গরীবের ভ্রমণ বিলাস (পর্ব-২০)



ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বোর্ডিং পাশ নিয়ে সিউল বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় ভাবলাম ভিতরে যদি কোন মানি চেঞ্জার না থাকে তাহলে কোরিয়ান টাকা ভাঙ্গিয়ে ডলার করবো কিভাবে! অবশেষে তাদের কাছেই বিনয়ের সাথে বলতে বাধ্য হলাম যে, আমার কাছে কিছু কোরিয়ান ওন আছে – ডলার করতে হবে।

 

তল্লাশি করে আমার কাছে কোনো টাকা নেই জেনে ট্যাক্সিভাড়া ও এয়ারপোর্ট ফি অফিস থেকে নিয়ে এলেও প্রসেসিং সেন্টার থেকে বিমানবন্দরে আসার পথে তারা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘তোমার কাছে কি সত্যি কো্নো টাকা নেই’? বিমানবন্দরে এসে আসল কথাটা বলায় তারা অবাক হলো এবং বিনিময় করে দেয়ার জন্যে বে্র করতে বললো। মোজার ভিতর থেকে একে একে বেড় করা দেখে তাদের চোখ ছানাবড়া !

 

আমি ভাবছিলাম রেগে টাকাগুলো কি আর ফেরতই না দেয়। কিন্তু না, শুধু দাবী করলো, ‘ট্যাক্সিভাড়া ও এয়ারপোর্ট টিকেটের টাকাটা তোমাকে দিতে হবে’।  ট্যাক্সিভাড়া এবং এয়ারপোর্ট ট্যাক্স মিলয়ে বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৭০০ টাক। সামান্য আবদার শুনে খুশি মনে সাথে সাথে সম্মতি জানালাম এবং গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এটাও বুঝতে পারলাম, ভাড়ার টাকা তো ওরা অফিস থেকেই নিয়ে এসেছে, এ টাকাটা ওরা নিজেরা নেবে। বিষয়টা আরো পরিস্কার হলো যখন টাকাটা ভাঙ্গিয়ে অবশিষ্ট টাকার ডলারের সাথে এক প্যাকেট কোরিয়ান সিগারেট ও একটি লাইটার আমাকে উপহার দিলো। মনে মনে ভাবলাম, কোরিয়ান ইমিগ্রেশন কর্তারা ‘চোর হলেও মানুষ ভালো’। ইচ্ছে করলে আরো বেশি টাকা আমার কাছ থেকে দাবী করতে পারতো। তা তো করলোইনা, বরং ওদের অংশ থেকে আমাকে উপহার দিলো।

 

গল্পে গল্পে সময় পেরিয়েছে। ১৯৯২ শেষ করে কখন যে ১৯৯৩ এ প্রবেশ করেছি একবারও মনে জাগেনি। দেশের উদ্দেশে সিউল থেকে ৬৭৫ (৪৭৫ ও হতে পারে সঠিক মনে নেই) আসনবিষিষ্ট বিরাটকায় ‘ক্যাথে প্যাসিফিক’ বিমানে যেদিন পা রাখি সেদিনটি ছিলো ১৯ এপ্রিল ১৯৯৩। ঢাকা থেকে অল্প ভাড়ায় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ‘ড্রাগন এয়ারের’ টিকেট নিয়েছিলাম। কিন্তু ড্রাগন এয়ারের কোন ফ্লাইট সরাসরি সিউল যাতায়াত করেনা বিধায় হংকংএরই (আগে থাইল্যান্ড লিখে থাকলে তা ভুল) আরেক কোম্পানি ক্যাথে প্যাসিফিকের সাথে হংকংএ যাত্রী অদলবদল করে, যা আগেও বলেছি। সে কারণেই সিউল থেকে আমার ফ্লাইট সিডিউলে বিলম্ব ঘটে।

 

বিমানের রুট ছিলো সিউল - সিউলের পাশ্ববর্তী চীনের একটি এয়ারপোর্ট – তাইওয়ান - হংকং। হংকং থেকে আবার ড্রাগন এয়ারের ঢাকাগামী ফ্লাইট।

 

চীনের এয়ারপোর্ট থেকে তাইওয়ানের উদ্দেশ্যে বিমান ছাড়ার সময় যাত্রীদেরকে চীনা ইংরেজি পত্রিকা সরবরাহ করা হয়। বিমানে বসেই পত্রিকায় দেখলাম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে বরখাস্ত করেছে। দুই আড়াই বছর আগে ১৯৯০ সালে বেনজীর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালিন তাদেরই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওই একই ব্যাক্তি বেনজীর ভুট্টোকেও বরখাস্ত করেছিলো। তাহলে তার কাছে ভালো কে ছিলো?

 

চীনের এয়ারপোর্ট থেকে তাইওয়ানের উদ্দেশ্যে বিমান উড়াল দিলে বিমানে চীন এবং তাইওয়ানের যাত্রীই ছিলো ৯০/৯৫ ভাগ। লাঞ্চ সরবরাহ করলে আবার সেই শুকরমাংস(pig) বিড়ম্বনা। ট্রে আকারের বড় একটি প্লেটের মাঝখানে অল্প কিছু ভাতের চারপাশে ভাত খাওয়ার উপকরণ সাজানো। তারমধ্যে এক টুকরো মাংশ দেখে বিমানবালাকে ডাকলাম। শতশত যাত্রীর মধ্যে আমি মুসলিম জেনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হংকং এর বাসিন্দা বিমানবালা বললো, ‘এটা শুকরের মাংস। তুমি খেয়োনা। দেখি তোমার জন্যে কিছু ব্যাবস্থা করতে পারি কি না’।

 

কিছুক্ষণ পর বিফল মনোরথে ফিরে এসে অত্যান্ত বিনয়ের সাথে বিমানবালা বললো, ‘আমি ভারতীয় এবং হিন্দু। হংকং এ বসবাস করি। আমিও শুকরের মাংশ খাইনা। তোমার প্লেটে মাছও আছে তুমি সেটা খেতে পারো’।

 

অবশেষে বিমানবালার দেখানো মাছ দিয়ে প্লেটের একপাশ থেকে কিছু ভাত খেয়ে উদর জ্বালা নিবৃত করেছিলাম। তবে সেটা কি মাছ ছিলো তা জানতে পারিনি।

 

তাইওয়ানের তায়েপী বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় বিমান থেকেই সেদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মনে হলো যদি নেমে বেড়িয়ে যেতে পারতাম! কিন্তু প্রাণের আকুলতা প্রাণে চেপেই বিমানে বসে থাকতে হলো।

 

আধাঘন্টার মধ্যে যাত্রী ওঠানামা শেষে তাইওয়ান থেকে বিমান যখন হংকং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে হঠাৎ বিমানের মনিটরে তাকিয়ে দেখলাম চীন সাগরের উপর দিয়ে ঘন্টায় ৬০০ মাইল গতিবেগে বিমানটি উড়ে যাচ্ছে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা ২৪ হাজার ফুট থেকে ২৯ হাজার ফুটের মধ্যে ওঠানামা করছে। মনিটরে বিমানের ছবিসহ দেখাচ্ছিলো কখন সাগরের কোন অবস্থানে বিমানটি অর্থাৎ আমরা অবস্থান করছি। দেখে বুকটা কেঁপে উঠেছিলো।

 

হংকং এয়ারপোর্টে আবার অপেক্ষার পালা। ড্রাগন এয়ারের ফ্লাইট স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটায় ঢাকার উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে। পূনরায় হংকং এয়ারপোর্টে কয়েকঘন্টা বসে থেকে দেখলাম কিছুক্ষণ পরপর শরনার্থী’র মত দলে দলে লোকজন আসছে, যাচ্ছে।

 

শুনেছি হংকং এয়ারপোর্টই বিশ্ব এয়ার রুটের প্রধান ট্যানজিট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানই হংকং হয়ে যাতায়াত করে। আফগানিস্তানে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিলো। অসংখ্যা আফগান নাগরিককে অজানা আশংকায় বিসন্ন মনে দলে দলে আসা যাওয়া বা বিমানের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখেছি।

 

দুইজন জবুথবু 'কামলা' টাইপের লোককে দেখলাম বিমর্ষ বদনে বসে আছে। আমার আবার বিভিন্ন রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহ বেশি। এগিয়ে গিয়ে আলাপ জমালাম, ‘তোমাদের দেশ কোথায়, কোথায় যাবে’ ইত্যাদি। সম্ভবতঃ মহাসগরীয় অঞ্চলের পালাউ বা নাউরু এই জাতীয় একটি দেশের নাম বলেছিলো। কিন্তু কোথায় যাবে তা আর বললোনা।

 

৩৫-৪০ বছর বয়সী এক সৌদি নাগরিকের সাথে দেখা হলো। একই বিমানে ঢাকা আসবে। কিন্তু তার বাংলাদেশে আগমনের স্বচ্ছ কোন উদ্দেশ্য জানা গেলোনা।

 

দু’একজন বাংলাদেশির সাথেও দেখা হলো; কেউ লাগেজ ব্যাবসায়ী, কেউ তিনমাসের পোর্ট এন্ট্রি ভিসা নিয়ে হংকংএ চাকরি করে দেশে যাচ্ছে। ক’দিন পরে আবার আসবে।

 

হংকং থেকে বিমান ছাড়ার পর মনটা একটু উতফুল্ল লাগছিলো। বিমানে অধিকাংশই দেশীয় যাত্রী। রাতের খাবারও সরবরাহ করা হলো বাংগালি খাদ্য বাসমতী চালের ভাত, সাথে পাবতা মাছ ও মশুরের ডাল। অনেকদিন পর মন পূরে খেতে লাগলা্‌ কিন্তু পেট পূরছিলোনা।

 

সবার জন্যে নির্দিষ্ট পরিমানে একটা বাটিতে কিছু ভাত। ওই কয়টা ভাতেতো আর বাঙ্গালির উদরপূর্তি হয়না। সবাই ওইটুকু খেয়েই খাওয়া শেষ করছে। কিন্তু আমি লজ্জা চেপে বিমানবালাকে ডেকে নীচু স্বরে আরও কিছু ভাত দেয়া যায় কি না জিজ্ঞেস করলে সে আরেক বাটি ভাত এনে দিলো। অনেকদিন পর বাংগালি খাবার পেয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে খেলাম।

 

শুনেছি বিমানে যা চাওয়া যায় তাই সরবরাহ করে। কৌতূহল নিবারণের জন্যে কোরিয়াতে দেখা সেই ‘গ্রেপ ওয়াইন’ আছে কিনা জানতে চাইলে ছোট্ট একটি কাঁচের গ্লাসে এনে দিলো। আমার দেখাদেখি আমার পাশের সিটের লোকও অর্ডার দিল। কিছুক্ষণ পর আবার বললাম ‘অরেঞ্জ জুস’ দেয়া যাবে কি না? তাও সরবরাহ করলো। অরেঞ্জ জুস খেয়ে শরীরটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।

 

আনুমানিক অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়লো বিমান। ঝড়ের ঝাপটা লেগে বিমানের পাখা এমন শব্দ করছিলো, মনে হচ্ছিলো ভেঙ্গেচুরে আছড়ে পড়বে। বিমানের গতিও সম্ভবতঃ কমাতে হয়েছিলো।

 

অবশেষে রাত বারোটা সাড়ে বারোটায় ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে সমাপ্তি ঘটে কোরিয়া সফরের।

 

দেশে ঢুকে অনুভব করলাম শীত শেষ হয়ে গেছে। আর একটা বিষয় অনুভব করলাম, কোরিয়াতে কোথায়ও ধুলা দেখিনি। অথচ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরেরদিন সকালে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি শুধু ধুলা আর বাসের গায়ে থাপড়াথাপড়ি।

 

মনে মনে ভাবলাম, ‘ধানে ভরা পুষ্পে ভরা এমন দেশ আর নাইরে ভাই, মুড়ির টিন আর ধুলায় ভরা এমন দেশও কোথাও নাই’……………….........(চলব।।

 

 (২০১৪ সালের লেখা)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url