গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১২)



‘কোরিয়াতে মাত্র ৪ টি ঋতু। শীত, গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্ত। তবে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বছরের প্রায় আটমাসই কমবেশি শীত থাকে। সিউল যাওয়ার সময় সর্বদা বিদেশ ভ্রমণে অভ্যাস্ত আমার মালিক বলে দিলেন শীতের কাপড় সাথে নিতে। ভাবলাম এসময়ে এতো শীত তো আর হবেনা, ব্যাগেও জায়গা হচ্ছিল না তাই একটিমাত্র বুকফারা হাফ সোয়েটার নিয়েছিলাম সাথে। সিউলে যাওয়ার পরে এক বন্ধু একটি ব্লেজার উপহার দিয়েছিলো। সেটাই হয়েছিল শীত নিবারণের বড় সম্বল’।

 

‘দক্ষিণ কোরিয়াতে ভরা শীত মৌসুমে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ১০ ডিগ্রী সে: মাঝে মাঝে তা আরো নিচে চলে যায়। রাস্তায় যেখানে সেখানে বরফ জমে থাকতে দেখা যায়। পানির পাইপলাইনে বরফ জমে যায়। সেকারণে শীতকালে ব্যবহার্য্য সব পানির লাইন ছেড়ে রাখতে হয়। অনবরত পানি পড়তেই থাকে। এরমধ্যেই সবার স্বাভাবিক কাজকর্ম চলে। কেউ থেমে থাকেনা’।

 

সন্ধ্যার পরই নতুনমালকিনে নিজস্ব প্রাইভেট কারে রওনা লাম নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভ করছে সে নিজেই। একজন উঠতি বয়সী মহিলা কতটা কর্মঠ স্মার্ট তা না দেখলে বোঝা যায় না।

 

রাতের বেলা একজনমাত্র ভিনদেশী পুরুষ নাগরিককে সাথে নিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করছে এবং একটু পরপর মোবাইলে কথা বলছে। কোরিয়ান ভাষায় কথা বলার সময় কিছু না বুঝলেও আকার ইংগিতে যতটা বুঝলাম, একজনকে বললো; ‘একজন বাংলাদেশী মানুষ আসছে আমার সাথে, তার থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে রাখতে’।

 

শীতের রাত। আমার পরনে কমপ্লিট স্যুট আর মহিলার পরনে হাফপ্যান্ট, হাফ লেডিস কোট। একজন বিদেশী পুরুষ নাগরিককে গাড়িতে একা সাথে নিয়ে যাচ্ছে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। যাচ্ছেতো যাচ্ছেই। তবে দু:সাহস আর ভাবসাব দেখে আমার কিন্তু ভয় লেগেছিল।

 

শুনেছি কোরিয়নরা নাকি মানুষের মাংস খায়। কোরিয়ায় যাওয়ার আগে এমন এক খবরও পড়েছিলাম। সৌদি আরবে কর্মরত এক কোরিয়ান নাগরিকের ফ্রিজে শিশুর হাত-পা পাওয়া গিয়েছিলো। পরে কোরিয়ায় গিয়ে জেনেছি, সৌদি আরবের বেশিরভাগ নির্মাণ কাজগুলো করেছে বিভিন্ন কোরিয়ান কোম্পানি। কোরিয়াতে যেখানে শ্রমিক স্বল্পতা; ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, চীন, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা যায় তাদের দেশে কাজ করতে। অথচ তখনও পর্যন্ত কোরিয়ানরা সৌদি আরবে কাজ করছে। এও শুনেছি, সৌদিতে কাজ করেই নাকি তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।

 

এসব কথা ভেবে ভয় লাগছিলো যে, কোনো চক্রান্তের জালে জাড়াইনি তো? আবার ভাবি, নাঃ যে লোকটা পাঠিয়েছে তাকে তো শিক্ষিত এবং খুব ভদ্র বলে মনে হয়েছে। আবার যার সাথে যাচ্ছি, লেফট স্টিয়ারিং গাড়ির সামনের বামপাশে সে বসে গাড়ি চালাচ্ছে, আমি বসা পেছনের ডানপাশের সিটে। মাঝে মাঝে গাড়ির লুকিং গ্লাসে মহিলাকে পরখ করছি। সুন্দর সাবলীল চেহারার মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ দেখতে পাচ্ছিনে।

বিষন্ন মনে আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছে মনে হলো, ঠিক জায়গায়ই এসেছি।

 

মহিলাটি আসলেই খুব অমায়িক। তার প্রতিষ্ঠানে থাকাকালিন একজন বিদেশি হিসেবে তার কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগীতা পেয়েছিলাম যা অন্যান্য কোরিয়ান কোম্পানিতে পাওয়া যায় না। তার স্বামীও ছিল অত্যান্ত ভদ্র অমায়িক একজন মানুষ।

 

কোরিয়ান কোম্পানিতে জয়েন করার আগে যে কয়দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছিলাম, দেশের অনেক লোকের সাথে দেখা এবং টেলিফোনে কথা হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ১৯৮৮এ এরশাদের পাতানো নির্বাচনে রাজবাড়ি- আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য নাজির হোসেন চৌধুরী(প্রয়াত) ওরফে নীলু চৌধুরী ছেলে মবি চৌধুরী, ১৯৯১ এর নির্বাচনে রাজবাড়ি- আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মুক্তিযোদ্ধা মহসিন উদ্দিন বতুভাই। 'তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এছাড়াও কালুখালি উপজেলা পরিষদের বর্তমান(২০১৪) চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম এবং রাজবাড়ি ঢাকা নারায়নগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আরো অনেকে। তারা সবাই বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছিলেন। কোরিয়াতে তখন উন্নয়নের জোয়ার।

 

একটা বিষয় আমার মাথায় তখন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা আমেরিকা জুজুর ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াতে আমেরিকার কলোনী অর্থাৎ সেনাবাহিনী বিদ্যমান। তারপরও তারা দ্রুততার সাথে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিভাবে? সাধারণ জনগণকেও দেখেছি আমেরিকা বন্দনায় অজ্ঞান। ১৯৯২- বিল ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কোরিয়াতে উৎসবের বন্যা বয়ে গেলো। টিভির বিভিন্ন উৎসবমুখর অনুষ্ঠান দেখে মনে হলো এটা তাদের দেশেরই কোনো উৎসব। অথচ কিছুদিন পরে সম্ভবতঃ ডিসেম্বরে নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের দিন সহকর্মী এক কোরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগামিকাল কি ছুটি’? বলে, কেন? আমি বললাম, আগামিকাল তো তোমাদের দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন। বলে, আমি জানিনা, আমরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাইনা। তার কথায় মনে হলো, সেদেশে মনেহয় আইউব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির মত নির্বাচন হয়। জনগন ভোট দিয়ে স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করে। স্থানীয় প্রতিনিধির ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। সেজন্য সাধারণ জনগন সেদেশের জাতীয় রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না।

 

বাস্তবেও দেখলাম, তারা রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তবে অত্যাধিক দেশাত্ববোধ দেখেছি তাদের মধ্যে।

তখন জার্মানির মতো দুই কোরিয়া একীভুত হওয়ার একটা কানাঘুষা চলছিলো বিশ্বব্যাপী। একদিন এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা নাকি একত্র হচ্ছো? একত্র হলেতো ভালই হবে, বড় দেশ হবে, জার্মানি যেমন হয়েছে। সহকর্মীটির ঝটপট জবাব, ‘কোন দুঃখে আমরা একত্র হবো, আর কিছুদিন পর অর্থনীতিতে আমরা জাপানকে টক্কর দেবো অন্য একদিন আ্মাকে আমেরিকান মালব্রো সিগারেট খেতে দেখে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার শাসনের সুরে বললো, এটা খেতে পারবে না। আমাদের দেশের সিগারেট খেতে হবে।

 

কোরিয়াতে মাত্র মাস ছিলাম। তারমধ্যে দুই কোম্পানি মিলিয়ে চাকরি করেছিলাম মাত্র সারে ৪মাস। যে কোম্পানির গল্প করছি সে কোম্পানিতে ছিলাম মাস। ইটালী কোরিয়ার তৈরি মোট ১৩ টা অটোমেটিক মেশিনের ছোট্ট একটি নীটিং ফ্যাক্টরী। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা হাতেগোনা। মহিলা মালিক চেয়ারম্যান, তার হাসব্যান্ড পরিচালক, ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসম্যান, দারোয়ান-কাম-ক্লিনার ২জন, দেশীয় ওঁ বিদেশি মিলিয়ে কখনও কখনও জন অপারেটর সহকারি অপারেটর। -বাইরে থেকে কোনো মাল এলে বা ডেলিভারি দিতে হলে তা করতো ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার এবং অফিসম্যান বা অফিস করণিক। অফিস করণিক কফি বানিয়েও আমাদেরকে স্পটে স্পটে গিয়ে খাইয়ে আসতো। ফ্যাক্টরির কাজে ব্যাঘাত ঘটে সে কারণে মেশিনে যারা কাজ করতো তাদেরকে ডাকতো না। অনেক সময় ডাইরেক্টর আমাদেরকে রিলিফ করতো লাঞ্চ ব্রেকের জন্য। সে মেশিনে এটেন্ড করতো। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছিলাম। ২০ চাকার বিরাট লম্বা লরি একা ড্রাইভার, কোন হেল্পার নাই। গাড়িতে মাল সাজানো নামানোর কাজ ড্রাইভার একাই করে।......(চলবে)

 

-আতাউর রহমান খান (০৩ অক্টোবর ২০১৪)

 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url