত্যেকটারই দাম ১৫০ টাকা । হোটেলের সিস্টেম দেখে এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বাস থেকে নেমে সবাই লাইন ধরেছে। ক্যাশ কাউন্টারে ১৫০ টাকা জমা দিয়ে টেবিল থেকে প্লেট নিয়ে লাইন এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর নিজহাতে ভাত এবং পছন্দ অনুযায়ী তরকারি নিয়ে টেবিলে বসে ভক্ষণ। তবে পরবর্তীতে কিছু লাগলে তা হোটেল পরিচারক বা ওয়েটাররা পরিবেশন করে’।
‘পোখরা যাওয়ার সময় আন্দাজ করতে পারলাম এবং পরে পোখরা গিয়ে লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছি; সেদেশে কৃত্রিম পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়না। পাহাড়ি ঝরণা থেকে সরাসরি পাইপ লাইনের সাহায্যে সর্বত্র পানি সরবরাহ করা হয়। পাহাড়ি ঝরণা বা নদীর মতো বড় বড় জলস্রোত দেখে মনে হয়েছে, এতো পানি আসে কোত্থেক ! এর কোন শেষ নেই? নিশ্চয়ই পৃথিবী সৃষ্টির
পর থেকেই সে পানি শুধুই ছুটে চলছে, চলছে তো চলছেই’!
‘পোখরা হোটেলে ওঠার সময় এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। টুরিষ্ট বাসে সিটের অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু মাঝপথে দুপুরের আহারের পরে বাস ড্রাইভারের বৌদি পরিচয়ে অল্প বয়সী শিক্ষিত এক মহিলা ওঠে। সিট না থাকায় তাকে বাসের সামনের দিকে একটি টুল বা মোড়ায় বসতে দেয়া হয়। কাঠমুণ্ড থেকে সর্বশেষে বাসে ওঠার কা্রণে আমাদের বসতে হয়েছিলো সামনে ড্রাইভারের বাম পাশে চার সিটের লম্বা মহিলা সিটে। তিনজন মহিলা আমি একা পুরুষ। আমি আমার স্ত্রী’র পাশে প্রথম সিটে বসেছিলাম। পথিমধ্যে অন্য মহিলা দু’জন নেমে গেলে আমি একটু সোজা হয়ে হেলান দিয়ে বসার সুযোগ পেলাম। কিন্তু ওই মহিলা ড্রাইভারের মাধ্যমে অনুরোধ করছে প্রথম সিটটা ছেড়ে আমাকে সামনের দিকে গিয়ে বসতে। তার নাকি অতো সামনে গিয়ে বসলে মাথা ঘুরায়। এ রোগটা আমারও ছিলো। আমি কখনও অমন আড়াআড়ি সিটে বসতে পারিনে। নিতান্ত বাধ্য হয়ে বসতে হয়েছিল। এমনিতেও দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত, তাই বারবার অনুরোধ করা সত্বেও রাজী না হওয়ায় মহিলাকে মোড়ায় বসেই সারা পথ যেতে হলো, তবু সামনে গিয়ে বসলোনা’।
পোখরা পৌঁছে বাস ড্রাইভারের কাছে হোটেলের তথ্য জানতে চাইলে ওই মহিলাকে দেখিয়ে বললো; বৌদির সাথে যান, দেখিয়ে দেবে। আমি একটু ইতস্ত করায় মহিলা খুব বিনয়ের সাথে তাকে অনুসরণ করতে অনুরোধ করলো। তার সাথে গিয়ে যে হোটেলে উঠলাম, পরে দেখা গেলো সে নিজেই ওই হোটেলের মালিক। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই শিক্ষিত। আলাপচারিতায় জানা গেলো, বছর পাঁচেক বয়সের এক ছেলে আছে তাদের। যেখান থেকে বাসে উঠেছিলো সেখানে গ্রামের বাড়ি। পোখরাতে আবাসিক হোটেলের ব্যবসা। দু’জন সম্মিলিতভাবে হোটেলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে এবং পালা করে কাউন্টারে বসে।
পোখরার হোটেলে আমাদের সাহায্যকারী হিসেবে যে নিয়োজিত ছিলো সে ছেলেটিও গ্রাজুয়েট এবং খুবই ভদ্র নম্র স্বভাবের। সে হোটেলে চাকরি ছাড়াও সুযোগ পেলে ‘শেরপা’র দায়িত্ব পালন করে। দু’বার নাকি হিমালয়ের চূড়া থেকে ঘুরে এসেছে।
‘শেরপা তিব্বত থেকে মাইগ্রেট করে নেপালে পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাসরত একটি জাতিগত গোষ্ঠী। শক্তিশালী দেহের এই সম্প্রদায় পর্বতারোহণে পারদর্শী। খুব উচ্চতায় আরোহণে তাদের শারীরিক সক্ষমতা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার জন্য পর্বতারোহণ কমিউনিটি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই গোত্রের লোকেরা হিমালয় পর্বতারোহণ অভিযাত্রীদের মালামাল পরিবহণ ও গাইড হিসেবে কাজ করে বিধায় পর্বতারোহীদের সাহায্যকারীদের এখন ‘শেরপা’ হিসেবে উল্লেখ করা একটি প্রচলিত শব্দে পরিণত হয়েছে। এখন অন্য কেউ এ কাজে নিয়োজিত হলে তাকেও ‘শেরপা’ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়’।………………………(চলবে)।