গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-১৩)
সিউল শহরে বাসে চলার সময় একটা জিনিস লক্ষ্য
করেছি। শহর বা শহরতলিতে লোকাল হিসেবেও অতি উন্নতমানের বাস চলাচল করে। ‘শহরের
ট্যক্সিকাবগুলোও দেখেছি আমাদের দেশের তখনকার অভিজাতশ্রেণীর প্রাইভেট কারগুলোর
চেয়েও উন্নত’।
বাস স্টপেজগুলোতে যাত্রীরা একে একে এসে লাইন ধরে
দাড়াচ্ছে। অল্পক্ষণ পর পর বাস আসছে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে বাসে উঠছে, কোন হুড়োহুড়ি
নেই। একটায় যেতে না পারলে পরেরটায় যাচ্ছে। বাসগুলোতে কোন হেল্পার, কন্ডাক্টর নেই,
শুধু ড্রাইভার। যাত্রীরা নামার সময় ড্রাইভারের সিটের পাশে রাখা বক্সে কয়েন ফেলে নেমে
যাচ্ছে। কেউ কম বা বেশি দিচ্ছে না।
‘কি সভ্য সে দেশের জনগন! অথচ কোন ধর্মীয়
বাড়াবাড়ি নেই। আর আমরা রাতদিন ধর্ম নিয়ে ফ্যাসাদ করি, মূলে করি ধর্মের আশ্রয়ে
ধোকাবাজি’।
ট্রেন ব্যবস্থা আরও উন্নত। শহরের সাবওয়ে ট্রেন
লাইনগুলো বেশিরভাগই আন্ডারগ্রাউন্ড। অফিস সময়ে ৫-১০ মিনিট এবং অন্যান্য সময়
আধঘন্টা পরপর ট্রেন চলছে। এক ষ্টেশন থেকে টিকেট নিয়ে কাঙ্ক্ষিত ষ্টেশনে নেমে টিকেট
পাঞ্চ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে সবাই। ট্রেনে কোনো টিটি এবং ষ্টেশনে কোন টিসি নেই। কেউ
ক্রয়কৃত টিকেটের অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করলে তারও ব্যবস্থা আছে।
একবার আমি উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ করতে বেরিয়ে এক
ষ্টেশন থেকে টিকেট করে জায়গা না চেনার কারণে নির্ধারিত ষ্টেশনে না নেমে কয়েক
ষ্টেশন পরে গিয়ে নেমেছি। টিকেট পাঞ্চিংএর সময় মেশিন টিকেট বেড় না করে এক প্রকার
শব্দ করছে। ষ্টেশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা এসে বিশেষ ব্যবস্থায় মেশিন থেকে ছাড়িয়ে
নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথা থেকে এসেছো’? ষ্টেশনের নাম বলায় সাথে করে কাউন্টারে নিয়ে
গেলো। কাউন্টারে অতিরিক্ত পয়সা জমা নিয়ে রশিদ দিলো। কোন জরিমানা নিলোনা।
সাবওয়েতে চলার সময় দেখেছি, সিউল শহরের মূল দুইটি
আন্ডারগ্রাউন্ড ষ্টেশন ‘সিউল’ এবং ‘সিটিহল’- মূল ভূমি থেকে ৩ তলা নিচে। জায়গায়
জায়গায় চলমান সিড়ি রয়েছে। অনবরত যাত্রীরা উঠছে-নামছে। ষ্টেশন দু’টির অবকাঠামোগত
মূল্যমান আমাদের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১০ গুনেরও বেশি বৈ কম
হবেনা(২০০৯ সাল মোতাবেক)। সাবওয়ে ছাড়া দেশের মূল ট্রেন লাইনে লোকাল ও দ্রূতগামী ট্রেনের
জন্যে আলাদা আলাদা লাইন। দ্রুতগামী মেইল ট্রেন ও লোকাল ট্রেন কেউ কারো চলায় বিঘ্ন
সৃষ্টি করছেনা। কো্নো ট্রেন লাইন কোনো সড়কপথেও চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেনা। ট্রেন
লাইনগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে নির্মিত।
আমি যে এলাকায় থাকতাম সে এলাকায় তেমন বাঙ্গালি
নজরে পড়েনি। বেশিরভাগ নেপালীরা ওই এলাকায় বসবাস করতো। কিছু ফিলিপিনোও ছিলো। কিন্তু
তাদের মনের গতি বুঝা মুশকিল। এই ভালো, এই মন্দ এবং তারা (ফিলিপিনো) খুব মারমুখি
স্বভাবের।
বাঙ্গালি কাউকে না পেয়ে আমি নেপালীদের সাথে
সখ্যতা গড়ে তুলেছিলাম। বাইরে বেরুলে তাদের সাথেই বেরোতাম। একদিন টেলিফোন বুথের
কাছে হঠাৎ এক বাংগালির সাথে দেখা। আমার থেকে বেশ দূরে থাকতো। কিন্তু লোকটার চালচলন
আমার ভালো লাগতোনা বিধায় তার সাথে কোথায়ও যেতাম না।
বিদেশে গেলে ইংরেজি ভাষাটা বেশ চর্চা হয়। না
জানলেও জীবন চালানোর জন্য শিখতে হয়। ব্যকরণ ছাড়া বলতে হয়। টেলিফোন বুথের কাছে
বাঙ্গালির সাথে দেখা হওয়ার পরও আনমনে ইংরেজিই বলতে থাকায় সে সন্দেহ করেছিলো, আমি
আসলেই বাংলাদেশি কি না।
আরেকদিন অল্প বয়সী এক পাকিস্তানি ছেলের সাথে
দেখা। ওরা যে কতোবড় হারামী সেদিন আবার নতুন করে বুঝেছিলাম। ফিলিপিনোদের থেকে ১০০
গুন বেশি। এতো প্যাচ ওদের মনের মধ্যে, কথা বলার সময় এতো মিথ্যা ও পেচিয়ে বলে যে,
কি বলছে তা নিজেই হয়তো বোঝেনা। ওরা মনে করে, আমি যে চালাকি করছি তা হয়তো অন্যেরা
বুঝছেনা। ভাবটা এমন, “সে যে বোঝেনা, তাও সে বোঝেনা”।
কোরিয়ান কোম্পানিতে কাজ করার সময় ছোট ছোট যে
বিষয়গুলো স্মৃতিতে রয়ে গেছে তা সবার সাথে শেয়ার করছিঃ
কোরিয়াতে শীতের সময় ফ্যাক্টরির ভেতরে চতুর্পাশের
দেয়ালে ইলেক্ট্রিক হিটার চালানো থাকতো। আমরা যেখানে বসতাম সেখানে হ্যাজাক লাইটের
মত একটা কেরোসিন তেলের হিটার জ্বালানো থাকতো। তারপরও ভিতরে ১৮-২০ ডিগ্রীর উপরে
তাপমাত্রা হতোনা। এই শীতের মধ্যে আমি যেতাম ডাইনিং রুমে কফি বানিয়ে খেতে। আর
কোরিয়ান যে আমার সাথে কাজ করতো সে খেতো ফ্রিজের ঠান্ডা কোকাকোলা। একদিন তাপমাত্রা
আরো নিচে নেমে এলে প্রকৃত তাপমাত্রা কত তা নির্ণয় করার জন্য ফ্যাক্টরির বাইরে একটি
‘তাপমাত্রা নির্ণয়যন্ত্র’ রেখে এলাম। আধঘন্টা পরে গিয়ে দেখি মাইনাস ১০ ডিগ্রী।
দু’জন বৃদ্ধ নিরাপত্তা প্রহরী কাম ক্লিনার ছিলো।
প্রতি রবিবারে যে কোনো একজন স্যুট-টাই পরে কোথায়ও না কোথায়ও বেড়াতে যেতো। গেটে
নিরাপত্তা ছাউনিতে একটা রেডিও ছিলো। সেটা কখনও বন্ধ করতে দেখিনি। যখনই গেটে যেতাম,
কেউ না থাকলেও দেখতাম সেটা বাজছেই। একদিন এক নিরাপত্তা রক্ষীকে দেখলাম ডাইনিং রুমে
বসে ধর্মীয় গ্রন্থের মতো কি যেনো একটা বই পড়ছে।
আরেকদিনের ঘটনা। পরেরদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায়
আগের রাতে পরবর্তী কাজ শুরু করলে সময়ের মধ্যে শেষ হবেনা তাই ৫ টার মধ্যে একে একে
সব মেশিনের কাজ শেষ হয়ে গেলো। ৫টার পরে কোনো মেশিনে কাজ শুরু করলে তা শেষ হতে কমপক্ষে
৪ ঘন্টা সময় লাগতো অর্থৎ সকাল ৯ টা বেজে যেতো। মেশিন বন্ধ হলো, কিন্তু ডিউটি সকাল
৮টা পর্যন্ত। হিটারের পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে দু’জন ঝিমোচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম আমার
সাথের কোরিয়ান অপারেটরটা এক জায়গায় দেয়াল ভাংগা কিছু রাবিস পরে ছিলো তা বেলচা দিয়ে
ঝুড়িতে ভরে দূরে নিয়ে ফেলছে। যদিও সেটা আমাদের কাজের আওতায় না তবুও ভাবলাম, সে কাজ
করছে - আমি বসে আছি, না জানি রেগে যায়। সেই ভয়ে এগিয়ে গেলাম কাছে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘এগুলো করছো কেনো, আমাকে কি করতে হবে’? বললো, ‘না না না, এটা আমাদের কাজ না। এটা
ওই বৃদ্ধ নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ। আমার হাতে সময় আছে তাই করছি যাতে বৃদ্ধ লোকদের
কষ্ট করতে না হয়। তুমি গিয়ে বসে থাকো।
এই সুযোগে কোরিয়ান ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিরাপত্তারক্ষী
ওই বৃদ্ধ লোকটিকে মাঝে মাঝেই কিচেনে বসে একটা বই পড়তে দেখি। ওটা কি বই পড়ে’? সে
জবাব দিলো, ‘মে বি বাইবেল’।
শুনেছি কোরিয়ার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ লোক কোনো
ধর্ম পালন করেনা। বাকি দুই তৃতীয়াংশের অর্ধেক খ্রিস্টান ও অর্ধেক বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোকটা কি খ্রিস্টান’? তার ঝটপট জবাব, ‘আই দোন
নো’। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অল্প কয়জন লোক তোমরা, অথচ কে কি ধর্মের তা
জানোনা, এ কেমন কথা! বললো, ‘আমরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। তোমাদের দেশে বুঝি এগুলোই
খুজে বেড়ায়’? আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত বললাম, না, ‘আসলে
খাদ্য খাওয়ার ব্যাপারে কিছু বাছাবাছি আছেতো তাই তখন জিজ্ঞেস করতে হয় কে কোন
ধর্মের’। পুনরায় সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কোন ধর্মের’? আবারো ঝটপট উত্তর।
‘আমার বাবা বৌদ্ধ, মা খ্রিস্টান, আমি কোনটাতেই বিশ্বাস করি না।
এ থেকে আমরা কি শিক্ষালাভ করতে পারি? যার মা
বাবা দু’জন দুই ধর্মের, নিজে কোন ধর্মই বিশ্বাস করেনা, অথচ নীতি ও মানবিকতাবোধে
সবাইকে ছাপিয়ে।
এর আগেও লক্ষ্য করেছি, ওর যদি দিনে ডিউটি থাকতো
তাহলে এমনভাবে কাজ করতো যাতে শীতের মধ্যে রাতের লোকদের বেশি কষ্ট করতে না
হয়।.........(চলবে)।
(০৩ নভেম্বর ২০১৪-এর লেখা)