গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-৩২)
শিলিগুড়ি থেকে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্টপেজে।
তারপর ভ্যান গাড়িতে চেংড়াবান্ধা স্থল বন্দরে। বাস থেকে নেমে এক নেপালী ছাত্রকে
পেলাম, সে বুয়েটে (BUET) পড়ে। একসাথে গল্প করতে করতে ভ্যানে এলাম। দেখলাম বন্দরের
সব কর্মচারী ও ভিসা সহায়তাকারীদের সাথে তার খুব দহরম-মহরম। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার
সময় ওর টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিলো। ওখানকার এক ভিসা সহায়তাকারী-কাম-মানি চেঞ্জারের বুথ
থেকে ধার করে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো। বাড়ি থেকে ফেরৎ আসার সময় তা দিয়ে এলো।
বন্দর আনুষ্ঠানিকতার জন্যে পাসপোর্ট জমা দিয়েছি। কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই
আমাদের পাসপোর্টে ‘ডিপারচার’ সিল মেরে দিয়েছে। এমন সময় এক ভিসা সহায়তাকারী যেচে
সাহায্য করতে আসে। আমাদের ভিসার সময়কাল ৭২ ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে দেখে আমাকে
নিয়ে গেলো ‘ইন্সপেক্টর’ পদমর্যাদার এক ইমিগ্রেশন অফিসারের খাস ‘গোডাউনে’। গোডাউন
বললাম এ কারণে, বাঙ্কারের মতো কিছুটা গর্ত করে নির্মিত ছোট্ট একটা ছাপড়া ঘর। তার
আবার দুই ভাগ করে এক খোপে মানুষজন গেলে দাঁড়ানোর জায়গা। অন্য খোপ আরো একটু বেশি
গর্ত এবং তারমধ্যে এয়ারকুলার লাগানো, ‘মজাই মজা’!
শান্তশিষ্ট ...বিশিষ্ট ভদ্রলোকের কাছে যাওয়ামাত্র বললেন, ‘আপনাকে
শিলিগুড়ি ইমিগ্রেশন অফিস থেকে ‘ষ্টে অর্ডার’ করিয়ে আনতে হবে’। আমি বললাম, বাড়ি চলে
এসেছি এখন আবার শিলিগুড়ি যেতে হবে? এ ব্যাবস্থা কি আপনাদের আওতাধীনে নেই? বললো, ‘শিলিগুড়ি
থেকে করিয়ে আনলে মাত্র দুই’শ রুপীতে হয়ে যাবে, এখানে করলে জরিমানাসহ সাত’শ রুপী
লাগবে’। বললাম, তাইই করেন। “কি করলো জানিনা, সিল তো আগেই দিয়েছিলো। সাত’শ রুপীর
কোনো রশিদ ্দিলো না। জানিনা তা সরকারী কোষাগারে যাবে, না নিজেদের উদরে যাবে!
দার্জিলিং থেকেই ‘এসআর পরিবহনের’ টিকেট বুক করা ছিলো। বর্ডার পার
হয়ে পরিবহনের ‘রেষ্ট রুমে’ গোসল সেরে সেখানেই ব্যাগপত্র রেখে পাশের ‘বুড়ির হোটেল’
নামে খ্যাত হোটেলে খেতে গেলাম। সেখানে তিন চার গাড়ির বাংলাদেশী, ভারতীয়, ভুটানী,
নেপালী লোকদের সাথে দেখা হলো। অত্যান্ত সুন্দর ভুটানী এক নবদম্পতিকে দেখলাম বাংলাদেশে
আসতে। হয়তো কক্সবাজার কিংবা অন্য কোনো অবকাশ যাপন কেন্দ্রে মধুযামিনীতে এসেছে।
ভুটানীরা মনেহয় বেশ লম্বা এবং সুন্দর হয়। যে দম্পতিকে দেখলাম তারা দেখতে বেশ
সুন্দর ও লম্বা।
আমাদের তিস্তা নদীর উপরে যে সেতুটি আছে তা একেবারেই সংকীর্ণ। দুটি
গাড়ি পাশাপাশি ক্রস করতে পারেনা। একটা একটা করে যেতে হয়। সেকারণে সেতুর দুইপাশে
৫-১০ কিলোমিটার ব্যাপী জ্যাম লেগেই থাকে। বুড়িমারী থেকে বাস ছেড়ে এসে তিস্তা সেতুর
দীর্ঘ জ্যামে অনেক্ষণ থাকতে হয়েছিলো। জ্যামের সময় যাত্রীরা নেমে হাঁটাহাঁটি ও
ধূমপানের এক পর্যায়ে কথা হলো কয়েকজন যাত্রীর সাথে। তারা ভুটান থেকে বেরিয়ে এলো।
ভুটানে নাকি রাস্তাঘাটে একটা সিগারেটের অবশিষ্টাংশও পড়ে থাকতে
পারেনা। কেউ এ অকাজটি করে ধরা পড়লে নাকি জরিমানা গুনতে হয়।
আগেও ইচ্ছে ছিলো এর পরে ভুটান বেড়াতে যাবো। তাদের সাথে আলাপের পর
আগ্রহটা আরো বেড়ে যায়। এছাড়া পশ্চিম বাংলার কোচবিহার আলীপুরদুয়ারাসহ ভারতের উত্তর
পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর যে গুলোতে বাংলা ভাষার ছোঁয়া আছে, যেমন; আসাম, ত্রিপুরা
রাজ্যগুলো ঘুরবো। সেইসাথে সুযোগ পেলেই দারজিলিং। সময় ও সুযোগের অভাবে এবং কিছুটা
অলসতার কারণে আর কোথায়ও যাওয়া হয়নি। ভিসা সংগ্রহের ঝামেলাই আসলে মূল কারণ। তবে
শীঘ্রই যাবো বলে আশা আছে।
‘বাল্যকালে মনে পুষে রাখা স্বপ্নের কোলকাতা বেড়ানোর ঘটনা লিখতে
গিয়ে সিউল, কাঠমুন্ডু, পোখরা, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি ইত্যাদি বেড়ানোর গল্পও লিখে
ফেললাম। সাধারণ একটা ঘটনা এতো লেখায় রূপ নেবে কখনও ভাবিনি’।
ফেসবুকে অনেককে লেখালেখি করতে দেখে একদিন মনে হলো, মনের পুঞ্জীভূত
কথাগুলো লিখলে কেমন হয়। সেই চিন্তা থেকে ছোট্ট এ ভ্রমণ কাহিনী লিখতে গিয়ে লেখার
পরিধি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ফেসবুকের পাশাপাশি লেখাটি একটি অনলাইন পত্রিকাতেও
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে হিতাকাঙ্ক্ষী বেশকিছু বন্ধু পরামর্শ দিলেন,
লেখাটি একটা বই আকারে বের করেন। সে চিন্তা থেকেই এই প্রয়াশ। তবে বাস্তবায়ন হবে
কিনা তা চিন্তা করতে হয়তো আরো সময় লাগবে।
‘ইচ্ছে করে সারা পৃথিবীটাই ঘুরে বেড়াই। কিন্তু আর্থিক আসংগতি, জীবন
জীবিকার প্রয়োজনে প্রাত্যহিক ব্যস্ততা ইত্যাদি কারণে সম্ভব হয়না। তাছাড়া তাৎক্ষণিক
সিদ্ধান্তে পাশের দেশগুলোতে বেড়াতে যাওয়ার মূল প্রতিবন্ধকতা হলো ভিসা। সংশ্লিষ্ট
দেশের দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহের জন্যে যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয় তা কর্মজীবী
মানুষের জন্যে বড় প্রতিকুলতা। তাই আমি ‘ভিসামুক্ত পৃথিবী চাই’ শ্লোগানের একজন একনিষ্ঠ
সমর্থক এবং এর বাস্তবায়ন চাই’।
‘মানুষ চাইলেই সবকিছু পায় না। জানি ‘ভিসামুক্ত পৃথিবী চাই’ বিষয়টাও
শুধু শ্লোগানেই থেকে যাবে। কোনোদিন বাস্তবে রূপলাভ করার সম্ভাবনা নেই। তাই
ভিসামুক্ত না হোক, অন্ততঃ সহজ পোর্ট এন্ট্রি ভিসা পদ্ধতি চালু হতে পারে। বিশেষ করে
পাশের দেশগুলোতে যাতে ইচ্ছে হলেই যখন তখন, যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যায়। সে কারণে এটা
বাস্তবায়ন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি’।
‘বিলাসী ভ্রমণকারী না হোক, আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াশ অন্ততঃ নিম্ন
আয়ের ভ্রমণ পিয়াসীদের কিছুটা হলেও আনন্দ দেবে আশাকরি। পরবর্তীতে কোথায়ও বেড়াতে
গেলে তাও এর সাথে সংযোজন করার ইচ্ছে রইলো (সাল ২০১৪)।
******
২০১৪ সালে যখন এই কাহিনী লিখি, কথা দিয়েছিলাম পরবর্তীতে কোথায়ও
বেড়াতে গেলে লিখবো। তারপর ২০১৬ সালে সপরিবারে ভারতের কয়েকটি দর্শণীয় স্থান ঘুরে
আসি, ২০১৮ সালে চীন যাই, ২০১৯ সালে ওমরাহ পালনে সস্ত্রীক সৌদী আরব এবং সর্বশেষ
চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে কোলকাতা এবং আগরতলা বেড়াতে যাই। কিন্তু সময় ও সুযোগের
অভাবে, কিছুটা অনাগ্রহের কারণে লেখা হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা স্মৃতিতে যতোটুকু
আছে তা এই সিরিজে ধারাবাহিক লেখার আশা রইলো। ………………………(চলবে)