গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৫)

 

 


কোরিয়াতে ‍সারাদিন কাজের অবসরে শীতের মধ্যে নিজের রুমে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। তবে রুমে টিভি থাকায় একটু বিনোদনের সুযোগ ছি্লো। ১৯৯২ সালেই সে দেশে প্রায় ৫০ টি টিভি চ্যানেল চালু ছিল। তারমধ্যে আমেরিকার দু’টি এবং জাপানের একটি, বাকি সবগুলো তাদের নিজস্ব। আমাদের দেশে তখনও পর্যন্ত একমাত্র বিটিভিই ভরসা।

'টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে বোঝা যেতো ওয়েষ্টার্ন কালচারের প্রতি তাদের প্রবল আকর্ষণ। বিশেষ করে আমেরিকান কালচার হুবহু নকল করতে চাইতো'।

 

এর বাইরে মাঝেমধ্যে নেপালী বন্ধুরা এসে তাদের অন্যান্য বন্ধুদের অস্তানায় বেড়াতে নিয়ে যেতো। নেপালীরা খুবই সঙ্গবদ্ধভাবে চলতো। প্রায়ই তাদের কারো না কারো বাসায় পার্টির আয়োজন থাকতো।

 

‘অবৈধভাবে অবস্থান করার কারণে উপার্জিত টাকা পাঠানো নিয়ে পড়ে গেলাম সমস্যায়। দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া কিছু টাকাও আমার কাছে ছিলো। যারা অস্থায়ীভাবে ‘ষ্টে অর্ডার’ বা ’ওয়ার্ক পারমিট’ করাতে পেরেছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতো। ‘অনেকে বিমানের ফিরতি টিকেটও পাঠিয়ে দিতো। তাদের আত্মীয়স্বজনরা সেটা ফেরত দিয়ে বিমান কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে নিতো। কিন্তু আমি সে ঝুঁকি নেইনি। এক বছর মেয়াদী টিকেট, ফেরত পাঠানোর প্রয়োজন হলে এক বছরের মধ্যে যে কোন সময় ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু তার আগেই যদি কোন সমস্যায় পরি, দেশে ফেরত যেতে হয়! টিকেটটা থাকলে অন্ততঃ নিশ্চিন্তে দেশে ফিরতে পারবো’।

 

আমার মালিক (মালকিন) বলছিলো তুমি ডলার করে রেখে দাও, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাইও। কিন্তু হুন্ডি আগাগোড়াই আমার অপছন্দের একটি মাধ্যম। পরে এক কোরিয়ান সহকর্মীর দ্বারা তার জাতীয় পরিচয় পত্রের সাহায্যে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলাম। তবে টাকা পাঠানোর সময় ব্যাঙ্কের কোনো কর্মচারী বা অন্য কেউ তাকে ভয় দেখিয়োছিলো, ‘তুমি যে টাকা পাঠাচ্ছো, এতে তোমার অসুবিধা হবে’। সে কারণে সে আর ঝুঁকি নিলো না। পরামর্শ দিলো, ‘তোমাদের দেশের কোনো ব্যংক থাকলে তাদের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারো’।

 

ওই সময়ের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী খুঁজতে লাগলাম আমাদের দেশের বাংক, কিন্তু পেলাম না। অবশেষে যোগাযোগ ঘটে ‘ন্যাশনাল বাংক অব পাকিস্তান’ সিউল শাখার ম্যানেজারের সাথে।

 

‘আমাদের স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর বাংলাদেশে অবস্থিত শাখাগুলোকে সোনালী ব্যাংক নামকরণ করে সরকারী মালিকানায় নতুনভাবে পরিচালিত হয়। আমার তখনকার জ্ঞানে চিন্তা করেছিলাম, যেহেতু আমাদের সোনালী ব্যাংক এক সময় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের শাখা ছিলো, অতএব তাদের সাথে সোনালী ব্যাংকের যোগাযোগ থাকতে পারে। সেই চিন্তা থেকে সেই ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলাম’।

 

‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্মমতার কারণে আমরা এদেশীয় কিছু মূর্খদেরকেও রূপকার্থে পাকি বলে গালি দেই। আমি নিজেও এ যাবৎকাল যতো্জন পাকিস্তানী বা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বঙ্কারী পাকিস্তানী নামধারী অবাঙ্গালি বিহারীদের সাথে মিশেছি, তাতে মনে হয়েছে, পাকিস্তানীরা আদতেও বেঈমান। কিন্তু সীমান্তগান্ধীখ্যাত ‘খান আবদুল গাফফার খান’, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক প্রগতিশীল ন্যাপ নেতা ‘খান আবদুল ওয়ালী খান’, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালিন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা বিখ্যাত বই “Witness to Surrender” এর লেখক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মেজর) সিদ্দিক সালিকদের মত লোকেরা পাকিস্তানেই জন্মগ্রহন করেছে।

তাদের মতো অতোবড় না হলেও সাদামাটা ভদ্রলোক হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সিউল শাখার ম্যানেজার যে আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা দেথিয়েছিলো তা মনে রাখার মতো। ফোনে যোগাযোগ করার পর তার সাথে দেখা করতে বললো’।

 

ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়ের একটি স্মরনীয় ঘটনা আছে যা মানবতাবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’।

‘কোনকিছু যদি সহজলভ্য হয় তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কম থাকে বা থাকেই না। একারণেই সে দেশে যৌন অপরাধ নেই বললেই চলে। ছেলেমেয়ে স্বাধীনভাবে একসাথে কাজ করছে, দিনে-রাতে রাস্তাঘাটে চলাচল করছে, কেউ কারো প্রতি কামনার দৃষ্টি নিয়েও তাকাচ্ছে না।

একদিন ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে কিছু যুবক এক মেয়েকে উত্যক্ত করেছিলো, সেটা পরেরদিন খবরের কাগজের প্রধান শিরোনাম হয়েছিলো’।

 

‘আমাদের দেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে শরীর ম্যাচম্যাচ করে, অলসতায় পেয়ে বসে। কিন্তু শীতপ্রধান দেশে তেমন অনুভব করিনি। সারারাত সম্পূর্ণ নির্ঘুম থাকলেও শরীরের সহনশক্তি (stamina) অটুট থাকে। আগের রাতে নির্ঘুম থেকে পরেরদিন ব্যাংকে যাওয়ার কারণে দিনে একটুও না ঘুমিয়ে পুনরায় সারারাত জেগে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে সেটা অনুমান করেছিলাম’।

 

‘বলছিলাম ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তান-এর শিউল শাখায় যাওয়ার সময়ের স্মরণীয় ঘটনার কথা’।

ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে ঠিকানা জানতে চাইলে বললো, সিটিহল সাবওয়ে রেল ষ্টেশনে নেমে পূর্বদিকে ‘কেইবো বিল্ডিং’ বললে সবাই চিনবে।

‘আগেই বলেছি, সিটিহল রেলষ্টেশনের অবকাঠামোগত মূল্যমান আমাদের ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমপক্ষে ১০ গুন বেশি হবে। তিনতলা মাটির নিচে অবস্থিত রেলষ্টেশনের চতুর্দিকে চলন্ত সিড়ি ওঠানামা করছে। তারই এক সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে তুষারাচ্ছন্ন দিনে কোনদিক পূব কোনদিক পশ্চিম বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পথচারী যাকেই জিজ্ঞেস করি ‘where is keybo building’- ইংরেজি না জানার কারণে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কেউ আবার ‘আই দোন নো ইংলিশ’ বলেই হাঁটা দেয়।

 

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম লম্বা সৌম্য সুঠামদেহী ওভারকোট পরিহিত এক লোক হেঁটে যাচ্ছে। দেখে একজন বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চ পর্যায়ের লোক বলেই মনে হলো। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘do you know english?’। বেচারা অতি ভদ্রতা সহকারে মুখ কাচুমাচু করে বললো, ‘I can’t speak english’ বলেই হাঁটা শুরু করলো। এতোটুকু যে বলতে পেড়েছে তাকে দিয়েই কাজ হবে ভেবে তার ওভারকোট চেপে ধরে বললাম, ‘where is keybo building’?। দিশামিশা না পেয়ে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘follow me’।

 

ভদ্রলোক আগে আগে হাঁটছে আমি পেছনে। প্রায় ৫০০ মিটার রাস্তা যাওয়ার পর পেছন থেকে যতো বলি, Mr. where are you going? কোন উত্তর নেই। ভাবলাম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে আমাকে! নাকি সে তার গন্তব্যে যাচ্ছে, আমি অনর্থক তার পিছু পিছু হাটছি। আমার আবার সেই মানুষের মাংস খাওয়ার কথা মনে পড়ে ভয় হতে লাগলো। পেছন থেকে ওভারকোট টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম, আমার মুখের দিকে বিনয়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওই একই কথা, ‘follow me’। বিনয়ী, নম্র চাহনী দেখে মনে হলো, এই লোক কোনো ধূর্ত বা ধান্দাবাজ লোক হতে পারে না।

 

এভাবে প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা যাওয়ার পর এক বিল্ডিং-এর গায়ে লেখা দেখিয়ে বললো, ‘that is keybo building’, বলেই ‘এবাউট টার্ন।

কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখন কোথায় যাবে’? সে যা বললো তাতে বুঝলাম, যেখান থেকে সে আমাকে নিয়ে এসেছে সেখানে গিয়ে তারপর তার নিজের গন্তব্যে যাবে।

 

‘আমাদের দেশে এক সময় মফঃস্বল থেকে আগত কেউ ঢাকার কোনো দোকানীকে কো্নো ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে জানুক বা না জানুক ঝামেলা এড়ানোর জন্যে বলে দিতো, ‘আগে বাড়েন’ বা ‘সামনে দেখেন’। আগন্তক ‘সামনেই বুঝি তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা’ ভেবে এগিয়ে গিয়ে ঠকতো। অথচ কুত্তা খাওয়া জাতি হিসেবে পরিচিত এক কোরিয়ান তার নিজের কাজ ফেলে আমাকে যে বদান্যতা দেখালো তা কোনোদিন মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়।……......(চলবে)

(১৯৯২ সালের ঘটনা। ২০১৪ সালের লেখা)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url