সিঙ্গারার জন্ম ইতিহাস


 

সিঙ্গারা


সিঙ্গারা আমরা কমবেশি সবাই খাই। কিন্তু কতোজন জানি এর আবিস্কারক কে ?

 

ঠাণ্ডা লুচি বারংবার ফেরত পাঠানোয় রাজবাড়ির হালুইকর (পাঁচক) অনুমতি চেয়েছিলেন রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে। রাজ চিকিৎসকের পরামর্শে মধুমেহ রোগাক্রান্ত রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে শূলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন হালুইকরকে। অনেক অনুনয় বিনয় করে নিজের প্রাণরক্ষা করেছেন হালুইকর। রাজা আদেশ দিয়েছেন - হালুইকরকে তিন রাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে।

 

দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করে্লো, দেশত্যাগের আগে একবার রাজার সাথে দেখা করবে। সে মোতাবেক তৃতীয়দিন সকালবেলা রাজদরবারে এসে প্রণাম জানালো স্বয়ং রাজা মশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় হালুইকরের স্ত্রী রাজাকে জানায়, - সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন। এজাতীয় লুচি এবং তরকারি নাকি কিছুক্ষণ বাদেই খাওয়ার নিয়ম।

 

সন্দিহান রাজা কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন রন্ধনশালায়। জানিয়ে দিলেন, যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ রন্ধনশালা থেকে খাবার পৌঁছনো চাই। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানিয়েছিলো - খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় তৎক্ষণাৎই পৌঁছবে। কিন্তু অনুগ্রহ করে তিনি যেনো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান। অন্যথায় মহামান্য রাজকীয় জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে।

 

বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হাস্যমুখে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেলো রন্ধনশালায়। রাজ-পাচক আলুর তরকারি তৈরি করে রন্ধনশালায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে। হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দার তাল মাখা রয়েছে হাতের সামনে।

 

হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে বসলো ময়দার তাল নিয়ে। সে নিজে লেচি কেটে লুচি বেলে কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ট রাজ পাচকের সামনে নিজের আঁচল সামলে শুরু করলো চটুল গল্প।

 

রাজাজ্ঞা আসতেই তরকারির পুর ভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়াইয়ে ফেলে নিমেষের মধ্যে সোনালী রঙের ত্রিভুজ দ্রব্যগুলি তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই চললো রাজসভায়।

 

মহারাজ এরূপ অদ্ভূতাকৃতির খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো - খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা। মহারাজ যেনো সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন - ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে স্বাদটি জানান।

 

মহারাজ আর স্বাদ জানাননি। শুধু তিনছড়া মুক্তো মালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির হালুইকরের (তার স্বামী) দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রায় 'মাস পর হেসে উঠেছিলেন মহারাজ। শান্তি পেয়েছিলো তামাম প্রজাকুল।

 

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া।

 

পরবর্তীকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ স্বয়ং সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রতি সন্ধ্যায় বসতেন একথালা সিঙ্গারা নিয়ে।

 

দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হস্তী ভেট নিয়ে গিয়েছিলো উমিচাঁদের কাছে - আর বাইশটি স্বর্ণথালা ভর্তি বাইশ'শোটি সিঙ্গারা।

 

ভারতীয় খাদ্য হিসেবে সিঙ্গারার সাথে রবার্ট ক্লাইভের প্রথম সাক্ষাৎ হয় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই সৌজন্যে।

 

সিঙ্গারার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে তাঁর প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার।

 

ইংরেজিতে বলে, "common sence makes a man uncommon".  ধরিত্রীদেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতে।

 

প্রাচীন বিষয় নিয়ে নানা জনশ্রুতি থাকেঃ

তবে ঐতিহাসিকদের মতে নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর কড়াইশুঁটি রসুন  মাংস মেখে সেঁকে খেতো যাকে বর্তমান সিঙ্গারার জনক হিসাবে ধরা হলেও সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তারা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। 

 

এরও বহু পরে তারা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি ময়দার ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হন। শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙা বেতের চুবড়ি হোক কিংবা বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা। তবে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান হালুইকরের স্ত্রীর উদ্ভাবনটি সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী।

 


ঢাকাই সিঙ্গারা



ভাষাবিদদের মতে, সমভুজা> সম্ভোজা> সাম্ভোসা> সামোসা। 

মতান্তরে, সমভুজা> সম্ভোজা> সিভুসা> সিঁঙুরা (নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)> সিঙ্গারা।

 

সিঙ্গারার জন্ম নিয়ে মতান্তর এবং বিতর্ক থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর যে এর স্বাদ আর উপকরণে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন- ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা ভারতের মাটিতে পা রাখার পর দেশের মানুষের পরিচয় হয়আলুনামের চমৎকার এক সবজির সঙ্গে।

 

পরবর্তীতে এই সবজিকে মানুষ যে কতটা আপন করে নিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য! ষোড়শ শতকের পর থেকে সিঙ্গাড়ার মূল উপকরণ হয়ে ওঠে এই আলু।

 

দেশে মাংসের সিঙ্গারা, ফুলকপির সিঙ্গারা, পনিরের সিঙ্গারা, ক্ষিরের সিঙ্গারা ইত্যাদি নানা রকমের বা নানা স্বাদের সিঙ্গারার চল থাকলেও আলুর পুর দেওয়া সিঙ্গারাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাই তো আলু ছাড়া সিঙ্গারার কথা আমরা ভাবতেই পারি না!

 

(উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত সংকলিত)

 

 

 

 

 

 



 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url